রোমানিয়ার ভালুক সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে
রোমানিয়ায় বর্তমানে ১০ থেকে ১৩ হাজার ব্রাউন বিয়ার রয়েছে, যা দেশটির পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত টেকসই সংখ্যার তিন থেকে চার গুণ বেশি। এদের জাতীয় সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এখন তারা মানুষের জন্য আতঙ্কে পরিণত হয়েছে।
বিলাসবহুল হোটেলে ভালুকের হামলা
গত ২০ জুন ভোরে এক ভালুক পাহাড়ি বন থেকে বের হয়ে গ্র্যান্ড হোটেল বালভানিওসের লবি ভেঙে ঢোকে। মাত্র ২৩ সেকেন্ডের মধ্যে সে প্রাতঃরাশের টেবিল থেকে সব মধুর প্যাকেট খেয়ে ফেলে। একই মাসে আরেকটি ভালুক হোটেলের স্পা থেকে তিন লিটার ম্যাসাজ তেল খেয়ে ফেলে এবং আরেকটি ভালুক পরিচারিকাকে ধাওয়া করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।
সংস্কৃতি ও ইতিহাসে ভালুকের স্থান
রোমানিয়ার লোককথা ও সংস্কৃতিতে ভালুকের গুরুত্ব দীর্ঘদিনের। এখনো গ্রামে গ্রামে ভালুক নাচ উৎসব হয়, যা খ্রিস্টপূর্ব যুগ থেকে চলে আসছে। একসময় মানুষ ভালুক দেখতে বনে যেত, কিন্তু আজ পরিস্থিতি উল্টে গেছে—ভালুকেরা মানুষের বসতি আক্রমণ করছে।
আবাসভূমি সংকোচন ও শিকার নিষিদ্ধকরণ
২০১৬ সালে শিকার নিষিদ্ধ হওয়ার পর এবং ব্যাপক আবাসন প্রকল্পের কারণে ভালুকদের বাসস্থান কমে যায়। ফলে তারা গ্রাম, শহর, এমনকি মহাসড়কে চলে আসছে। তারা নিয়মিতভাবে ময়লার ঝুড়ি তছনছ করছে, ভেড়ার পাল আক্রমণ করছে, কৃষকদের জমি চাষে বাধা দিচ্ছে। এমনকি বালকদের স্কাউট ক্যাম্পও বন্ধ হয়ে গেছে।
বেড়ে যাওয়া আক্রমণ ও প্রাণহানি
গত নয় বছরে ভালুকের আক্রমণে ২৬৪ জন আহত হয়েছেন, গড়ে প্রতি বছর ২৮ জন। ২০১৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২০ জন মারা গেছেন। স্থানীয়রা বলছেন, আগে কখনো এ রকম ভয় ছিল না, কিন্তু এখন পরিস্থিতি অসহনীয়।
ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা: এক কৃষকের গল্প
সেতাতুয়া গ্রামের কৃষক আন্দ্রাস নিস্তর গত বছর নিজের মেয়ে ও ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে মাঠে যাওয়ার পথে ভালুকের মুখোমুখি হন। ভালুক তার মুখের অর্ধেক ছিঁড়ে ফেলে এবং বুকে পা রাখে। কণ্ঠনালীও কেটে যায়। শেষ মুহূর্তে তার ভেড়ার কুকুর ভালুককে তাড়িয়ে প্রাণ বাঁচায়। পরে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তিনি আবার কথা বলার ক্ষমতা ফিরে পান।
সমাধান নিয়ে বিভাজন
সরকারি কর্মকর্তারা শিকার নিষিদ্ধকরণ তুলে নিতে চান। অন্যদিকে পরিবেশবিদরা মনে করেন, মানুষের কার্যকলাপই সমস্যার মূল। তারা বলছেন, পর্যটন ব্যবসা ও খাদ্য প্রদর্শনের মাধ্যমে মানুষ নিজেরাই ভালুককে আকৃষ্ট করছে।
প্রযুক্তি ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা
কিছু এলাকায় ভালুক নিয়ন্ত্রণে নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জরুরি টিম তৈরি হয়েছে, ভালুকের গলায় জিপিএস কলার লাগানো হয়েছে এবং অ্যাপের মাধ্যমে মানুষকে সতর্ক করা হচ্ছে। বাইলি তুসনাদ গ্রামে ফলগাছ কেটে ফেলা হয়েছে, ভালুক-প্রতিরোধী ডাম্পস্টার বসানো হয়েছে এবং ৯০ শতাংশ বাড়িঘরে বৈদ্যুতিক বেড়া লাগানো হয়েছে। এতে কিছুটা সফলতা এলেও সমালোচকরা বলছেন, মানুষ আসলে ঘরের ভেতর বন্দি হয়ে পড়েছে।
কমিটি দ্বারা হত্যা
২০২১ সালে একটি বিশেষ আইন পাস হয়, যাতে ভালুক আক্রমণের ঘটনায় পুলিশ, পশুচিকিৎসক ও শিকারিদের সমন্বয়ে একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। তবে অনেক সময় ভালুক পালিয়ে যায়। এক ঘটনায় তারা একটি ষাঁড় হত্যাকারী ভালুককে গুলি করে মেরে ফেলে।
নতুন আইন ও সীমিত শিকার অনুমতি
গত বছর এক তরুণ হাইকার নিহত হওয়ার পর পার্লামেন্ট বছরে ৪৮১টি ভালুক শিকার অনুমোদন দিয়েছে, যা আগের তুলনায় দ্বিগুণ হলেও বিশেষজ্ঞদের মতে এটি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। অন্য দেশে ভালুক জনসংখ্যার ১০ শতাংশ পর্যন্ত শিকার করা হয়, যা রোমানিয়ার ক্ষেত্রে বছরে প্রায় ১,৩০০ ভালুক হওয়া উচিত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
রোমানিয়ার ভালুক সংকট এখন এক জটিল সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যা। ভালুকেরা একদিকে জাতীয় সম্পদ, অন্যদিকে মানুষের জীবনের জন্য হুমকি। সমাধান খুঁজে পাওয়া কঠিন হলেও এখনই ভারসাম্যপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, নইলে মানুষ ও ভালুক উভয়ের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে।