১১:৫৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫
সাবেক জাপানি প্রধানমন্ত্রীর হত্যার তিন বছর পর শুরু বহুল আলোচিত বিচার—‘আমি করেছি’, আদালতে স্বীকারোক্তি চীনা খনির বিষাক্ত বর্জ্যে বিপর্যস্ত জাম্বিয়া নিয়া দা কস্তার ১৯৫০-এর প্রেক্ষাপটে নির্মিত আধুনিক ‘হেডা’—টেসা থম্পসনের অভিনয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে মানুষও এখন এআই ব্যবহার করে রান্না, ভ্রমণ ও স্বাস্থ্যপরামর্শে দক্ষতা অর্জন করছে মার্কিন কংগ্রেসম্যান চার্লস ডিগস—অসাধারণ রাজনৈতিক জীবনের শেষ পরিণতি কেলেঙ্কারিতে নকিয়ার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে এনভিডিয়া পরিবর্তনের পথে কেএফসি—হারানো বাজার ফিরে পেতে নতুন রেসিপির সন্ধান যুক্তরাষ্ট্র–চীন সম্পর্কের নতুন অধ্যায়, লি জে মিয়ংয়ের কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ—জাপানের তাকাইচির অংশগ্রহণে আঞ্চলিক শক্তির নতুন সমীকরণ নেদারল্যান্ডস–চীন বিরোধের প্রভাব গাড়ি শিল্পে—যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিমুখী কেন্দ্র সেলায়া কারখানায় কার্যক্রম স্থগিত মৃত্যু’ নিয়ে গুজব, শেখ হাসিনা বললেন-‘সুস্থ আছি, আমার তো দেশকে উদ্ধার করতে হবে

পানিই এখন সোনালী আঁশের সংকট

বাংলাদেশে পাটচাষ একসময় অর্থনীতির প্রাণশক্তি ছিল। এই ফসলকে বলা হতো “সোনালী আঁশ”, যা বিদেশি মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান উৎস ছিল। আজও পাট বাংলাদেশের কৃষক সমাজের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পানির সংকট পাটচাষকে বড় ধরনের হুমকির মুখে ফেলেছে। সেচের অভাব, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, নদী-নালা ও খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়া, জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া—সব মিলিয়ে কৃষকেরা চরম বিপাকে পড়ছেন।

বীজ বপনে প্রাথমিক সমস্যা

পাটের বীজ সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে বপন করা হয়। এই সময়ে যদি পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হয়, তবে জমিতে আর্দ্রতার অভাবে বীজ অঙ্কুরোদ্গমে ব্যর্থ হয়। অনেক কৃষক বাধ্য হয়ে বারবার বীজ বপন করেন, এতে খরচ বেড়ে যায়। খরার কারণে মাঠে জমাট বাঁধা মাটি নরম হয় না, ফলে চাষাবাদে সমস্যা তৈরি হয়। বিশেষ করে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে খরাপ্রবণ এলাকায় এই সমস্যা তীব্র। আগে যেখানে আষাঢ় মাসের শুরুতেই বৃষ্টি হতো, এখন অনিয়মিত বৃষ্টির কারণে কৃষকদের বপন মৌসুমেই অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

কৃষকের হাতে পাট বীজ সত্তা সংরক্ষণে কাজ করছে শরীয়তপুর কৃষি বিভাগ | জাতীয় | বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)

গাছের বৃদ্ধিতে সেচের বাধা

চারা গজানোর পর গাছের বৃদ্ধি ও পুষ্টির জন্য নিয়মিত পানি প্রয়োজন। টানা কয়েক সপ্তাহ বৃষ্টি না হলে কৃষকদের সেচ দিতে হয়। কিন্তু এ সেচ এখন কৃষকের জন্য অনেক ব্যয়বহুল। গভীর নলকূপ বা বিদ্যুৎচালিত পাম্প ব্যবহার করে সেচ দিতে হলে প্রচুর খরচ হয়। অন্যদিকে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অনেকে যথেষ্ট পানি তুলতে পারেন না। ফলে পাটগাছ শুকিয়ে যায় বা আকারে ছোট হয়ে থাকে। কম উচ্চতার গাছ থেকে আঁশও কম পাওয়া যায়, এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ উঠে আসে না।

