০৮:৩৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৫
ট্রাম্প যখন যুদ্ধ শেষের দম্ভ দেখাচ্ছেন, চীন তখন নীরবে শান্তির পথে কাজ করছে অটিজম চিকিৎসার অপ্রতিষ্ঠিত পথে প্রতিটি পরিবার সাত দশক পর ব্রিটিশ মিউজিক্যালে নতুন জীবন পেল প্রিয় ভালুক সম্পর্কের উষ্ণতা ধরে রাখা উচিৎ, পারিবারিক সীমারেখা রক্ষা করে উৎসব উদযাপনের জ্ঞান শৈশবের গভীর ক্ষত থেকে লেখা এক রন্ধনশিল্পীর আত্মস্বীকারোক্তি মুর্শিদাবাদ-কাহিনী (পর্ব-৩৬৪) ক্ষমতার নৃত্য: ট্রাম্পের হোয়াইট হাউস বলরুম প্রকল্পে দানের আড়ালে ব্যবসায়িক স্বার্থের খেলা জোহরান মামদানির সিরিয়ান স্ত্রী রামা দুয়াজি সম্পর্কে এই বিষয়গুলো কি জানেন? পুঁজিবাজারে পতনের ধারা অব্যাহত: সপ্তাহ শেষে ডিএসই ও সিএসই লাল সূচকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মৃত্যু

রাজসাহীর ইতিহাস (পর্ব -১১)

নরহরিদাসের বংশ-নরহরির তিন পুত্র। তাহারা কনিষ্ঠ পুত্র বগুড়ায় বাস করেন। এই নরহরি দাসের বংশধরেরা ময়দান দিঘি, চৌপাকিয়া, পাবনা, মালঞ্চি, কেচুয়াডাঙা, মেহেরপুর প্রভৃতি স্থানে বসতি বিস্তার করেন। ইহাদের অনেকেই সুশিক্ষিত।

ভূগুনন্দীর বংশ-ভূগুনন্দীর কালু ও মাধব দুই পুত্র। ইহারা পাবনা জেলার অন্তর্গত পোতাজিয়ার নিকট অষ্টমনিষা গ্রামে বাস করেন। কালু ও মাধবের বংশধরেরা পোতাজিয়া, অষ্টমনিষা প্রভৃতি স্থানে বাস করিয়া বিখ্যাত হয়। এই বংশের গোবিন্দ রায় নামক একজন পোতাজিয়া গ্রামে একটি বৃহৎ নবরত্ন নির্মাণ করেন। সেই জন্য ইহার বংশধরেরা “নবরত্নপাড়ার রায়” নামে প্রসিদ্ধ। এই বংশীয় রূপরাম রায় নামে একজন পারসি ও আরবি ভাষায় বিশেষ পণ্ডিত ছিলেন। নবাব সায়েস্তা খাঁর অধীনে কোন প্রধান পদে রূপরাম ছিলেন। পিতার সহিত মনান্তর হওয়ায় ইনি পোতাজিয়া ত্যাগ করিয়া রাজসাহীর অন্তর্গত ডিহি কাশীপুরের মধ্যে বাসভবন নির্দেশ করেন। কাশীপুর প্রভৃতি ২৭ খান গ্রাম রূপরামের সম্পত্তি ছিল।

মুরারি চাকীর বংশ-মুরারি চাকীর দুই স্ত্রী। প্রথম পক্ষের বণিতার সন্তানেরা অষ্ট মণিষা, মেদবাড়ি, কেচুয়াডাঙা প্রভৃতি গ্রামে এবং শেষ পক্ষের বণিতার সন্তানেরা দুর্লভপুর, ঢাকঢোর, দিলপসার প্রভৃতি গ্রামে বাস করেন।

জটাধর নাগের বংশ-জটাধর নাগের সন্তানেরা মালঞ্চি, গাঁড়াদহ, সরগ্রাম প্রভৃতি স্থানে বাস করেন। জটাধর নাগের সন্তানগণ মধ্যে সরগ্রামের নাগবংশই শ্রেষ্ঠ। ইহারা সোনাবাজু পরগণার বিখ্যাত জমিদার ছিল। এই বংশের রূপরাম নাগ সমাজে বিশেষ সম্মানিত হন।

ও র ও )

