জন্মের পর থেকেই অন্যরকম এক যাত্রা
রাফি যখন জন্ম নিল, তার বাবা–মা অন্য সব পরিবারের মতোই স্বপ্ন বুনেছিলেন। সুস্থ, হাসিখুশি একটি সন্তান বড় হবে, স্কুলে যাবে, খেলাধুলা করবে—এই ছিল তাদের প্রত্যাশা। কিন্তু জন্মের কয়েক মাস পরই তারা টের পান, রাফি অন্য শিশুদের মতো নয়। তার চোখে চোখ রাখা কঠিন, শব্দ উচ্চারণে দেরি হচ্ছে, হাঁটতে ও খেলতে অস্বাভাবিক সময় লাগছে।
প্রথমে বিভ্রান্তি, তারপর ভয়—শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকের পরামর্শে তারা জানতে পারেন রাফি একজন বিশেষ শিশু। সেই মুহূর্ত থেকে শুরু হয় নতুন এক যাত্রা, যা শুধু সন্তানের নয়—পুরো পরিবারের জীবন বদলে দেয়।
বাবা–মায়ের অনুভূতি: হতাশা থেকে শক্তি
বিশেষ শিশুর অভিভাবক হওয়া মানে প্রতিদিন নতুন করে মানসিক পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়া। রাফির মা প্রথমদিকে ভেঙে পড়েছিলেন। তিনি বলেন—
“আমরা ভেবেছিলাম হয়তো স্বাভাবিক হবে। যখন চিকিৎসক বললেন রাফির উন্নতি ধীরগতিতে হবে, তখন মনে হয়েছিল পৃথিবী থেমে গেছে। কিন্তু এখন বুঝি, সে আলাদা বলেই আমাদের জীবনে বিশেষ আলো এনেছে।”
রাফির বাবা বলেন—
“শুরুতে সমাজের চোখের দৃষ্টি আমাদের কষ্ট দিত। লোকজন বলত—“বাচ্চাটা স্বাভাবিক নয়।” তখন খুব খারাপ লাগত। এখন বুঝি, এসবের ওপরে ওঠা দরকার। রাফি প্রতিদিন আমাদের ধৈর্য আর ভালোবাসার নতুন শিক্ষা দেয়।”
প্রতিদিনের সংগ্রাম: ছোট জয়, বড় আনন্দ
একজন বিশেষ শিশুকে বড় করা শুধু মানসিক নয়, শারীরিক ও আর্থিক দিক থেকেও চ্যালেঞ্জিং। নিয়মিত থেরাপি, চিকিৎসা, বিশেষ শিক্ষা—সবকিছুতেই খরচ হয় অনেক। অতিরিক্তভাবে রাতে ঘুমের সমস্যা, খাওয়ানো নিয়ে ঝামেলা, বাইরে বের হলে মানুষের কৌতূহলী দৃষ্টি—সব মিলিয়ে বাবা–মায়ের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে।
তবুও প্রতিটি ছোট সাফল্য যেন বিরাট আনন্দ বয়ে আনে। প্রথমবার রাফি যখন নিজে থেকে চামচ ধরল, মা চোখ ভিজিয়ে ফেললেন আনন্দে। যখন নতুন একটি শব্দ বলল, তখন পুরো পরিবার দিনটি উৎসবের মতো কাটাল।
রাফির পরিবার বুঝে গেছে—সফলতার মাপকাঠি সমাজ যা নির্ধারণ করে, তা তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। তাদের কাছে প্রতিটি ছোট অগ্রগতি একেকটি বিশাল বিজয়।
বিশেষজ্ঞের মতামত: সহানুভূতি ও অন্তর্ভুক্তি জরুরি
শিশু মনোবিজ্ঞানী ডা. সামিনা রহমান বলেন—
“বিশেষ শিশুদের অভিভাবকরা এক ধরনের নীরব মানসিক যুদ্ধে লড়েন। তাদের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো সামাজিক সহায়তা, সহজলভ্য চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা। সময়মতো স্পিচ থেরাপি, ফিজিওথেরাপি ও কাউন্সেলিং শুরু করা গেলে অনেক শিশুর উন্নতি হয়। তবে সমান গুরুত্বপূর্ণ হলো বাবা–মায়ের মানসিক সহায়তা।”
তিনি আরও যোগ করেন—
“আমাদের সমাজে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। বিশেষ শিশু কোনো বোঝা নয়। তাদের ভেতরেও আছে সৃজনশীলতা, সম্ভাবনা ও মানবিকতা। আমরা যদি তাদের জায়গা দিই, গ্রহণ করি, তাহলেই তারা সমাজের সম্পদে পরিণত হবে।”
আশার আলো: সমাজের কাছে একটি বার্তা
রাফির বাবা–মা এখন বুঝেছেন, সন্তানকে অন্যদের সঙ্গে তুলনা করার কোনো মানে নেই। তাদের কাছে রাফি যেমন, ঠিক তেমন করেই ভালোবাসার যোগ্য।
রাফির মা বলেন—
“সে হয়তো কখনও সাধারণ বাচ্চাদের মতো হবে না, কিন্তু আমাদের কাছে সে যথেষ্ট। আমরা চাই সমাজ ও আশেপাশের মানুষও তাকে এইভাবেই গ্রহণ করুক। বিশেষ শিশুদের করুণা নয়, সম্মান ও ভালোবাসা দেওয়া উচিত।”
একটি বিশেষ শিশু: ভালোবাসা, সংগ্রাম ও আশার গল্প
-
সারাক্ষণ রিপোর্ট
- ০৩:৫৫:২৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩১ অগাস্ট ২০২৫
- 23
জনপ্রিয় সংবাদ