কাটার পর রেটিংয়ের বড় সংকট

পাটচাষে পানির সংকট সবচেয়ে প্রকট হয় গাছ কাটার পর। আঁশ আলাদা করার জন্য গাছগুলোকে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়, যাকে রেটিং বলা হয়। আগে গ্রামের খাল, বিল, নদী বা পুকুরে কৃষকেরা সহজেই এ কাজ করতেন। কিন্তু আজ নদী শুকিয়ে যাওয়া, বিল ভরাট হওয়া এবং জলাশয় দখলের কারণে উপযুক্ত জায়গা পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। ফলে কৃষকেরা বাধ্য হয়ে ছোট জলাশয়ে গাদাগাদি করে পাট ভিজিয়ে রাখেন। এতে আঁশ কালচে হয়ে যায়, গুণগত মান নষ্ট হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় কৃষকেরা কম দামে পাট বিক্রি করতে বাধ্য হন।

গুণগত মান ও বাজারে প্রভাব

পাটের আন্তর্জাতিক বাজার অনেকটা নির্ভর করে আঁশের গুণমানের ওপর। পরিষ্কার, উজ্জ্বল ও শক্ত আঁশ বিদেশে বেশি দামে বিক্রি হয়। কিন্তু অপর্যাপ্ত পানিতে বা দূষিত পানিতে রেটিং করলে আঁশ শক্ত হয়ে যায়, রঙ ম্লান হয়। এর ফলে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের পাটের গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। ভারত বা নেপালের মতো দেশগুলো তখন প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যায়। এতে বাংলাদেশের পাট রপ্তানি আয় কমে যাচ্ছে, যা জাতীয় অর্থনীতির জন্যও ক্ষতিকর।

সোনালী আঁশ হতে চলেছে কৃষকদের গলার ফাঁস

কৃষকের অর্থনৈতিক ক্ষতি

পানির সংকট সরাসরি কৃষকের জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

  • • প্রথমত, জমিতে বারবার বীজ বপন ও সেচের কারণে খরচ বেড়ে যায়।
  • • দ্বিতীয়ত, উৎপাদন কম হওয়ায় আয় কমে যায়।
  • • তৃতীয়ত, রেটিংয়ের জন্য অনেক সময় অন্যের পুকুর ভাড়া নিতে হয়, এতে খরচ আরও বাড়ে।
  • • চতুর্থত, আঁশের গুণমান খারাপ হলে বাজারে সঠিক দাম পাওয়া যায় না।

ফলে অনেক কৃষক পাটচাষ ছেড়ে দিয়ে বিকল্প ফসলের দিকে ঝুঁকছেন। কিন্তু বিকল্প ফসল থেকেও তাঁরা আগের মতো লাভবান হচ্ছেন না। এর ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে।

সামাজিক প্রভাব

পাটচাষের সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য পরিবার এখন নতুন সংকটে পড়েছে। একসময় পাটকেন্দ্রিক গ্রামীণ অর্থনীতি কৃষকের ঘরে সমৃদ্ধি বয়ে আনত। এখন পানির সংকটের কারণে এই পরিবারগুলো দারিদ্র্যের মুখে পড়ছে। চাষাবাদের ক্ষতি হলে তারা ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছে। আবার অনেকে গ্রাম ছেড়ে শহরে শ্রমজীবী কাজে নামতে বাধ্য হচ্ছে। এর ফলে গ্রামীণ সমাজের ঐতিহ্য ও ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

বিশ্বের যে ২৫ দেশ চরম পানি সংকটে

পরিবেশ ও জলবায়ুর প্রভাব

পানির সংকট শুধু স্থানীয় কোনো সমস্যা নয়; এর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ ধ্বংস গভীরভাবে জড়িত। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, দীর্ঘ খরা মৌসুম, নদীর প্রবাহ হ্রাস, জলাশয় ভরাট এবং অতিরিক্ত নলকূপ ব্যবহার পানির প্রাপ্যতা কমাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ হতে পারে। একই সঙ্গে নদী ও খালের প্রাকৃতিক প্রবাহ কমে যাওয়ায় জেলেদের জীবিকাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থাৎ পানির সংকট একটি বহুমাত্রিক সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করছে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বর্তমান পরিস্থিতি

একসময় বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে খাল-বিল ও নদীতে সারা বছর পানি থাকত। কৃষকেরা সহজেই পাটের রেটিং করতেন। গ্রামবাংলার গান ও লোকসংস্কৃতিতেও পাটচাষ ও আঁশ ছাড়ানোর বর্ণনা পাওয়া যায়। কিন্তু আধুনিক উন্নয়ন, নগরায়ণ ও জমি দখলের কারণে সেই জলাশয়গুলো ভরাট হয়ে গেছে। বর্তমানে বিশেষ করে উত্তরাঞ্চল, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও মাদারীপুরের মতো পাটসমৃদ্ধ অঞ্চলে এই সংকট বেশি দেখা যাচ্ছে।