জটাধর নাগের বংশের এক ব্যক্তি রাজসাহী জেলার অন্তর্গত ডাঙাপাড়া গ্রামে বাস করেন। ডাঙাপাড়াদিগর একটি বিস্তৃত জমিদারি লাভ করিয়া, ইনি বিশেষ বিখ্যাত হন। ইহার বংশধরেরা সমাজে বিশেষ পরিচিত এবং গৌরবান্বিত। এই বংশে অনেকে সুশিক্ষিত। ইহাদের ডাঙাপাড়াদিগরের জমিদারি এখনও আছে। ইহারা ডাঙাপাড়ার চৌধুরি বলিয়া পরিচিত। ইহারা চৌদ্দ চৌধুরির এক চৌধুরি বলিয়া প্রসিদ্ধ।

গশবাড়ির নাগবংশও বিশেষ মাননীয়।

তাড়াষের জমিদার বংশ-তাড়াষ বিল চলনের নিকটবর্তী গ্রাম। পূর্বে এই গ্রাম রাজসাহী

প্রদেশের অন্তর্গত ছিল। এইক্ষণ এই গ্রাম পাবনা জেলার অন্তর্গত। চড়িয়ার দেব বংশোদ্ভব বলরাম নামক এক ব্যক্তি বারেন্দ্র কায়স্থ সমাজে বিশেষ পরিচিত ছিলেন। এই ব্যক্তি নাটোর রাজ সংসারে প্রধান কার্যকারক ছিলেন। এই সময় কুসুম্বি পরগণা প্রভৃতি বিস্তর জমিদারি লাভ করেন। “ধনেনকুল” এই বাক্যের সার্থকতা লাভ করেন। সুতরাং সমাজে বিশেষ পরিচিত হইলেন। রাজসাহী ও পাবনা জেলায় বিস্তৃত জমিদারি লাভ করিয়া তাড়াষ গ্রামে বাস নির্দেশ করেন। বর্তমান তাড়াষের প্রধান জমিদারগণ এই বলরাম রায়ের বংশ সম্ভূত।

রঙ্গুর জেলার অন্তর্গত বর্ধন কুঠির জমিদার দেব বংশীয়। এই বংশে ভগবান নামক এক ব্যক্তি মানসিংহের সময় রাজা উপাধি প্রাপ্ত হন। ঐ জেলার অন্তর্গত কাকিনার জমিদারও কুলীন নহে। কিন্তু বিস্তৃত জমিদারি লাভ করিয়া, সমাজে এ বংশ প্রসিদ্ধ হইয়াছিল।

এই বারেন্দ্র শ্রেণি কায়স্থগণের আচার ব্যবহার, সামাজিক রীতিনীতি বঙ্গজ ও রাঢ়ীয় শ্রেণি কায়স্থগণের সঙ্গে কোন অংশ মিল নাই। রাজসাহীতে ২/৪ ঘর বঙ্গজ কায়স্থের বাস; অবশিষ্ট কায়স্থ সমুদয় বারেন্দ্র শ্রেণি। এই রাজসাহীতে আচার ভ্রষ্ট কায়স্থও কম নহে। ইহারা বারেন্দ্র শ্রেণি বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকে। কিন্তু বারেন্দ্র শ্রেণি সদাচারী সদ্বংশজাত কায়স্থগণের সহিত ইহারা আহার ব্যবহার করণকারণ কিছুই করিতে পারে না। ইহারা প্রায়ই অশিক্ষিত। রাজসাহীতে সর্বসমেত বারেন্দ্র কায়স্থ ১০০০ ঘরের কম হইবে না। ডাঙাপাড়া, মাঝগ্রাম, বারিয়াহাটি, ঢাকঢোর, ছাতারপাড়া, করচমাড়িয়া, মুরাদপুর প্রভৃতি স্থানে সদাচারী সদ্বংশজাত ধনী বারেন্দ্র কায়স্থের বাস। ইহাদের অনেকেই সুশিক্ষিত।

৬। নবশাখ বা নবশায়ক-শূদ্রজাতি নয় শাখায় বিভক্ত বলিয়া এই জাতির নাম নবশাখ হয়। তিলি, মালি, তামুলি, গোপ, নাপিত, গোছালি, কামার, কুমার, পুঁটুলি এই নয় জাতি নবশাখ আখ্যায় পরিচিত।২২ ইহাদের ব্যবসায় অনুযায়ী জাতি নির্ণয় করা হইয়াছে। অতিপুরাকালে আর্যজাতিরা যাহাদের পরাজিত করিয়া বন্দি করেন, তাহারা আচারভ্রষ্ট শূদ্র

আখ্যা প্রাপ্ত হইয়া ত্রৈবর্ণের কার্যে নিযুক্ত হয়। তখন সংসার যাত্রা নির্বাহ জন্য স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র

ব্যবসায়ী জাতিরও প্রয়োজন হইল। সে সময় ত্রৈবর্ণের নিচে শূদ্র ভিন্ন অন্য জাতি ছিল না।

