ক্রিকেট বিশ্বের ইতিহাসে ২০২৫ সালের নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপ একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। কারণ এই আসরে প্রথমবার একজন বাংলাদেশি নারী আম্পায়ারকে মূল আম্পায়ার হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে। তিনি হলেন সাথিরা জাকির জেসি। এটি শুধু একটি আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং নারী ক্রীড়াঙ্গনের দীর্ঘ সংগ্রামের এক ঐতিহাসিক জয়। বিশ্বকাপের মতো সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতায় একজন বাংলাদেশি নারীকে মাঠের কেন্দ্রে দাঁড় করানো নিঃসন্দেহে ক্রিকেটের সমতা ও বৈচিত্র্যের প্রতীক হয়ে থাকবে।
নির্বাচনের প্রেক্ষাপট
আইসিসি দীর্ঘদিন ধরেই নারী আম্পায়ারদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুযোগ দেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করে আসছিল। পুরুষ ক্রিকেটে নারী আম্পায়ারদের দেখা গেলেও বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে তাদের উপস্থিতি ছিল বিরল। স্থানীয় ও আঞ্চলিক টুর্নামেন্টে নারীরা দক্ষতা প্রমাণ করার পর অবশেষে ২০২৫ সালে সেই অপেক্ষার অবসান হলো। আইসিসি ঘোষণা দিয়েছে যে এবার প্রথমবার একজন বাংলাদেশি নারী আম্পায়ার—সাথিরা জাকির জেসি—মাঠে দাঁড়িয়ে বিশ্বকাপ ম্যাচ পরিচালনা করবেন।
জীবনী ও শৈশব
সাথিরা জাকির জেসির জন্ম একটি সাধারণ পরিবারে। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি তার গভীর অনুরাগ ছিল। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে তিনি ক্রিকেট খেলতেন। যদিও খেলোয়াড় হিসেবে খুব বেশি দূর এগোনো সম্ভব হয়নি, তবে ক্রিকেট মাঠের প্রতি ভালোবাসা কখনও কমেনি। পরিবারের সহযোগিতা এবং নিজের দৃঢ় সংকল্প তাকে ভিন্ন পথে হাঁটার সাহস দিয়েছে।
শুরুতে স্থানীয় লিগে স্কোরার ও সহকারী অফিসিয়াল হিসেবে কাজ করতেন। এরপর ধীরে ধীরে নিয়ম-কানুনে দক্ষ হয়ে ওঠেন এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আম্পায়ারিং পেশায় প্রবেশ করেন। নারী হয়েও পুরুষ-প্রধান পরিবেশে নিজেকে প্রমাণ করা সহজ ছিল না। কিন্তু তার অনড় মনোভাব, শৃঙ্খলা এবং খেলার প্রতি নিষ্ঠা তাকে সবার কাছে স্বীকৃত করে তুলেছে।
পরিবার ও প্রেরণা
সাথিরা জেসির পরিবারের ভূমিকা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাবা-মা প্রথমদিকে মেয়ের আম্পায়ার হওয়ার সিদ্ধান্তে খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। সমাজের চাপ, নিরাপত্তার বিষয়, আর্থিক অনিশ্চয়তা—এসব তাদের ভাবিয়ে তুলেছিল। তবে মেয়ের অধ্যবসায় ও দৃঢ়তায় তারা ধীরে ধীরে সমর্থন দেন। বর্তমানে তার পরিবারই তার সবচেয়ে বড় শক্তি। পরিবার বলছে—“সে শুধু আমাদের গর্ব নয়, পুরো দেশের গর্ব।”
ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য ম্যাচ
আম্পায়ার হিসেবে সাথিরা জেসির যাত্রা শুরু হয় স্থানীয় নারী ক্রিকেট লিগ থেকে। এরপর আঞ্চলিক টুর্নামেন্ট ও আন্তর্জাতিক বাছাইপর্বে দায়িত্ব পালন করেন। তার আম্পায়ারিং নিরপেক্ষতা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার দ্রুততা ও নিয়ম বোঝার দক্ষতা তাকে দ্রুত পরিচিত করে তোলে।
২০১৯ সালে তিনি প্রথমবার একটি আন্তর্জাতিক নারী সিরিজে অন-ফিল্ড আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেই ম্যাচে তার সঠিক সিদ্ধান্ত ও আত্মবিশ্বাসী উপস্থিতি আইসিসির নজরে আসে। পরবর্তী কয়েক বছরে তিনি একাধিক ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ম্যাচে দায়িত্ব পালন করেন। বিশেষ করে ২০২৩ সালের এশিয়া কাপ নারী ক্রিকেটের সেমিফাইনালে তার সাহসী সিদ্ধান্ত ব্যাপক প্রশংসিত হয়। এসব অভিজ্ঞতা তার জন্য বিশ্বকাপের দরজা খুলে দেয়।
নারী ক্রিকেটের ইতিহাসের সঙ্গে তুলনা
নারী ক্রিকেট দীর্ঘদিন উপেক্ষিত ছিল। অনেক দেশে নারীরা ক্রিকেট খেলার সুযোগই পেতেন না। এমনকি যারা খেলতে পারতেন, তাদের জন্য পরিকাঠামো, অর্থনৈতিক সহায়তা বা পেশাদার স্বীকৃতি ছিল না। ধীরে ধীরে নারী ক্রিকেট বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেতে শুরু করে। ১৯৭৩ সালে প্রথম নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হলেও তখনও নারী আম্পায়ারের উপস্থিতি ছিল শূন্য।
আজ, প্রায় পাঁচ দশক পর, সেই শূন্যতা ভরাট হলো সাথিরা জাকির জেসির অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে। এটি শুধু একটি ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং নারী ক্রিকেটের ইতিহাসে এক বিশাল অগ্রগতি। এটি প্রমাণ করে যে ক্রিকেট শুধু পুরুষদের খেলা নয়—নারীরাও সমানভাবে এই খেলায় নেতৃত্ব দিতে পারে।
তাৎপর্য
প্রথম বাংলাদেশি নারী আম্পায়ারের অন্তর্ভুক্তি নারীদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এটি শুধু প্রতীকী নয়, বরং মাঠে নারীর সমান অবস্থান নিশ্চিত করার একটি শক্তিশালী পদক্ষেপ। ক্রিকেট মাঠে যখন দর্শকরা সাথিরা জেসিকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে দেখবেন, তখন তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হবে।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
বিশ্বকাপে প্রথম বাংলাদেশি নারী আম্পায়ারের উপস্থিতি শুধু সাথিরা জেসির জন্য নয়, বরং বিশ্বব্যাপী অসংখ্য তরুণীর জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। অনেক নারী এখন আম্পায়ারিং পেশায় আসতে আগ্রহী হবেন। এতে করে ক্রিকেটের প্রতিটি স্তরে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়বে। আইসিসিও জানিয়েছে, আগামী দিনে আরও বেশি নারীকে আম্পায়ার ও ম্যাচ অফিসিয়াল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
২০২৫ সালের নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপে সাথিরা জাকির জেসির নির্বাচন ক্রিকেট ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এটি শুধু একটি নাম নয়, বরং দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতীক। নারী ক্রিকেট যে আর শুধু খেলোয়াড়দের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ নয়, বরং প্রশাসন ও অফিসিয়াল স্তরেও সমানভাবে জায়গা করে নিচ্ছে—এটিই তার প্রমাণ। এই অর্জন আগামী দিনের নারী ক্রিকেটকে আরও শক্তিশালী, মর্যাদাপূর্ণ ও অনুপ্রেরণামূলক করে তুলবে।