সমাধানের উপায়

১. জলাশয় সংরক্ষণ ও খাল খনন: প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো রক্ষা করতে হবে। দখল হয়ে যাওয়া খাল-বিল পুনরুদ্ধার করতে হবে। নিয়মিত খনন ও সংস্কারের মাধ্যমে পানির প্রবাহ সচল রাখতে হবে।

২. কৃত্রিম জলাধার নির্মাণ: গ্রামীণ এলাকায় রেটিংয়ের জন্য বড় বড় জলাধার তৈরি করা যেতে পারে। এতে কৃষকেরা সহজে আঁশ ছাড়াতে পারবেন।
৩. আধুনিক প্রযুক্তি: কম পানি ব্যবহার করে রেটিং করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা দরকার। ইতিমধ্যে গবেষণার মাধ্যমে বিকল্প পদ্ধতি বের করার চেষ্টা চলছে।
৪. খরা-সহনশীল জাত: বিজ্ঞানীরা কম পানি সহনশীল নতুন জাতের পাট উদ্ভাবন করতে পারেন। এতে ভবিষ্যতে পানি সংকটেও ফসল রক্ষা করা সম্ভব হবে।
৫. কৃষক প্রশিক্ষণ: কৃষকদের পানি সাশ্রয়ী সেচব্যবস্থা ও আধুনিক রেটিং পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি।

সরকারের ভূমিকা

সরকার যদি সময়মতো পদক্ষেপ নেয়, তবে পানির সংকট অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। কৃষি মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের যৌথ উদ্যোগে জলাশয় সংরক্ষণ, খাল খনন ও সেচ প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে কৃষকদের জন্য সুলভ মূল্যে সেচ সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে। পাটের আন্তর্জাতিক বাজার ধরে রাখতে হলে উচ্চমানসম্পন্ন আঁশ উৎপাদন অপরিহার্য, আর এর জন্য পর্যাপ্ত পানি নিশ্চিত করতেই হবে।

বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনে পাট শুধু একটি ফসল নয়; এটি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও অর্থনীতির প্রতীক। কিন্তু পানির সংকট এ ঐতিহ্যকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে সোনালী আঁশের ইতিহাস কেবল পাঠ্যবইয়ে সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে। তাই জলাশয় সংরক্ষণ, পানি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং কৃষি গবেষণার প্রসারের মাধ্যমে এ সংকট মোকাবিলা করা জরুরি। কৃষকেরা যদি আবারও পানির নিশ্চয়তা পান, তবে পাটচাষ তার পুরনো গৌরব ফিরে পেতে সক্ষম হবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

সাবেক জাপানি প্রধানমন্ত্রীর হত্যার তিন বছর পর শুরু বহুল আলোচিত বিচার—‘আমি করেছি’, আদালতে স্বীকারোক্তি

পানিই এখন সোনালী আঁশের সংকট

০৫:২৩:১৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ অগাস্ট ২০২৫

বাংলাদেশে পাটচাষ একসময় অর্থনীতির প্রাণশক্তি ছিল। এই ফসলকে বলা হতো “সোনালী আঁশ”, যা বিদেশি মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান উৎস ছিল। আজও পাট বাংলাদেশের কৃষক সমাজের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পানির সংকট পাটচাষকে বড় ধরনের হুমকির মুখে ফেলেছে। সেচের অভাব, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, নদী-নালা ও খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়া, জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া—সব মিলিয়ে কৃষকেরা চরম বিপাকে পড়ছেন।

বীজ বপনে প্রাথমিক সমস্যা

পাটের বীজ সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে বপন করা হয়। এই সময়ে যদি পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হয়, তবে জমিতে আর্দ্রতার অভাবে বীজ অঙ্কুরোদ্গমে ব্যর্থ হয়। অনেক কৃষক বাধ্য হয়ে বারবার বীজ বপন করেন, এতে খরচ বেড়ে যায়। খরার কারণে মাঠে জমাট বাঁধা মাটি নরম হয় না, ফলে চাষাবাদে সমস্যা তৈরি হয়। বিশেষ করে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে খরাপ্রবণ এলাকায় এই সমস্যা তীব্র। আগে যেখানে আষাঢ় মাসের শুরুতেই বৃষ্টি হতো, এখন অনিয়মিত বৃষ্টির কারণে কৃষকদের বপন মৌসুমেই অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