সুতরাং শূদ্রগণের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসায়ী লোকের সৃষ্টি হইল। এই আচারভ্রষ্ট শূদ্রগণ মধ্যে যাহারা ত্রৈবর্ণের সেবায় বা সংস্রবে জ্ঞান লাভ করেন, তাহারা শূদ্র মধ্যে উৎকর্ষ লাভ করিয়া সম্মানিত হইতে লাগিলেন এবং যাহারা অজ্ঞানই রহিল বা নিকৃষ্ট কর্মে রত হইল, তাহারা নিকৃষ্ট শূদ্র শ্রেণিতে পরিগণিত হইল। এই অপেক্ষাকৃত জ্ঞানী শূদ্রগণ উল্লিখিত নয় শাখায় বিভক্ত হইয়া ব্যবসানুযায়ী নবশাখ বলিয়া পরিচিত হইল। ইহাই বেশি সম্ভব। কিন্তু “সম্বন্ধ নির্ণয়ের” গ্রন্থকার পণ্ডিত প্রবর লালমোহন বিদ্যানিধি মহাশয় নবশাখের অন্যরূপ ব্যাখ্যা করেন। “যৎকালে মহাবীর পরশুরাম পৃথিবীকে একবিংশতিবার নিঃক্ষত্রিয় করেন তৎকালে

এই কয়েক জাতির সাহায্য লইয়া তিনি ক্ষত্রিয় বংশের ধ্বংস করিতে সমর্থ হন। ইহাদিগেরই সাহায্যে পরশুরামের প্রতিজ্ঞা সিদ্ধ হয় (অর্থাৎ ক্ষত্রিয়কুলের বিনাশ বিষয়ে ইহারা শায়ক (বান) স্বরূপ হয়)। ইহারা পূর্বে কায়স্থের তুল্য ছিল না; ঐ সময়াবধি কায়স্থের তুল্য হয়। পরশুরাম দ্বারা সমাজ মধ্যে এতাদৃশ মর্যাদা পাইয়াই ইহারা ক্ষত্রিয়দিগের বিরুদ্ধে উত্থান করিয়াছিল”। এই উদ্ধৃত অংশ পৌরাণিক কথা। ইহার সারাংশ গ্রহণ করিলে, ইহা প্রতীত হইবে নবশাখ শূদ্রজাতি এবং ক্ষত্রিয়ের নিচ বলিয়া তাহাদের বিরুদ্ধে উত্থান হয়। এস্থলে ইহাও বলা যাইতে পারে যে, যদি কায়স্থ ক্ষত্রিয় না হইয়া নবশাখের মত শূদ্রজাতি হইত, তাহা হইলে কায়স্থ ও ক্ষত্রিয়ের ধ্বংস জন্য পরশুরামকে সাহায্য করিত। আবার “শায়ক” শব্দের সহিত “নব” শব্দ সংযোজিত করিলে “নবশায়ক” হইল। তবে কি “নবশায়ক” শব্দে “নূতনবান” কি “নয়বান” বুঝাইবে। “নবশায়ক” শব্দে নূতন বান বা নয়বান বুঝাইতে পারে। শূদ্রেরা নূতনবান গ্রহণ করিয়া ক্ষত্রিয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বা শূদ্রের নয় শ্রেণি একত্রিত হইয়া যুদ্ধ করে এই হেতু ইহারা নবশায়ক বা নবশাক নাম ধারণ করিল। অতএব উদ্ধৃত অংশের উপর ভিত্তিস্থাপন করিয়া নবশাক না বলিয়া নবশায়ক বলিলেও কোন বিশেষ ক্ষতি দেখি না। আবার বিদ্যানিধি মহাশয় বলিয়াছেন নবশাকেরা “সচ্ছদ্র বলিয়া পরিগণিত”। আমরা বিদ্যানিধি মহাশয়ের পক্ষ সমর্থন করিতে পারিলাম না। ধরণীকোষ মতে সচ্ছদ্র কেবল ক্ষত্রিয়কেই বুঝায়। ইহা নিম্ন উদ্ধত শ্লোকে প্রমাণ হইবে।-

“সজ্জুদ্র, মসীশদেব কায়স্থশ্চ শ্রীবৎসজঃ।

অন্বষ্ঠো মাথুরীভট্টঃ সূর্যধ্বজশ্চ গৌড়কঃ।।”

