বাংলাদেশের জুলাই আন্দোলন পরবর্তী দেশ কেন এই লক্ষ্যহীন যাত্রায়? এমনকি যারা নিজেদের জুলাই আন্দোলনের নেতা বলে দাবি করছে এবং বলছে জুলাইয়ের চেতনা বাস্তবায়ন করতে হবে। তারা কিন্তু বলতে পারছে না, জুলাইয়ের চেতনা কী? কখনও তারা ধর্মীয় মৌলবাদের কোলে গিয়ে উঠছে, কখনও তারা রাষ্ট্র ও স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে একটি আন্দোলনকে বিপ্লব তৈরির ফতোয়া দিচ্ছে যে সকল এক্সট্রিমিস্ট—তাদের কোলে গিয়ে উঠছে।
এর মূল কারণ কোথায়? কেন দেশে এই গোলকধাঁধায় পড়ে গেলো? ড. হোসেন জিল্লুর রহমান দেশের একটি বাংলা পত্রিকা প্রথম আলোর গোল টেবিল বৈঠকে বলেছেন, বর্তমান সরকার “ইনসাফের বদলে প্রতিহিংসা প্রতিস্থাপন করেছে”।
প্রতিহিংসা সমাজে কারা স্থাপন করে এবং কারা স্থাপন করে না। সমাজে কোনো কিছুই শতভাগ হয় না। তাই সবসময়ে দেখতে হয় কতটা সহনীয়ভাবে কাজ করছে। সাধারণত সমাজে এই কাজটা বেশি মাত্রায় সহনীয়ভাবে করে মধ্যবিত্ত সমাজ। মধ্যবিত্ত সমাজ একদিনে হয় না। এর একটা দীর্ঘ সামাজিক ও রাজনৈতিক পথ চলা থাকে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও স্বাধীনতা অর্জন যে মুসলিম তরুণ ও সিনিয়র নেতাদের হাত ধরে হয়েছে তার একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে। অনেকে মোটা দাগে বলেন, পূর্ব বাংলায় হিন্দু মধ্যবিত্তের শাসন থেকে সাধারণ দরিদ্র মুসলমানরা বের হয়ে এসে পাকিস্তান করেছিলো—কথাটা শতভাগ সত্য নয়। পূর্ব বাংলায় হিন্দু মধ্যবিত্তের পাশাপাশি মুসলিম মধ্যবিত্তের একটা ধারাবাহিকতা সব সময়ই ছিলো। কারণ মুসলিম জমিদারই ছিল তিরিশভাগের ওপরে। আর ইংরেজ আমলে আধুনিক শিক্ষার ফলে হিন্দু বুদ্ধিজীবী বা লেখকদের পাশাপাশি কি এস ওয়াজেদ আলী, কাজী ইমদাদুল হক, মীর মশাররফ হোসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, কমরেড মুজাফফর আহমদ, সৈয়দ মুজতবা আলী, এমনকি পূর্ব বাংলাকে বুকে ধারণ করা কবি জসীম উদ্দিন, কবি মোজাম্মেল হক, কবি বন্দে আলী মিয়া প্রমুখ এই বাংলায় ছিলেন না?