কৃষকের হাতে পাট বীজ সত্তা সংরক্ষণে কাজ করছে শরীয়তপুর কৃষি বিভাগ | জাতীয় | বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)

গাছের বৃদ্ধিতে সেচের বাধা

চারা গজানোর পর গাছের বৃদ্ধি ও পুষ্টির জন্য নিয়মিত পানি প্রয়োজন। টানা কয়েক সপ্তাহ বৃষ্টি না হলে কৃষকদের সেচ দিতে হয়। কিন্তু এ সেচ এখন কৃষকের জন্য অনেক ব্যয়বহুল। গভীর নলকূপ বা বিদ্যুৎচালিত পাম্প ব্যবহার করে সেচ দিতে হলে প্রচুর খরচ হয়। অন্যদিকে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অনেকে যথেষ্ট পানি তুলতে পারেন না। ফলে পাটগাছ শুকিয়ে যায় বা আকারে ছোট হয়ে থাকে। কম উচ্চতার গাছ থেকে আঁশও কম পাওয়া যায়, এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ উঠে আসে না।

কাটার পর রেটিংয়ের বড় সংকট

পাটচাষে পানির সংকট সবচেয়ে প্রকট হয় গাছ কাটার পর। আঁশ আলাদা করার জন্য গাছগুলোকে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়, যাকে রেটিং বলা হয়। আগে গ্রামের খাল, বিল, নদী বা পুকুরে কৃষকেরা সহজেই এ কাজ করতেন। কিন্তু আজ নদী শুকিয়ে যাওয়া, বিল ভরাট হওয়া এবং জলাশয় দখলের কারণে উপযুক্ত জায়গা পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। ফলে কৃষকেরা বাধ্য হয়ে ছোট জলাশয়ে গাদাগাদি করে পাট ভিজিয়ে রাখেন। এতে আঁশ কালচে হয়ে যায়, গুণগত মান নষ্ট হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় কৃষকেরা কম দামে পাট বিক্রি করতে বাধ্য হন।

গুণগত মান ও বাজারে প্রভাব

পাটের আন্তর্জাতিক বাজার অনেকটা নির্ভর করে আঁশের গুণমানের ওপর। পরিষ্কার, উজ্জ্বল ও শক্ত আঁশ বিদেশে বেশি দামে বিক্রি হয়। কিন্তু অপর্যাপ্ত পানিতে বা দূষিত পানিতে রেটিং করলে আঁশ শক্ত হয়ে যায়, রঙ ম্লান হয়। এর ফলে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের পাটের গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। ভারত বা নেপালের মতো দেশগুলো তখন প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যায়। এতে বাংলাদেশের পাট রপ্তানি আয় কমে যাচ্ছে, যা জাতীয় অর্থনীতির জন্যও ক্ষতিকর।

সোনালী আঁশ হতে চলেছে কৃষকদের গলার ফাঁস

কৃষকের অর্থনৈতিক ক্ষতি

পানির সংকট সরাসরি কৃষকের জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

  • • প্রথমত, জমিতে বারবার বীজ বপন ও সেচের কারণে খরচ বেড়ে যায়।
  • • দ্বিতীয়ত, উৎপাদন কম হওয়ায় আয় কমে যায়।
  • • তৃতীয়ত, রেটিংয়ের জন্য অনেক সময় অন্যের পুকুর ভাড়া নিতে হয়, এতে খরচ আরও বাড়ে।
  • • চতুর্থত, আঁশের গুণমান খারাপ হলে বাজারে সঠিক দাম পাওয়া যায় না।

ফলে অনেক কৃষক পাটচাষ ছেড়ে দিয়ে বিকল্প ফসলের দিকে ঝুঁকছেন। কিন্তু বিকল্প ফসল থেকেও তাঁরা আগের মতো লাভবান হচ্ছেন না। এর ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে।

সামাজিক প্রভাব

পাটচাষের সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য পরিবার এখন নতুন সংকটে পড়েছে। একসময় পাটকেন্দ্রিক গ্রামীণ অর্থনীতি কৃষকের ঘরে সমৃদ্ধি বয়ে আনত। এখন পানির সংকটের কারণে এই পরিবারগুলো দারিদ্র্যের মুখে পড়ছে। চাষাবাদের ক্ষতি হলে তারা ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছে। আবার অনেকে গ্রাম ছেড়ে শহরে শ্রমজীবী কাজে নামতে বাধ্য হচ্ছে। এর ফলে গ্রামীণ সমাজের ঐতিহ্য ও ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

