বাংলাদেশে ষাটের দশকের যে ছাত্ররা স্বাধীন দেশ সৃষ্টির অগ্রসেনানী ছিল, স্বাধীনতার পরে তাদের ভেতর বহু বিভক্তি আসে কিন্তু তারা কেউ মৌলবাদের দিকে পা বাড়ায়নি। অন্যদিকে, বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানের আর্টিকেল ৩৮ এর শর্ত অংশে বলা ছিল, সাম্প্রদায়িক, বা ধর্মীয় নাম যুক্ত কোনো সংগঠন করার অধিকার থাকবে না। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার পরে অর্ডিন্যান্স জারির মধ্য দিয়ে সংবিধানের আর্টিকেল ৩৮ এর ওই অংশ বাতিল করা হয়। তারপরে পলিটিক্যাল পার্টি রেগুলেশন অ্যাক্ট ১৯৭৭ এর মাধ্যমে বাংলাদেশে রাজনীতি শুরু হলে- ধর্মীয় নামযুক্ত সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন বা পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনগুলো একে একে রাজনীতিতে ফিরতে শুরু করে। এসময়ে প্রথমে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ হিসেবে জামায়াতে ইসলামী রাজনীতি শুরু করে। তারপরে তারা সরাসরি জামায়াতে ইসলামী নাম নিয়েই রাজনীতি শুরু করে।
রাজনৈতিক অঙ্গনে পাকিস্তানপন্থী এই মৌলবাদী সংগঠনগুলো ফিরে এলেও ছাত্র রাজনীতি, বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের ছাত্র সংগঠনগুলো প্রথমে কোনো প্রকাশ্য রাজনীতি করতে পারেনি। অনেক পরে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশের দুটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে গোপন ও সশস্ত্র অবস্থানকে জোরদার করে। কিন্তু তারপরেও প্রকাশ্য রাজনীতিতে তারা খুব শক্ত অবস্থান কখনই নিতে পারেনি।
কিন্তু ২০২৪ এর জুলাই মাসে প্রথমে চাকরির জন্যে কোটা আন্দোলন, পরে ড. ইউনূসের “ মেটিকুলাস ডিজাইনের” পূর্ণ প্রকাশ ও শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি ও তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ মৌলবাদী ধারার অংশ। এমনকি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সকল প্রগতিশীল আন্দোলনের মূল কেন্দ্র, সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন মৌলবাদী ছাত্রদের দখলে। এমনকি বর্তমানের বামপন্থী ছাত্ররাও তাদের সঙ্গে চমৎকার সহবাস করছে। আশির দশকেও এই বামপন্থীরা ছিল মৌলবাদীদের মূল শত্রু।

বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের একাংশের এই পরিবর্তন কেন হলো, কেন তারা আজ ধর্মীয় মৌলবাদী এবং কেন এখন বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে? বাস্তবে একটা সমাজের এ ধরনের মনোজগতে পরিবর্তন যখন হয় তার জন্য অজস্র কারণ থাকে। যার মধ্যে পারিবারিক শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, সমাজের প্রবাহিত ধারা, সংস্কৃতি অঙ্গনের পরিবর্তন এমনভাবে অসংখ্য কারণ রয়েছে। এগুলো সবই গবেষণার বিষয়।
তবে রাজনৈতিক গতি প্রবাহ বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশের আজ তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে ছাত্রদের ভেতর এই মৌলবাদ শক্তভাবে স্থান নেবার ক্ষেত্রে দুটো বিষয় বেশি ভূমিকা রেখেছে।
মূলত বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও ছাত্র নেতৃত্বের বেশী অংশ গড়ে উঠেছে ছাত্র রাজনীতির ভেতর দিয়ে। পাকিস্তান আমল থেকে ১৯৭৭ অবধি আইনগতভাবে বাংলাদেশের কোনো ছাত্র সংগঠন, কোনো রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন ছিল না। ১৯৭৭ সালে সামরিক শাসকের করা পলিটিকাল পার্টি রেগুলেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী ছাত্র সংগঠনগুলো আইনগতভাবে তাদের আদর্শ অনুযায়ী রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন হয়।
দলের অঙ্গ সংগঠন করার পর থেকেই মূল রাজনৈতিক দলগুলো তাদের স্বার্থে, তাই সেটা দলীয় মূল নেতার বা নেতৃত্বের কোনো একটা গ্রুপের কোটারি স্বার্থে হোক- ছাত্র নেতৃত্ব তৈরির ওপর হস্তক্ষেপ কিছুটা হলেও শুরু হয়।
