বাংলাদেশের সঙ্গীত ইতিহাসে কিছু নাম চিরকালীন হয়ে আছে। তাঁদের কণ্ঠ, সুর এবং আবেগ প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আলোড়িত করে রেখেছে। সেই তালিকার অন্যতম একজন হলেন সৈয়দ আব্দুল জব্বার। দেশাত্মবোধক গানের ক্ষেত্রে তিনি এক অদম্য কণ্ঠস্বর। বিশেষত স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধকালীন তাঁর গান মুক্তিকামী মানুষের প্রাণশক্তি হয়ে উঠেছিল।
শৈশব ও কৈশোর
সৈয়দ আব্দুল জব্বারের জন্ম কুষ্টিয়ায়। একটি সাধারণ পরিবারের সন্তান হলেও ছোটবেলা থেকেই তিনি সঙ্গীতপ্রেমী ছিলেন। স্থানীয় যাত্রাপালা, নাট্যমঞ্চ কিংবা মেলা—যেখানেই গান হতো, তিনি কণ্ঠ মিলাতেন। স্কুলজীবনেই তাঁর গানের প্রতিভা প্রকাশ পায়। শিক্ষক-সহপাঠীরা তাঁকে গান গাইতে উৎসাহ দিতেন।
কৈশোরে তিনি তালিম নেন স্থানীয় ওস্তাদদের কাছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, আধুনিক বাংলা গান—সবকিছুতেই তাঁর আগ্রহ ছিল। তবে তিনি নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেও ধীরে ধীরে দক্ষতা অর্জন করেন। এই ভিত্তিই পরবর্তী জীবনে তাঁকে অনন্য শিল্পীতে পরিণত করে।
ঢাকায় আগমন ও শিল্পীজীবনের সূচনা
১৯৬০-এর দশকের শুরুতে তিনি ঢাকায় আসেন শিল্পীজীবনের স্বপ্ন পূরণের জন্য। তখনকার দিনে বাংলাদেশ বেতার ও পাকিস্তান টেলিভিশন ছিল শিল্পীদের স্বপ্নের মঞ্চ। অডিশন দিয়ে তিনি দ্রুতই সেখানে তালিকাভুক্ত হন। তাঁর স্বচ্ছ উচ্চারণ, শক্তিশালী কণ্ঠ এবং আবেগঘন পরিবেশনা শ্রোতাদের মন জয় করে নেয়।
ঢাকার সাংস্কৃতিক মহলে অচিরেই তিনি পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। চলচ্চিত্রেও তিনি গান করেন। তবে তাঁর প্রকৃত পরিচয় গড়ে ওঠে দেশাত্মবোধক গানের মধ্য দিয়ে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন গান ও প্রেরণা
১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন সৈয়দ আব্দুল জব্বারের কণ্ঠ হয়ে ওঠে স্বাধীনতার স্লোগান। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা বেতার দখল করে নিলেও, মুক্তাঞ্চল থেকে প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তাঁর গান অনুরণিত হতো।
- “সালাম সালাম হাজার সালাম”ছিল শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন। প্রতিটি লাইনে ছিল আত্মত্যাগের ইতিহাস। মুক্তিকামী মানুষ গানটি শুনে মনে করতো—শহীদদের রক্ত বৃথা যাবে না।
- “জয় বাংলা বাংলার জয়”শুধু গান নয়, আন্দোলনের মন্ত্র হয়ে ওঠে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা যোগাতে এটি অমূল্য ভূমিকা রাখে। শিবিরে কিংবা রণক্ষেত্রে এই গান স্লোগান হয়ে বাজতো।
এই গানগুলো ছিল অস্ত্রের মতোই শক্তিশালী। মুক্তিকামী মানুষ জানতো—শত্রুর বিরুদ্ধে শুধু গোলা-বারুদ নয়, প্রয়োজন মানসিক শক্তির। আর সেই শক্তি এসেছিল সৈয়দ আব্দুল জব্বারের কণ্ঠ থেকে।
দেশাত্মবোধক গানের বৈশিষ্ট্য
সৈয়দ আব্দুল জব্বারের গানগুলোকে যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তবে কিছু বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে।
কণ্ঠের দৃঢ়তা: তাঁর কণ্ঠে ছিল অগ্নিশিখার মতো তেজ।
উচ্চারণের স্বচ্ছতা: প্রতিটি শব্দ পরিষ্কারভাবে শ্রোতার অন্তরে পৌঁছে যেত।
আবেগের মিশ্রণ: গান শুনলেই মনে হতো, তিনি মাতৃভূমির ব্যথা নিজে অনুভব করছেন।
সুরের জাগরণ: দেশাত্মবোধক গানে যেমন আবেগ, তেমনি সুরের শৃঙ্খলা ছিল নিখুঁত।
ফলে তাঁর গান কেবল বিনোদন ছিল না; তা ছিল সংগ্রামের সঙ্গীত।
স্বাধীনতার পর তাঁর গান
স্বাধীনতা লাভের পরও তিনি দেশাত্মবোধক গান গেয়ে গেছেন। জাতীয় দিবসে, রাষ্ট্রায়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কিংবা টেলিভিশনের বিশেষ প্রোগ্রামে তাঁর গান নিয়মিত প্রচারিত হতো। তিনি প্রমাণ করেছিলেন—দেশাত্মবোধক গান কেবল যুদ্ধকালীন নয়, স্বাধীন দেশেও তা জাতীয় চেতনাকে জাগিয়ে রাখতে পারে।
সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার
বাংলাদেশের সঙ্গীতে সৈয়দ আব্দুল জব্বারের অবদান অমূল্য। তিনি প্রমাণ করেছেন, সঙ্গীতশিল্পীও একজন যোদ্ধা হতে পারেন—কণ্ঠকে অস্ত্র বানিয়ে। তাঁর গাওয়া গান আজও বাজে স্কুল-কলেজের অনুষ্ঠানে, জাতীয় দিবসের মঞ্চে কিংবা টেলিভিশনের আয়োজনগুলোতে।
বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীরা যখন দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করেন, তখন তাঁরা অবচেতনভাবেই সৈয়দ আব্দুল জব্বারের ধারা অনুসরণ করেন। তাঁর কণ্ঠ আজও এক মাপকাঠি।
প্রেরণা ও উত্তরসূরি
আজকের তরুণ প্রজন্ম যখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে চায়, তখন গানই হয়ে ওঠে সহজ পথ। আর সেই গানে প্রথম নাম আসে সৈয়দ আব্দুল জব্বারের। তাঁর গান প্রমাণ করে—শিল্পকলা কখনো নিরপেক্ষ নয়, বরং তা সময়ের প্রয়োজনে জনগণের অস্ত্র হয়ে ওঠে।
সৈয়দ আব্দুল জব্বার শুধু একজন গায়ক নন, তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অদৃশ্য সৈনিক। তাঁর গান মুক্তিকামী মানুষকে দিয়েছে সাহস, শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা, এবং মাতৃভূমির জন্য আত্মত্যাগের অঙ্গীকার। আজও তাঁর গান শুনলেই বুক ভরে ওঠে দেশপ্রেমে, চোখে ভেসে ওঠে শহীদদের আত্মত্যাগের ছবি।
বাংলাদেশের সঙ্গীত ভাণ্ডারে সৈয়দ আব্দুল জব্বার চিরকাল বেঁচে থাকবেন মাতৃভূমির অমর কণ্ঠস্বর হয়ে।