আর ১৯৩৭-এ শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক যুক্তবঙ্গের প্রধানমন্ত্রী হবার পরে তার সরকারের আমলে শিক্ষাক্ষেত্রে শামসুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে যে পরিবর্তন আসে তা ছিলো নতুন মুসলিম মধ্যবিত্ত বিকাশের আরেকটি দিগন্ত খুলে দেওয়া। তাছাড়া ফজলুল হক যুক্তবঙ্গের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যে হিন্দু ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি মুসলিম ব্যবসায়ীদের একটি উত্থান ঘটতে সাহায্য করেন। অন্যদিকে তাঁর কৃষক প্রজা পার্টিই এখানে মুসলিম রাজনৈতিক মধ্যবিত্ত গড়ে তোলার পথ সৃষ্টি করে।
কারণ, মধ্যবিত্তের যে গুণটি সবচেয়ে বেশি থাকতে হয়, অর্থাৎ তাকে উদার হতে হয়। কোনো ধর্মীয় সংকীর্ণতার মধ্যে সে ঢোকে না। ধর্ম তার ব্যক্তিজীবনাচরণের অন্য বিষয়গুলোর মতই একটি থাকে। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে সেই ধারাই পূর্ব বাংলার মুসলিম সমাজে বেগবান হয়।
যে কারণে ধর্মের নামে পাকিস্তান হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক শুধু নয় সারা পূর্ব বাংলাব্যাপী শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্ত তরুণ শ্রেণীর মধ্যে ভিন্ন চিন্তার জন্ম নেয়—যা পাকিস্তানের সংকীর্ণ ধর্মীয় চিন্তার সঙ্গে যায় না। এদের সঙ্গে কৃষক প্রজা পার্টির ও মুসলিম লীগের আধুনিক চিন্তার সিনিয়ররা যোগ দেওয়ার পরেই কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে মুসলিম লীগের সংকীর্ণ ও অনুদার চিন্তার বিদায় ঘটে। আর পূর্ব বাংলার এই শিক্ষিত তরুণ শ্রেণিই ধীরে ধীরে স্বাধীনতার পথে এগুতে থাকেন। চল্লিশের তরুণরা একাত্তরে এসে স্বাধীনতার মূল নেতা হন।
এই মধ্যবিত্ত কালচার থেকে নেতা হওয়ার কারণে একাত্তরের স্বাধীনতার পরে তাদের কেউই প্রতিহিংসার রাজনীতিতে যাননি। অথচ মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে প্রতিপক্ষকে হত্যা বা নির্মূল করার যে বৈধতা স্বাধীনতা অর্জনকারী নেতারা পেয়েছিলেন সে বৈধতা ছিলো সীমাহীন। কারণ, লাখ লাখ মানুষকে হত্যা, লাখ লাখ নারীর ইজ্জত লুণ্ঠনকারীর সহযোগীরা তখন তাদের হাতের মুঠোয়। কিন্তু মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত প্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, ওই অপরাধীদের কোনো মবের হাতে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেননি। বরং যে পুলিশ নয় মাস পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছিলো তাদের কাছে আইনত তাদেরকে সোপর্দ করতে বলেন। এবং স্বাধীনতার মূল নেতা দেশে ফেরার পরে বলেছিলেন, “সকলে আমার ভাই, আমি কাকে কী বলবো।” এবং তিনি শুধুমাত্র প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করেন। এমনকি সেদিন আঞ্চলিকভাবেও কেন্দ্রীয় নেতা শেখ আব্দুল আজিজের বক্তব্য শুনেছি ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে খুলনায়—তিনি বলেন, অনেকে গত নয় মাসে অনেক খারাপ কিছু আপনাদের ওপর করেছে। ছোটখাট ভুলগুলো ভুলে যান। বড় অপরাধের আইনত বিচার হবে।
স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী ওই মধ্যবিত্তের দেশ ও মানুষের প্রতি এই সহমর্মিতা ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি শ্রদ্ধা যেমন ছিলো তেমনি তাদের ভেতর ছিলো মূল মধ্যবিত্ত চরিত্র অর্থাৎ উদারনৈতিক শিক্ষায় তারা সকলে শিক্ষিত, তাদের চিন্তাচেতনা কোনো বিশেষ দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিলো না।
