প্রাচীন সমুদ্রযাত্রার অনুসন্ধান
সুইডেনের লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের গবেষক গ্রিয়ার জ্যারেট ২০২১ সালের গ্রীষ্মে এক অভিযাত্রা শুরু করেন। তার লক্ষ্য ছিল ভাইকিং যুগের (খ্রিস্টীয় ৮০০ থেকে ১০৫০) নাবিকরা যে সমুদ্রপথ ব্যবহার করত, তা পুনরায় অনুসরণ করা। প্রায় তিন বছরে তিনি ও তার সহযাত্রীরা ২৬টি ভ্রমণ সম্পন্ন করেন, যা শুধু ঐতিহাসিক তথ্য নয়, বরং বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রমাণ দেয় যে ভাইকিংরা সমুদ্রযাত্রায় কতটা দক্ষ ছিলেন।
ভাইকিংদের সাধারণত লুণ্ঠনকারী হিসেবে দেখা হলেও তারা আসলে দক্ষ বণিকও ছিলেন। তাদের বাণিজ্যপথ পৌঁছে গিয়েছিল বাগদাদ পর্যন্ত। এই আধিপত্য গড়ে উঠেছিল সমুদ্রপথের ওপর তাদের দখলের কারণে।
আধুনিক নৌকায় প্রাচীন যাত্রার পুনর্নির্মাণ
জ্যারেট নয় ধরনের নৌকা ব্যবহার করেন, যেগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল এক হাজার বছর আগের ভাইকিং শৈলী অনুসারে। বিশেষ করে তিনি ব্যবহার করেছেন ৩০ ফুট লম্বা ফায়রিঙ্গার নামের নৌকা, যা মৎস্যজীবী ও কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল। এর বিপরীতে, গবেষকরা আগে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন দীর্ঘ লংশিপে, যদিও তা দৈনন্দিন জীবনের প্রকৃত বাস্তবতা বোঝায় না।

জ্যারেট ও তার শিক্ষার্থী-স্বেচ্ছাসেবকরা নরওয়ের পশ্চিম উপকূলে নৌভ্রমণে নেমেছিলেন। তাদের অভিযাত্রায় মুখোমুখি হতে হয়েছে ভয়ংকর স্রোত, ভেঙে যাওয়া মাস্তুল, ১৪ ফুট উচ্চতার ঢেউ, এমনকি ডুবে যাওয়া সাবমেরিন ও এক কৌতূহলী তিমির সঙ্গেও। সবচেয়ে বিপজ্জনক ছিল নরওয়ের পাহাড় থেকে হঠাৎ নেমে আসা ঝোড়ো বাতাস, যাকে স্থানীয়রা ‘ফালভিন্দার’ বলে থাকেন।
বিজ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়
এই বিপজ্জনক যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল বৈজ্ঞানিক জ্ঞান আহরণ। জ্যারেট বিশ্বাস করেন, ভাইকিং যুগ নিয়ে প্রচলিত গবেষণায় বাস্তব নাবিকজীবনের অভিজ্ঞতাকে অবহেলা করা হয়েছে। তাই তিনি সীমিত যন্ত্রপাতি ও প্রাচীন ধাঁচের কাঠের নৌকায় থেকে সমুদ্রযাত্রার বাস্তব অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করেন।
তিনি তার প্রাথমিক ১৭টি অভিযানের ফলাফল প্রকাশ করেছেন জার্নাল অব আর্কিওলজিক্যাল মেথড অ্যান্ড থিওরি-তে। প্রায় ১,৫০০ নটিক্যাল মাইল নৌযাত্রা ও ডিজিটাল মডেলিং একত্র করে তিনি প্রমাণ করেছেন যে ভাইকিংরা শুধু উপকূলভিত্তিক যাত্রাই করতেন না, বরং উন্মুক্ত সমুদ্রেও দীর্ঘ ভ্রমণে সক্ষম ছিলেন।
নতুন বন্দর ও আশ্রয়স্থল আবিষ্কার
গবেষণার সময় জ্যারেট চারটি নতুন আশ্রয়স্থল চিহ্নিত করেন। এগুলো ছোট দ্বীপ ও উপদ্বীপে অবস্থিত ছিল এবং নাবিকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিরতির জায়গা হিসেবে কাজ করত। এসব স্থানে তারা বিশ্রাম নিতে, খাবার সংগ্রহ করতে এবং ঝড় বা শত্রু নৌবহর থেকে আশ্রয় নিতে পারতেন।
তদুপরি, এসব আশ্রয়স্থল চিহ্নিত করার সময় তিনি স্থানীয় মৎস্যজীবীদের কাছ থেকে প্রথাগত নৌপথের তথ্য সংগ্রহ করেন। এরপর প্রতিটি অভিযানের শেষে তিনি মানচিত্র ও ঐতিহাসিক দলিল খুঁজে দেখেন, যা তার গবেষণাকে আরও শক্তিশালী করে।

সমুদ্রপথের পরিবর্তন ও নতুন প্রমাণ
জ্যারেটের গবেষণা আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরে—বরফযুগ শেষে ভূমির উচ্চতা বৃদ্ধি (isostatic rebound)। এর ফলে অনেক নিম্নাঞ্চলীয় দ্বীপ ভাইকিং যুগে সমুদ্রের নিচে ছিল, যা আগে আশ্রয়স্থল হিসেবে ধরা হয়েছিল।
তার পাওয়া চারটি স্থানের মধ্যে কেবল স্টরফসনা দ্বীপে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেছে, যেখানে ভাইকিং যুগের আগের এক জাহাজ সমাধি রয়েছে। তিনি আশা করছেন, ভবিষ্যৎ খননে জেটি, অস্থায়ী আশ্রয়, রান্নাঘরের চিহ্ন এবং নৌকা তৈরির সামগ্রী আবিষ্কৃত হবে।
ভাইকিংদের যাত্রার আসল চিত্র
ভাইকিংদের সমুদ্রযাত্রা কখনো সরল ছিল না; এটি ছিল নৌকা, নাবিক, সমুদ্র ও আবহাওয়ার সঙ্গে এক ক্রমাগত অভিযোজন। গবেষক মর্টেন রাভন বলেন, ভাইকিংরা কখনো শুধু এক পথেই যাত্রা করত না, বরং নানা বিকল্প রাখত।
জ্যারেট মনে করেন, ভাইকিং অভিযানের সাফল্য নির্ভর করত নৌকার দৃঢ়তা ও নাবিকদের ঐক্যের ওপর। তার ভাষায়, ঐতিহ্যবাহী নৌযাত্রার অভিজ্ঞতা আর সহযাত্রীদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি একধরনের “অভিজ্ঞতার সেতু” গড়ে দেয়, যা আমাদের সরাসরি অতীতের নাবিকদের সঙ্গে যুক্ত করে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