তবে তারপরেও ১৯৯০ পর্যন্ত মৌলবাদীদের বাইরে অন্য ছাত্র সংগঠনগুলো কিছুটা হলেও স্বাধীনভাবে তাদের নেতৃত্ব তৈরি করতো। সেখানে তাদের মূল দলের একটা হাত থাকলেও সাধারণ ছাত্রদের নেতৃত্ব নির্বাচনে কিছুটা ভূমিকা থাকতো।
তাছাড়া ছাত্র নেতৃত্ব মূলত গড়ে উঠতো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজগুলোর সংসদ নির্বাচনের ভেতর দিয়ে। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত অধিকাংশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারি কলেজ এমনকি বেসরকারি বড় কলেজগুলোতে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো। বাংলাদেশের বেশিভাগ রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ সংসদ নির্বাচনের ভেতর দিয়ে বের হয়ে আসতো।
যারা এই বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ সংসদ নির্বাচন করতো বা নির্বাচিত হতো সকলে যে পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক নেতা হয়েছে তা ঠিক নয়। তবে এর ২০ ভাগ হলেও তারা নিজ নিজ আদর্শের মূল দলের সঙ্গে যোগ দিত। এই তরুণ নেতারা পরবর্তীতে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের স্তর রক্ষা করে ধারাবাহিকভাবে কেন্দ্রিয় থেকে জেলা পর্যায়ে রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করতো।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশে আরেকটি বিষয় ছিল যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে নির্বাচিত হতো, বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করতো- তাদের বেশিভাগ পরবর্তীতে নিজ নিজ আদর্শের দলের কেন্দ্রিয় নেতা হয়েছে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের অবস্থান ছিল প্রান্তিক। বাংলাদেশে তখন মূল ছাত্র রাজনীতির তিনটি ধারা ছিল- বামপন্থী, বাঙালি সংস্কৃতি নির্ভর জাতীয়তাবাদী বা সেন্টার লেফট এবং কিছুটা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী সেন্টার রাইট। সত্যি অর্থে এর মধ্যে দেশব্যাপী বড় ধারা ছিল সংস্কৃতি নির্ভর জাতীয়তাবাদী সেন্টার লেফটরা। এবং আশির দশকের এই বাম ও সেন্টার লেফটরা ছাত্র রাজনীতির অঙ্গন এতটাই দখল করে ফেলছিল যে তৎকালীন সামরিক শাসন এরশাদ ক্ষমতা দখলের পরে রাজনৈতিক সংগঠন করে তার একটি ছাত্র শাখা খোলেন, যার নাম ছিল “নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ”। কিন্তু তিনি পরে বুঝতে পারেন, তার এ শাখা থাকলে মূলত সেন্টার রাইট ছাত্র সংগঠনের বিভক্তি আসবে। আর সে সুযোগে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ সেন্টার লেফট ও তারসঙ্গে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর দখলে চলে যাবে। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার আদর্শের রাজনীতি অর্থাৎ সেন্টার রাইটরা। যে কারণে তিনি তার ছাত্র সংগঠনটি বন্ধ করে দেন। তার ফলও তিনি পান, তাঁর শাসনামলের শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ সেন্টার রাইটদের দখলে যায়, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর অঙ্গ সংগঠন সেন্টার রাইট ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল জয়লাভ করে। এখানে এক অর্থে জেনারেল এরশাদও বিজয়ী হন, কারণ, সেন্টার রাইট ছাত্র সংগঠন নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে বিজয়ী হয়। সেন্টার রাইটরা বিজয়ী হলে পরোক্ষভাবে রাইটিস্ট গ্রুপও সুবিধাজনক অবস্থায় আসে। কারণ, তারা শুধু সেন্টার রাইটদের ভোট দেয় না তাদের ভেতর ছদ্মাবরণে দু একজন নেতাও বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়।