কিন্তু ২০২৪-এ জুলাইয়ের আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের পরে ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের ভাষায় শুধু ন্যায়ের স্থানে প্রতিহিংসাকে স্থাপন করা হয়নি—দেখা গেলো চিন্তার সংকীর্ণতা। এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপরে মব ভায়োলেন্সকে স্থান দেওয়া।
আর এই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর মব ভায়োলেন্সকারীদের স্থান দেওয়ার ফলে রাষ্ট্র পরিচালনার কেন্দ্র থেকে মূলত মধ্যবিত্ত নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে না হয় সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। কারণ, মধ্যবিত্ত কালচারের সঙ্গে কখনও মব ভায়োলেন্স যায় না। মব ভায়োলেন্স সব সময়ই সমাজের নিম্নবর্গীয়দের কাজ। মব ভায়োলেন্স সমর্থনও করে সব সময় সমাজের নিম্নবর্গীয় চিন্তাচেতনার মানুষরা। কারণ, মধ্যবিত্ত সব সময়ই ইনক্লুসিভ, এবং একটি নিয়মতান্ত্রিক পারিবারিক শিক্ষা কাঠামোর মধ্য দিয়ে তারা বের হয়ে আসে।
আর যে কোনো রাষ্ট্রে মধ্যবিত্তকে ভেঙে ফেলার অর্থই হলো মূলত রাষ্ট্র কাঠামোকে আঘাত করা।
যেমন ১৯৯১-এর পর থেকে বাংলাদেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল এ দেশে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটি করেছে তারা বুদ্ধিবৃত্তিকে স্বাধীনভাবে বাড়তে না দিয়ে অনেকটা কমিউনিস্টদের মতো নিজ নিজ রাজনৈতিক চিন্তার অনুকূলে বেড়ে ওঠার পক্ষে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। তারপরেও দুটি বড় রাজনৈতিক দলে দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব থাকায় দেশের সার্বিক মধ্যবিত্তকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর কাছ থেকে দূরে ফেলে দেওয়া সম্ভব হয়নি।
এর বিপরীতে যারা মব ভায়োলেন্সের নেতৃত্ব দিচ্ছে ও যে গোষ্ঠী তথাকথিত ধর্মীয় সংকীর্ণতায় আবদ্ধ তাদেরকে গুরুত্ব দিচ্ছে বর্তমান সরকার। এক কাতারে বসাচ্ছে দেশে বর্তমানে একটি বড় ও ছোট ছোট দু-একটি যে মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক সংগঠন আছে তাদের সঙ্গে মব ভায়োলেন্সকারীদের এবং গুরুত্ব পাচ্ছে ওই মব নেতারা। যার ফলে রাজনীতি ও রাষ্ট্রের কাছে যেতে মধ্যবিত্ত দ্বিধাগ্রস্ত শুধু নয়, শঙ্কিত হয়ে উঠছে। মধ্যবিত্তের এই এক বছরের দ্বিধা ও সংকোচনের ফলে সমাজে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসে গেছে ইতোমধ্যে।
অর্থাৎ মানুষ শুধু মবের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে না, মবের চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে না, মবের কারণে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে না—মব সৃষ্টিকারীরা যে পরিবেশ থেকে উঠে আসে ওই পরিবেশের ভাষা এখন শিক্ষাঙ্গনে, রাজনৈতিক অঙ্গনের স্লোগান শুধু নয় বক্তব্যের ভাষা হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। অর্থাৎ সমাজের একটি ভয়াবহ কালচার হিসেবে তারা আত্মপ্রকাশ করছে।
