শহরের ফুটপাত কার দখলে
ঢাকার রাস্তাঘাটে হাঁটতে বের হলেই দেখা যায়—ফুটপাতগুলো আসলে পথচারীর জন্য নয়, বরং দোকানপাট ও অস্থায়ী ব্যবসার জন্য। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল এই দখলদারিত্ব কমবে, কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি তেমন বদলায়নি। বরং নতুন ক্ষমতার ভারসাম্যের মধ্যে ফুটপাত নিয়ন্ত্রণে এসেছে কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠীর হাতে।
রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া
ফুটপাত দখল বাণিজ্যের পেছনে সবচেয়ে বড় নিয়ন্ত্রক হলো স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীরা। আগে যেসব দল ক্ষমতায় ছিল তাদের নেতাকর্মীরা দখল নিয়ন্ত্রণ করত, এখন অন্তর্বর্তী সরকারকালেও একই ধারা অব্যাহত আছে। শুধু চরিত্র বদলেছে। স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তি, যাদের ওপর অন্তর্বর্তী সরকারের সরাসরি নজর নেই, তারাই চাঁদা তোলার মাধ্যমে ফুটপাতের প্রতিটি জায়গা নিয়ন্ত্রণ করে।

প্রশাসনিক দুর্বলতা
কাগজে-কলমে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ফুটপাতের মালিক। কিন্তু বাস্তবে তাদের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল। প্রতিদিন ভ্রাম্যমাণ আদালত ফুটপাত খালি করলেও কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবার দোকান বসে যায়। কারণ, প্রশাসনের ভেতরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা নিজেরাই দখল ব্যবসা থেকে মাসিক ভাড়া পান। ফলে আইন প্রয়োগ কেবল আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থাকে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা
পুলিশের উপস্থিতিতেও ফুটপাত দখলকারীরা বেপরোয়া। বিভিন্ন এলাকায় খোলা চোখেই দেখা যায়—পুলিশ সদস্যরা দখলকারীদের কাছ থেকে নিয়মিত টাকা তুলছেন। এতে করে ফুটপাত ব্যবসার মূল নিয়ন্ত্রণ চলে যায় থানা-স্তরের কিছু প্রভাবশালী পুলিশ সদস্যের হাতে। অন্তর্বর্তী সরকার এই অনিয়ম বন্ধের ঘোষণা দিলেও কার্যত কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন হয়নি।

স্থানীয় মাস্তান ও দখলচক্র
রাজনৈতিক ছায়ার বাইরে রয়েছে স্থানীয় মাস্তান ও দখলচক্র। এরা মূলত এলাকায় এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে এবং ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দৈনিক বা সাপ্তাহিক টোল নেয়। অনেক সময় এক ফুটপাতের জায়গা নিয়ে একাধিক দলের মধ্যে সংঘর্ষও হয়। এর ফলে সাধারণ দোকানদাররা দ্বিগুণ-তিনগুণ চাঁদা দিতে বাধ্য হন।
ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট
অস্থায়ী দোকানদাররা একা একা ফুটপাতে বসেন না। তাদের পেছনে থাকে এক ধরনের “ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট”। এরা নতুন দোকান বসাতে চাইলে মোটা অঙ্কের টাকা নেয় এবং নিয়মিত ভাড়া তোলে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কালে এই সিন্ডিকেট আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ
ফুটপাত দখলের কারণে শহরে পথচারীদের জন্য কোনো নিরাপদ জায়গা নেই। বয়স্ক, শিশু, নারী—সবাই বাধ্য হয়ে রাস্তার মূল অংশ দিয়ে চলাচল করে, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে, খোলা জায়গার অভাবে জরুরি সেবার যানবাহন চলাচলেও সমস্যা হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের চ্যালেঞ্জ
অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই দখলদার গোষ্ঠীগুলোর দমন। শুধু ভ্রাম্যমাণ আদালত চালালে সমাধান আসবে না। প্রয়োজন শক্ত রাজনৈতিক ইচ্ছা, স্বচ্ছ আইন প্রয়োগ এবং চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফুটপাত জনগণের জন্য উন্মুক্ত না হলে রাজধানীর যানজট ও দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব নয়।

বাস্তব উদাহরণ: কোন এলাকায় কার নিয়ন্ত্রণ
ঢাকার ফুটপাত দখল বাণিজ্য এলাকায়ভেদে ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর হাতে।
- • গুলিস্তান ও সদরঘাট:এখানে মূল নিয়ন্ত্রণে থাকে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও তাদের ক্যাডাররা। তারা প্রতিটি দোকান থেকে দৈনিক চাঁদা তোলে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ চালায়।
- • ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজার:এই এলাকায় নিয়ন্ত্রণে থাকে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ও বাজার কমিটির প্রভাবশালী সদস্যরা। ফুটপাতের দোকান বসাতে হলে আগে তাদের অনুমতি নিতে হয়।
- • নিউ মার্কেট ও আজিমপুর:এখানে স্থানীয় মাস্তান ও ছাত্র সংগঠনের সাবেক কর্মীরা নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিটি দোকান থেকে তারা সাপ্তাহিক ভাড়া তোলে।
- • মিরপুর ও মোহাম্মদপুর:বিশেষ শক্তির ছত্রচ্ছায়ায় ফুটপাত ব্যবসা চলে। সঙ্গে এক ধরনের সমন্বয়করা এটা নিয়ন্ত্রন করে।
এই সব এলাকায় সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েন। পথচারীরা বাধ্য হয়ে গাড়ির রাস্তা ব্যবহার করে, দুর্ঘটনার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।
ফুটপাত দখল আজ ঢাকার নগরজীবনের এক স্থায়ী সমস্যায় পরিণত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার যদি সত্যিকার অর্থে পরিবর্তন আনতে চায়, তবে শুধু ব্যবসায়ীদের সরানো নয়—যারা এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে, সেই রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, পুলিশ এবং দখলচক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। নচেৎ রাজধানীর ফুটপাত দখল হয়ে থাকবে আগের মতোই, আর ভোগান্তির শিকার হবেন সাধারণ মানুষ।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