বিশ্বের যে ২৫ দেশ চরম পানি সংকটে

পরিবেশ ও জলবায়ুর প্রভাব

পানির সংকট শুধু স্থানীয় কোনো সমস্যা নয়; এর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ ধ্বংস গভীরভাবে জড়িত। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, দীর্ঘ খরা মৌসুম, নদীর প্রবাহ হ্রাস, জলাশয় ভরাট এবং অতিরিক্ত নলকূপ ব্যবহার পানির প্রাপ্যতা কমাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ হতে পারে। একই সঙ্গে নদী ও খালের প্রাকৃতিক প্রবাহ কমে যাওয়ায় জেলেদের জীবিকাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থাৎ পানির সংকট একটি বহুমাত্রিক সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করছে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বর্তমান পরিস্থিতি

একসময় বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে খাল-বিল ও নদীতে সারা বছর পানি থাকত। কৃষকেরা সহজেই পাটের রেটিং করতেন। গ্রামবাংলার গান ও লোকসংস্কৃতিতেও পাটচাষ ও আঁশ ছাড়ানোর বর্ণনা পাওয়া যায়। কিন্তু আধুনিক উন্নয়ন, নগরায়ণ ও জমি দখলের কারণে সেই জলাশয়গুলো ভরাট হয়ে গেছে। বর্তমানে বিশেষ করে উত্তরাঞ্চল, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও মাদারীপুরের মতো পাটসমৃদ্ধ অঞ্চলে এই সংকট বেশি দেখা যাচ্ছে।

সমাধানের উপায়

১. জলাশয় সংরক্ষণ ও খাল খনন: প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো রক্ষা করতে হবে। দখল হয়ে যাওয়া খাল-বিল পুনরুদ্ধার করতে হবে। নিয়মিত খনন ও সংস্কারের মাধ্যমে পানির প্রবাহ সচল রাখতে হবে।

২. কৃত্রিম জলাধার নির্মাণ: গ্রামীণ এলাকায় রেটিংয়ের জন্য বড় বড় জলাধার তৈরি করা যেতে পারে। এতে কৃষকেরা সহজে আঁশ ছাড়াতে পারবেন।
৩. আধুনিক প্রযুক্তি: কম পানি ব্যবহার করে রেটিং করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা দরকার। ইতিমধ্যে গবেষণার মাধ্যমে বিকল্প পদ্ধতি বের করার চেষ্টা চলছে।
৪. খরা-সহনশীল জাত: বিজ্ঞানীরা কম পানি সহনশীল নতুন জাতের পাট উদ্ভাবন করতে পারেন। এতে ভবিষ্যতে পানি সংকটেও ফসল রক্ষা করা সম্ভব হবে।
৫. কৃষক প্রশিক্ষণ: কৃষকদের পানি সাশ্রয়ী সেচব্যবস্থা ও আধুনিক রেটিং পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি।

সরকারের ভূমিকা

সরকার যদি সময়মতো পদক্ষেপ নেয়, তবে পানির সংকট অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। কৃষি মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের যৌথ উদ্যোগে জলাশয় সংরক্ষণ, খাল খনন ও সেচ প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে কৃষকদের জন্য সুলভ মূল্যে সেচ সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে। পাটের আন্তর্জাতিক বাজার ধরে রাখতে হলে উচ্চমানসম্পন্ন আঁশ উৎপাদন অপরিহার্য, আর এর জন্য পর্যাপ্ত পানি নিশ্চিত করতেই হবে।

বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনে পাট শুধু একটি ফসল নয়; এটি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও অর্থনীতির প্রতীক। কিন্তু পানির সংকট এ ঐতিহ্যকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে সোনালী আঁশের ইতিহাস কেবল পাঠ্যবইয়ে সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে। তাই জলাশয় সংরক্ষণ, পানি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং কৃষি গবেষণার প্রসারের মাধ্যমে এ সংকট মোকাবিলা করা জরুরি। কৃষকেরা যদি আবারও পানির নিশ্চয়তা পান, তবে পাটচাষ তার পুরনো গৌরব ফিরে পেতে সক্ষম হবে।