আলাস্কায় ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক ও অঘোষিত পরিকল্পনা
আলাস্কায় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের পর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জানান, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া আরও বেশি ব্যবসায়িক সুযোগ তৈরি করতে পারে, বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগরের দুই উপকূলের মধ্যে। ট্রাম্পও ইতিবাচক সুরে বলেছিলেন, “আমরা চুক্তির অপেক্ষায় আছি।”
কিন্তু তাদের প্রকাশ্য মন্তব্যের বাইরে, গোপনে দুই দেশের সবচেয়ে বড় জ্বালানি কোম্পানিগুলো ইতিমধ্যেই রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যের উপকূলে আবার তেল-গ্যাস উত্তোলনের নকশা আঁকতে শুরু করেছে।
সাখালিন প্রকল্পে ফেরার আলোচনা
২০২৫ সালের শুরুতে এক্সন মোবিলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নিল চ্যাপম্যান রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় কোম্পানি রসনেফতের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। তিনি সাখালিন-১ প্রকল্পে ফেরার বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। তবে এ উদ্যোগ তখনই বাস্তবায়িত হবে, যদি ইউক্রেন যুদ্ধ শান্তি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দুই সরকার থেকে অনুমোদন মেলে। এতটাই সংবেদনশীল ছিল বিষয়টি যে, এক্সনের ভেতরে কেবল অল্প কিছু কর্মকর্তা এ বিষয়ে জানতেন।
বাইডেন ও ট্রাম্প প্রশাসন—উভয় সময়েই এক্সনকে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট বিশেষ অনুমতি দিয়েছিল রাশিয়ার সঙ্গে এ ধরনের আটকে থাকা সম্পদ নিয়ে আলোচনা করার। এক্সনের রাশিয়া ছাড়ার (২০২২) পরপরই প্রথম দফা আলোচনা হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সমর্থন চাইছে এক্সন
একইসঙ্গে এক্সনের কর্মকর্তারা ওয়াশিংটনের কাছ থেকে সমর্থন চেয়েছেন, যদি তারা রাশিয়ায় ফের ব্যবসা শুরু করতে চান। হোয়াইট হাউসে সাম্প্রতিক বৈঠকে এক্সনের সিইও ড্যারেন উডস ট্রাম্পের সঙ্গে সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে আলোচনা করেন।
সম্পর্কচ্ছেদ থেকে পুনঃসংযোগ
রাশিয়ায় ব্যবসা আবার শুরু করা মানে হবে ২০২২ সালের তিক্ত বিচ্ছেদের পর নাটকীয় পুনর্মিলন। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর এক্সন রাশিয়ার জ্বালানি খাতে সবচেয়ে গভীরভাবে প্রবেশ করেছিল। ইউক্রেন আক্রমণের পর কোম্পানির সরে যাওয়া হয়েছিল অত্যন্ত জটিল ও ক্ষতিকর।
সাখালিন-১ প্রকল্প, যা ১৯৯৫ সালে শুরু হয়েছিল, এক্সনের অন্যতম বৃহৎ বিনিয়োগ। কোম্পানিটি সেখানে ৩০ শতাংশ শেয়ার নিয়ে প্রকল্প পরিচালনা করত, অংশীদার ছিল রসনেফত, জাপান ও ভারতের কোম্পানিগুলোও।
কিন্তু ইউক্রেন আক্রমণের পর পশ্চিমা ব্যবসা যখন রাশিয়া ছেড়ে যায়, এক্সন উৎপাদন কমিয়ে আনে এবং শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেয়। তারা চার বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ক্ষতি ধরে নেয়। কিন্তু মস্কো বিক্রি আটকে দেয় এবং পরে এক্সনের অংশীদারিত্ব মুছে দেয়।
ক্রেমলিনের জন্য সম্ভাব্য সাফল্য
এক্সনকে ফেরাতে পারলে তা ক্রেমলিনের জন্য বড় অর্জন হবে। শান্তি আলোচনার অংশ হিসেবে পশ্চিমা বিনিয়োগ টানতে রাশিয়া চেষ্টা করছে। তবে ফেরাটা এখনো অনিশ্চিত, আর তা নির্ভর করছে মূলত ট্রাম্পের ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করার মধ্যস্থতায় সফল হওয়ার ওপর।
রাশিয়ার তেলশিল্প এখনো উৎপাদন ধরে রাখতে পারছে, কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও বিনিয়োগের অভাবে ধীরে ধীরে সক্ষমতা কমে আসবে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইউক্রেনীয় ড্রোন হামলায় রাশিয়ার রিফাইনারি ও পাইপলাইনে ক্ষতি হয়েছে, যা অভ্যন্তরীণ জ্বালানি সরবরাহ কমিয়েছে।
কাতার ও মধ্যস্থতার ভূমিকা
এই বছরের শুরুতে দোহায় চ্যাপম্যানের সঙ্গে রসনেফত প্রধান ইগর সেচিনের বৈঠক হয়। সেচিন পুতিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আওতায়। তবে এক্সন বিশেষ লাইসেন্স নিয়ে তার সঙ্গে বৈঠক করেছে।
কাতার, যার রাষ্ট্রীয় তহবিলে রসনেফতের শেয়ার আছে, বৈশ্বিক সংঘাতে নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছে।
বিনিয়োগের নতুন সুযোগ
রাশিয়া ইঙ্গিত দিয়েছে, যদি মার্কিন কোম্পানিগুলো ফিরে আসে, তারা আর্কটিক জ্বালানি উন্নয়নেও অংশ নিতে পারবে। এদিকে পুতিন আলাস্কা বৈঠকের দিনই এক ডিক্রিতে সাখালিনে বিদেশি কোম্পানির শেয়ার মালিকানা অনুমোদন দেন। তবে শর্ত রাখা হয়—বিদেশি কোম্পানিগুলোকে প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি ও খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ করতে হবে এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা শিথিলের জন্য লবিং করতে হবে।
অতীত সম্পর্ক ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
এক্সনের সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা নতুন নয়। ২০১৩ সালে পুতিন তৎকালীন সিইও রেক্স টিলারসনকে ‘অর্ডার অব ফ্রেন্ডশিপ’ পদক দিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর কিছু প্রকল্পে এক্সনকে বাধা দেওয়া হলেও সাখালিন তখন অক্ষত ছিল। ২০২২ সালের আক্রমণের পরও রসনেফতের সঙ্গে এক্সন ব্যাক-চ্যানেল যোগাযোগ চালিয়ে গিয়েছে।
যদি এক্সন ফিরে আসে, তবে তারা এক ভিন্ন পরিবেশ পাবে। রাশিয়ার অর্থনীতি এখন ধীরগতিতে চলছে, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি দখল সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, আর ক্রেমলিন জ্বালানি খাতে আরও কঠোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
বৈশ্বিক বাজারের পরিবর্তন
রাশিয়ার তেলের বাজারও বদলেছে। ইউরোপ রাশিয়ান তেল থেকে সরে এসেছে, বিপরীতে ভারত ও চীন ব্যাপকভাবে কিনছে। তেল ব্যবসা মূলত সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক অস্পষ্ট কোম্পানির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।
ট্রাম্প এই বছরের বসন্তে পুতিনের প্রতি অনীহা দেখালেও আলাস্কার বৈঠকে আবারও তার প্রতি উষ্ণ মনোভাব প্রকাশ করেন, যা এক্সনের মতো পশ্চিমা কোম্পানির ফেরার সম্ভাবনা আবার আলোচনায় এনেছে।