টেক্সাসে পরীক্ষামূলক মেঘ বপন
জুলাইয়ের শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-মধ্য টেক্সাসে একটি বেসরকারি স্টার্টআপ ‘রেইনমেকার’ বিমান থেকে দুটি মেঘের ভেতরে ৭০ গ্রাম রুপার আয়োডাইড ছড়িয়ে দেয়। এই প্রযুক্তি, যাকে মেঘ বপন বা ক্লাউড সিডিং বলা হয়, মূলত মেঘ থেকে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বৃষ্টি নামানোর প্রচেষ্টা। রেইনমেকার ভবিষ্যতে বিমান নয়, বরং ড্রোন ব্যবহার করে আরও সাশ্রয়ীভাবে এবং বেশি সংখ্যায় এ ধরনের কাজ করতে চায়।
কিন্তু মাত্র দুই দিন পর টেক্সাসের কের কাউন্টি ভয়াবহ বন্যায় আক্রান্ত হয়। সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে এই বন্যার জন্য রেইনমেকারের প্রযুক্তিই দায়ী। কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা অগাস্টাস ডরিস্কো অভিযোগ করেন, তিনি শারীরিকভাবে হুমকি পেয়েছেন এবং এখন ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী রাখতে হচ্ছে। শুধু রেইনমেকার নয়, ওকলাহোমায় একটি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ রাডারকেও ষড়যন্ত্রের অংশ ভেবে এক সতর্কতামূলক গোষ্ঠী ভাঙচুর করেছে।
বিজ্ঞানীদের মতামত বনাম ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
টেক্সাস এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডল বিজ্ঞানী অ্যান্ড্রু ডেসলার জানান, মেঘ বপন প্রযুক্তি এত ভয়াবহ বন্যার কারণ হতে পারে না। বাস্তবে ওই সময়কার বৃষ্টিপাতের মূল উৎস ছিল ট্রপিক্যাল স্টর্ম ব্যারি থেকে আসা আর্দ্রতা।
তবে ষড়যন্ত্রবাদীরা দীর্ঘদিন ধরেই সরকার, বিমান আর আবহাওয়া পরিবর্তনের যে কোনো সংযোগকে সন্দেহজনক মনে করে আসছে। রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্য মার্জোরি টেইলর গ্রিন এই বিষয়ে সরব হয়েছেন। গত বছর হারিকেন হেলেন নর্থ ক্যারোলাইনায় আঘাত হানার পর তিনি সামাজিক মাধ্যমে লেখেন—“হ্যাঁ, তারা আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে।” এ বছর জুলাইয়ে তিনি “ক্লিয়ার স্কাইস অ্যাক্ট” নামে একটি বিল প্রস্তাব করেছেন, যাতে আবহাওয়া পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে রাসায়নিক ছড়ানোকে ফেডারেল অপরাধ হিসেবে গণ্য করার দাবি করা হয়।

আইন প্রণয়নে নতুন প্রবণতা
এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের ২২টি অঙ্গরাজ্যে মেঘ বপন নিষিদ্ধ বা সীমিত করার প্রস্তাব আনা হয়েছে। ফ্লোরিডায় জুন মাসে আইন পাস হয়েছে, যেখানে আবহাওয়া পরিবর্তনে জড়িত থাকলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জেল হতে পারে। আইন প্রণেতাদের জন্য এটি মূলত ফেডারেল সরকারের বিরোধিতা এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে প্রশ্রয় দেওয়ার একটি সহজ পথ।
অন্যদিকে ইতিহাস বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে মেঘ বপন নতুন কিছু নয়। ১৯৪০-এর দশকে জেনারেল ইলেকট্রিকের গবেষণাগারে এর সূচনা হয়। ১৯৫০-এর দশকে প্রায় ৩০ কোটি একর জমি এভাবে টার্গেট করা হয়েছিল। ২০১৪ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, মেঘ বপন করলে বৃষ্টিপাত গড়ে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। বিশেষ করে পশ্চিমাঞ্চলের কিছু অঙ্গরাজ্যে শীতকালে তুষারপাত বাড়ানোর জন্য এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, যাতে গ্রীষ্মে নদী ও পানির প্রবাহ বাড়ে।
ফেডারেল সরকারের ভূমিকা ও স্থানীয় উদ্যোগ
ফেডারেল সরকার সরাসরি মেঘ বপন চালায় না, তবে নয়টি অঙ্গরাজ্যে সক্রিয় কর্মসূচি রয়েছে। রেইনমেকারের সাম্প্রতিক কাজটি স্থানীয় পানি ব্যবস্থাপনা সংস্থা “সাউথ টেক্সাস ওয়েদার মডিফিকেশন অ্যাসোসিয়েশন”-এর চুক্তির ভিত্তিতে করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন শান্তভাবে চলা এই কার্যক্রম এখন গুজব ও ভুল তথ্যের কারণে বড় সংকটে পড়েছে।
বিজ্ঞানীদের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করা, মামলায় জড়ানো এবং হুমকি দেওয়ার মতো ঘটনা বেড়েছে। এজন্য “ক্লাইমেট সায়েন্স লিগ্যাল ডিফেন্স ফান্ড” আইনি সহায়তা দিচ্ছে।

মেঘ বপন থেকে জিওইঞ্জিনিয়ারিং বিতর্কে
মেঘ বপন নিয়ে বিরোধিতার পেছনে আরও বড় বিষয় হলো জিওইঞ্জিনিয়ারিং—অর্থাৎ পৃথিবীকে সচেতনভাবে ঠান্ডা করার প্রচেষ্টা। এর মধ্যে রয়েছে সূর্যালোক প্রতিরোধে সালফার ডাই অক্সাইডকে বায়ুমণ্ডলের উচ্চ স্তরে ছড়িয়ে দেওয়া।
ফ্লোরিডার নতুন আইন এবং গ্রিনের প্রস্তাবিত বিল শুধু মেঘ বপন নয়, বরং সৌর বিকিরণ নিয়ন্ত্রণ বা ‘সোলার জিওইঞ্জিনিয়ারিং’ গবেষণাকেও নিষিদ্ধ করতে চায়। যদিও এটি অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয়, তবু বিজ্ঞানীরা মনে করেন—ঝুঁকি বোঝার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।
অদ্ভুত হলেও সত্যি—মানবজাতির ভবিষ্যৎ গ্রহ পৃথিবীর আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক সিদ্ধান্ত এখন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও রাজনীতির অদ্ভুত মিশ্রণে গড়ে উঠছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