এরা যদি এইভাবে শিক্ষাঙ্গন, সমাজ ও রাষ্ট্রকে ডমিনেট করে তাহলে মধ্যবিত্ত নতুনভাবে ভাবতে শুরু করতে বাধ্য হবে। এমনিতে সুশাসনের অভাবে মধ্যবিত্তের ভেতর দেশ ছাড়ার একটা ট্রেন্ড আগে থেকেই বহমান আছে। আর তার পরে যদি শিক্ষাঙ্গন, রাজনীতি ও রাষ্ট্রে এই মব কালচার ডমিনেট করে, তাহলে মধ্যবিত্ত শুধু নয়—নিম্ন মধ্যবিত্তও তাদের সন্তানের শিক্ষার স্থান নিয়ে সংকটে পড়ে যাবে। তারা বিকল্প খোঁজার চেষ্টা করবে।
আর একটা রাষ্ট্রে যখন মধ্যবিত্ত শঙ্কিত, সংকুচিত শুধু হয় না—রাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করে সে সময় ওই রাষ্ট্র কাদের অধীনে চলে যায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আফগানিস্তান, পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত চলে গেছেই বলা যায়। এমনকি আফগানিস্তান থেকে নিম্নমধ্যবিত্তরাও চলে যাচ্ছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আফগানিস্তানের একটি নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরের তরুণ সাংবাদিক ওমিদ আবদুল্লাহ’র সঙ্গে পরিচয় হয় আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর (তালেবান আসার আগের সরকারের মন্ত্রী ছিল) মাধ্যমে। তরুণটি বেশ উদ্যমী, বিনয়ী ও শিক্ষিত। তালেবান ক্ষমতায় আসার পরে অন্য বন্ধুদের খবর নেওয়ার পাশাপাশি তারও খবর নিয়মিতই নিতাম (যেমন এখন আমাদের নিয়মিত খবর নেয় তারা)। কারণ, তার মাধ্যমে তালেবান ও আফগানদের বাস্তব অবস্থা জানতে পারতাম। প্রথম দিকে ওমিদ সেখানে টিকে থাকার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু এক পর্যায়ে একদিন সে তালেবান মবের হাতে নিগৃহীত হয়। তার পরে সে পাকিস্তান সীমান্তে চলে আসে। এর পরে পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে ভারত হয়ে এখন কানাডায় খুব কষ্টে জীবনযাপন করছে। তবুও আফগানিস্তান নিয়ে তার কোনো আশা নেই।
গত কয়েকদিনে বিএনপির কয়েক নেতা ও নেত্রীকে মবের নেতা ও তাদের মহিলা কর্মীদের যে ভাষা ও ভায়োলেন্সের শিকার হতে দেখলাম—এর পরে এখন সত্যিই ভাবার সময় এসে গেছে—আওয়ামী লীগের কথা বলে দেশের বড় একটি অংশ মধ্যবিত্তের গায়ে নানান ট্যাগ দিয়ে তাদেরকে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে উইথড্র করার পথ তৈরি করা হয়েছে আগে—এখন বিএনপির মধ্যবিত্তদের ওপর চড়াও হচ্ছে। এর পরে স্বাভাবিকভাবেই এই চাপ আসবে সাধারণ মধ্যবিত্তের ওপর। কারণ এখানে মূল শত্রু তো কালচার।
তাই এখনই যদি মধ্যবিত্ত ধ্বংসের এই প্রক্রিয়া না ঠেকানো হয়—তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ কোথায় যাবে তা মনে হয় বলার অপেক্ষা রাখে না। রোমান সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে অনেক ছোট রাষ্ট্রে মধ্যবিত্ত ধ্বংস হওয়ার ফলে কী হয়েছিলো তাদের সভ্যতার—সে ইতিহাস সকলে জানেন।
অন্যদিকে মোগলরা কিন্তু এই ভারতবর্ষ শত শত বছর শাসন করে গেছে ভারতীয় মধ্যবিত্তের ওপর ভর করে। আওরঙ্গজেবেরও প্রধান সেনাপতি ছিলেন রাজপুত রাণা বংশীয় যশোবন্ত সিং। আওরঙ্গজেব জানতেন, রাষ্ট্র কাদের দ্বারা পরিচালিত করতে হয়। তাই মধ্যবিত্ত ও রাষ্ট্রপরিচালক গোষ্ঠী যারা আওরঙ্গজেবের আমলে রাণা বা রাজা ছিলেন, এখন আধুনিক রাষ্ট্রেই ওই শ্রেণীই মধ্যবিত্ত রাজনীতিবিদ– তাদেরকে ও সাধারণ মধ্যবিত্তকে ভেঙে ফেললে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কী তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.

স্বদেশ রায় 


