ধরণী মতে কায়স্থ ক্ষত্রিয় এবং ক্ষত্রিয় সচ্ছদ্র। আবার স্কন্দপুরাণ মতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, সচ্ছদ্র এবং ইহারা শালগ্রামশীলা স্পর্শ করিতে সক্ষম। এ বিষয়ে নিম্নবচনে প্রমাণ হইবে:-

“ব্রাহ্মণ ক্ষত্র বৈশ্যানাং সচ্ছদ্রানা মথাপিবা।

শালগ্রামেহধিকারোক্তি নচান্যেষাং কদাচন।।”

নবশাখ যে সচ্ছদ্র নহে তাহার সন্দেহ রহিল না। নবশাখ শূদ্রজাতীয়। কিন্তু ইহারা ভাল শূদ্র এবং ইহাদের স্পর্শীয় জল সকল জাতিই পান করিতে পারে। “নবশাখেরা কায়স্থ সদৃশ সদাচার সম্পন্ন। ইহাদিগের পুরোহিত ও কায়স্থদিগের পুরোহিত এক।”২০ একথা কতদূর ঠিক তাহা আমরা বলিতে পারি না। পূর্ববঙ্গে যে সকল বঙ্গজ কায়স্থ বসতি করিতেছেন, তাহাদের এবং সেই দেশবাসী নাবশাখ বিধবা রমণীদের আচার ব্যবহার ও ক্রিয়াকলাপ দেখিলে “নবশাখেরা কায়স্থ সদৃশ সদাচার সম্পন্ন” বলা ভ্রমপদ হইবে। বঙ্গজ কায়স্থ সমাজে বিধবা রমণীদের আচার ব্যবহার ঠিক ব্রাহ্মণ বিধবা রমণীর ন্যায়। বঙ্গের কায়স্থ বিধবা রমণী ব্রহ্মচর্য-ব্রত-চারিণী। পক্ষান্তরে নবশাখ বিধবা রমণীগণেরা ব্রহ্মচর্য ব্রতচারিণী নহে। ইহাদের মধ্যে অনেকেই স্বেচ্ছাচারিণী। এই রূপে কায়স্থ ও নবশাখ পুরুষদের আচার ব্যবহারে অনেক প্রভেদ আছে। পূর্ববঙ্গে নবশাখেরা বঙ্গজ কায়স্থদের ব্রাহ্মণের ন্যায় সম্মান করিয়া থাকে। কিন্তু রাজসাহীতে এরূপ ভাব দেখা যায় না। এজেলায় নবশাখদের মধ্যে অনেক বিধবা রমণী ব্রহ্মচর্য-ব্রত-চারিণী নহে এবং পুরুষেরাও যথেষ্ট আচার ভ্রষ্ট। রাজসাহীর নবশাখেরা কায়স্থদের ব্রাহ্মণের ন্যায় সম্মান করে না। ইহার কারণ এই যে রাজসাহীতে বারেন্দ্র কায়স্থের সমাজ প্রধান, বঙ্গজ কায়স্থ দুই চারি ঘর মাত্র আছে। বারেন্দ্র কায়স্থের আচার ব্যবহার বঙ্গজ কায়স্থের সদৃশ নয় বলিয়াই নবশাখেরা রাজসাহীর কায়স্থদের বঙ্গজ কায়স্থদের ন্যায় সম্মান করে না। মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের কাল হইতে নবদ্বীপ এবং তন্নিকটবর্তী স্থানের নবশাখগণের আচার ব্যবহার অনেক সংশোধিত হইয়াছে বলিয়া সেই প্রদেশের নবশাখদের আচার ব্যবহার দক্ষিণ

রাঢ়ীয় কায়স্থ সদৃশ দেখা যায়। আমরা স্বীকার করি নবশাখের শিক্ষা, সভ্যতা, ধন ও সম্মান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের আচার ব্যবহারের অনেক পরিবর্তন হইতেছে। এমতাবস্থায়ও দেখিতে পাওয়া যায় যে অনেক স্থলে বঙ্গজ কায়স্থের ও নবশাখের পুরোহিত এক নহে। অনেক বঙ্গজ কায়স্থও নবশাখের পুরোহিত দ্বারা ক্রিয়া কলাপ নির্বাহ করান না। পক্ষান্তরে ইহাও দেখা যায় ব্রাহ্মণ ও কায়স্থের পুরোহিত এক। তাই বলিয়া কি কায়স্থ ব্রাহ্মণ সদৃশ হইতে পারে?