৯০-এ এসে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির এই একটি বড় পরিবর্তন দেখা যায়। যার প্রতিফলন ১৯৯১ এর নির্বাচনেও দেখা যায়। ১৯৯১ এর নির্বাচনের আগে অনেকেই ধারণা করেছিল, সেন্টার লেফট আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়লাভ করবে। কিন্তু শেষ অবধি নির্বাচনে সেন্টার রাইট বিএনপি ও ফান্ডামেন্টালিস্ট বা এক্সট্রিম রাইটিস্ট জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মিলিতভাবে সরকার গঠন করে।
বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির এই পরিবর্তন হবার পরেও সেন্টার লেফট বা বাংলাদেশের সংস্কৃতি নির্ভর জাতীয়তাবাদী শক্তি তাদের ছাত্র সংগঠনগুলোতে কোনো গুণগত পরিবর্তন বা নেতৃত্ব সৃষ্টির দিকে মনোযোগ দেয়নি। বরং তার পরিবর্তে একটা ভিন্ন ধারা শুরু হয়। বাংলাদেশের সেন্টার রাইট বড় দল বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও বাংলাদেশ সেন্টার লেফট বড় দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতৃত্বও তৈরির ক্ষমতা আর ছাত্রদের হাতে থাকে না। এটা মূল দলের দুই নেত্রী বা নেত্রীর বশংবদ নেতারা ঠিক করে দেয়া শুরু করেন।
এখানেই শেষ নয়, ১৯৯১ থেকে বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বড় বড় কলেজ ও সরকারি কলেজগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনও বন্ধ করে রাখা হয়। এমনকি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ (ডাকসু) মূলত বাংলাদেশের কেন্দ্রিয় রাজনৈতিক নেতা তৈরির সূতিকাগার সেই ডাকসু নির্বাচনও বন্ধ করে রাখা হয়। ১৯৯১ থেকে ২০২৪ অবধি বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পালাক্রমে ক্ষমতায় থেকেছে। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া তিনবার ও আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা পাঁচবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু ডাকসু নির্বাচন হয়েছে মাত্র একবার শেখ হাসিনার চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে।

এই ডাকসু নির্বাচন দিতে বিএনপি ও আওয়ামী নেত্রী কেন আগ্রহী ছিলেন না তার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা নেই। তবে বাস্তবতা বলে, দুই নেত্রী ও দুই দল মানসিকভাবে উত্তরাধিকারের রাজনীতিতে বিশ্বাসী হয়ে যায়। এবং শুধুমাত্র কেন্দ্রিয় রাজনীতি বা দুই প্রধান নেত্রী নন, আঞ্চলিক নেতারাও উত্তরাধিকারের রাজনীতিতে বিশ্বাসী হয়ে পড়েন। এবং ১৯৯১ থেকে ২০২৪ অবধি সেটাই ঘটতে থাকে। সংসদ সদস্য মারা গেলে স্ত্রী বা সন্তান মনোনয়ন পেতে সংসদ নির্বাচনে থাকে।
রাজনীতিকে এই পরিবার কেন্দ্রিক রাখা ও নতুন জনপ্রিয় নেতৃত্ব যাতে বেড়ে না ওঠে এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলেরই একটি নীতিগত ঐক্য অলিখিতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। যার ফলে দেশে সব ধরনের ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান বন্ধ থাকে। এবং ছাত্র রাজনীতি তার নিজস্ব স্বাধীনতা হারিয়ে দলীয় নেতৃত্বের অনুগত হয়ে পড়ে। যার ভেতর দিয়ে অনুগতদের উত্থান ঘটতে থাকে সাহসী বীর ও ব্যক্তিত্ববানদের নয়।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে আরেকটি বড় পরিবর্তন হয়। বাংলাদেশে প্রচুর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি চালু হয় ১৯৯১ এর পর থেকে। এই সকল প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতেও কোনো সংসদ নির্বাচন হয় না। এর পাশাপাশি কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটিয়ে কোনো কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ রক্ষার নামে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ রাখা হয়।
বাংলাদেশে এই ছাত্র সংসদ নির্বাচন ৩৩ বছর ধরে এক অর্থে বন্ধ রাখার ফলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক নেতা তৈরির পথ বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশের সকল সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি ও বেসরকারি বড় কলেজ ও বেসরকারি ইউনিভার্সিটিতে যদি ছাত্র সংসদ নির্বাচন থাকতো- আর সেগুলোতে যদি অবাধ নির্বাচন হতো- তাহলে সেখানে সেন্টার লেফট ও সেন্টার রাইটরা বড় দল হিসেবে প্রতি বছর তাদের ভুল ভ্রান্তি সংশোধন করে নেতৃত্ব তৈরির চেষ্টা করতে পারতো পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনুযায়ী।
আর এ ধারা চলতে থাকলে গত মোট ৩৩ বছরে- প্রতি বছর অন্তত কয়েক হাজার বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ সংসদ নেতা বের হতো। তার থেকে যদি সেন্টার লেফট ও সেন্টার রাইট মিলে প্রতি বছর দশ জনও প্রকৃত রাজনীতিক নেতা হতেন তাহলেও ৩৩ বছরে ৩৩০ জন রাজনৈতিক নেতা বের হতেন একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। আর যদি দুই আদর্শে সমান ভাগেও এই নেতৃত্ব তৈরি হতো তাহলেও প্রতিভাগে ১৬০ এর ওপরে প্রকৃত নেতা থাকতো।
৩’শ সংসদীয় আসনের দেশে যদি বড় দুটো দলের ১৫০ জনের ওপরে নেতা একটি প্রকৃত রাজনৈতিক ধারার ভেতর দিয়ে আসে অন্যদিকে বাদবাকী ১৫০ জন স্বাভাবিকই নানা পেশা থেকে সেখানে যোগ দিতে পারে। তাহলে রাজনীতি ও ছাত্র রাজনীতির স্বাভাবিক ধারা থাকতো।

তেত্রিশ বছর ধরে সেটা বন্ধ ছিল। আর এই বন্ধ থাকার ফলে যারা আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ করে- অর্থাৎ ধর্মীয় ফান্ডামেন্টালিস্টরা তারা নীরবে তাদের কাজ করার সুযোগ পেয়েছে। আর যথাপ্রক্রিয়ায় যেহেতু ছাত্র নেতৃত্ব তৈরি হয়নি, আনুগত্য ও অর্থের বিনিময়ে হয়েছে তাই এ সুযোগটিও মৌলবাদীরা নিয়েছে। আনুগত্য দেখানোর বিষয়ে তাদের ট্রেনিং আছে, অন্যদিকে তাদের বৈদেশিক অর্থও আছে। এগুলো ব্যবহার করে তারা ক্ষমতাসীন বা বড় দলের ছাত্র সংগঠনের ছায়ায় থাকতে পেরেছে।
যার ফলে ২০২৪ এর সরকার পতনের পরে দেখা গেল শুধু সরকারে যারা ছিল সেই সেন্টার লেফটদের ছাত্র সংগঠন নয়, ২০২৪ এর সরকার পরিবর্তনের আন্দোলনের অংশ সেন্টার রাইটদের অর্থাৎ বিএনপির ছাত্র সংগঠনও দুর্বল। তাদের জায়গা দখল করে নিয়েছে মৌলবাদী ছাত্র সংগঠনগুলো।
যেকারণে আজ ২০২৪ এর বিজয়ীরা যখন নিজেদেরকে ১৯৭১ এর সমান বা তার থেকে বড় বলে দাবি করছে- তাদের চরিত্রের ও আদর্শের সঙ্গে ১৯৭১ এর বিজয়ী ছাত্রদের কোন মিল নেই। বরং তারা নিজেদেরকে যে ১৯৪৭ এর পাকিস্তান সৃষ্টিকারীদের উত্তরাধিকার বলছে সেটাই তাদের সকল কাজও সেই প্রমাণ দিচ্ছে।
আর এর ফলে স্বাধীনতার ৫৪ বছরে এসে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে এই বড় পরিবর্তন। ১৯৭১ এর বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে যে ছাত্ররা ভ্যানগার্ড ছিল তারা সকলেই ছিল আধুনিক, ইহজাগতিক চেতনার ধারক ও বাহক। অন্যদিকে ২০২৪ এর যে ছাত্ররা বিজয়ের ভ্যানগার্ড বলে দাবি করছে তারা পাকিস্তানি ধারা বা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে যাদের বেশি উপস্থিতি সেই মৌলবাদীদের চেতনার ধারক ও বাহক।
বাংলাদেশে ১৯৭১ থেকে ২০২৪ এর ছাত্রদের এই যে সম্পূর্ণ উল্টো অবস্থান এ দায় তাই বাংলাদেশের সেন্টার লেফট রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতৃত্ব এবং সেন্টার রাইট রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তাদের নেতৃত্বের এড়ানোর সুযোগ নেই। তারা উত্তরাধিকারের রাজনীতি গড়তে গিয়ে শেষ অবধি শিবের জায়গায় বানর গড়ে ফেলেছে। তাদের মনে রাখা উচিত ছিল, তাদের দুটি দলের মূল নেতা কিন্তু বংশ গতি থেকে আসেনি। অথচ তারা নিজের দিকে না তাকিয়ে মরিচিকার পিছে ছুটে ছাত্র রাজনীতিকে মৌলবাদের কোলে তুলে দিয়েছে।
লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.
( এই লেখাটি India Today তে প্রকাশিত লেখার বাংলা অনুবাদ। India Today তে প্রকাশিত লেখার link https://www.indiatoday.in/opinion/story/why-did-students-in-bangladesh-turn-toward-fundamentalism-protests-2024-sheikh-hasina-yunus-mujib-islamist-2775093-2025-08-22

স্বদেশ রায় 


