(১) তিলি-তিল শস্য বিক্রেতাকে আদিতে তিলি জাতি বলিত। এক্ষণ ব্যবসায়ী জাতিকে তিলি বলে। রাজসাহীতে পাঁচুপুর, গোবিন্দপুর, হাতিয়ানদহ, আড়ানী, মালঞ্চি প্রভৃতি স্থানে তিলি জাতীয় অনেক ধনী লোক আছে। তিলি জাতির মধ্যে দিঘাপতিয়ার রাজা প্রসিদ্ধ। এই ডিলি জাতিতে প্রায়শই দরিদ্র নাই। এই জাতির আর একটি শ্রেণি তেলি নামে কথিত আছে। ইহারা তৈলবিক্রেতা। কোন কোন স্থানে তেলি জল-অনাচরণীয় জাতি বলিয়া প্রসিদ্ধ।

(২) মালি-ইহারা মালকার নামে প্রসিদ্ধ। ইহাদের ব্যবসা পুষ্পচয়ন করা এবং মালা গ্রন্থন দেওয়া। অধুনা ইহারা বিবাহ, চূড়াকরণ প্রভৃতি মাঙ্গলিক কার্যে শোলার মুকুট ও ফুল প্রস্তুত এবং দেবপ্রতিমাদি চিত্র করিয়া থাকে।

(৩) তামূলি-ইহাদের আদি ব্যবসা পান বিক্রয় করা। এই রাজসাহীতে গোয়ালকান্দি ও আমরাইল গ্রামে যে তামুলি আছে তাহারা জমিদার। তামুলিরা কুসিদজীবী। ইহা কথিত আছে যে তামুলিরা এত বেশি হারে সুদ গ্রহণ করিত যে অধমর্ণেরা এত বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট হইয়াছিল যে প্রায় ৬৫ কি ৭০ বৎসর পূর্বে ‘তামুলি লুট’ নামে একটি বৃহদাকারে বড়গাছিতে তামুলির বাড়ি লুট হয়। বড়গাছি রামপুর-বোয়ালিয়া হইতে প্রায় ১২ মাইল উত্তর। তাহিরপুর পরগণার প্রজারাই বেশি প্রপীড়িত হয়। ইহারা ও অন্যান্য প্রজারা লুট করে। খত, খাতা, ও যাবতীয় কাগজপত্র অগ্নিসাৎ করে। এই ঘটনা হইতে তামুলি জাতিকে সেক্সপিয়ারের সাইলক (Shy-lock) বলিলে অত্যুক্তি হইত না। এক্ষণ তামুলি জাতির কুসিদ ব্যবসায় উন্নতি নাই। এক্ষণ প্রায় সকল জাতিই কুসিদজীবী।

(৪) গোপ-শব্দার্থে গো রক্ষককে গোপ বলে। বঙ্গের দক্ষিণ ভাগে সদ্‌দগোপকে গোপ বলে। ইহাদের সাধারণ ব্যবসা কৃষি। হুগলি জেলাতে অনেক সদ্বংশজাত শিক্ষিত সঙ্গোপের বাস। কিন্তু ঐ দেশে যাহাদের গোয়ালা বলে তাহারা নবশাখ নহে এবং তাহারা অনাচরণীয়। রাজসাহীতে যাহাদের গোপ বলে তাহারা দধি দুগ্ধ ব্যবসায়ী এবং তাহারা জল আচরণীয়। রাজসাহীতে দক্ষিণ দেশের ন্যায় গোয়ালা নাই। দক্ষিণদেশ সদৃশ সদগোপ এ জেলায় অতি অল্প সংখ্যক। ইহাদের ব্যবসা কৃষি। ইহাদের কুটুম্ব হুগলি, বীরভূম, বাঁকুড়া প্রভৃতি জেলায় আছে।

(৫) নাপিত-ইহাদের ব্যবসা ক্ষৌর কার্য। মহাপ্রভু চৈতন্যদেব সন্ন্যাস গ্রহণ সময় মধু নাপিত তাহার মস্তক মুণ্ডন করে। এই সময় হইতে মধু নাপিতের বংশধরেরা ক্ষৌর কর্ম ত্যাগ করিয়া মোদকাদি প্রস্তুত এবং বিক্রয় করে। রাজসাহীর অন্তর্গত কলম, ডায়া প্রভৃতি গ্রামে কতিপয় মধুবংশীয় নাপিত আছে।

(৬) গোছালি-ইহারা পান প্রস্তুত করে এবং বিক্রয় করে। ইহাদের সাধারণত ‘পানতীয়া’ বা বারুই বলে। গুচ্ছ শব্দে আঁটি বুঝায়। যে পানের আঁটি বা গুচ্ছ বাঁধে তাহাকে গোছালি বলা যায়।

(৭) কামার-ইহারা লৌহদ্রব্য প্রস্তুত এবং বিক্রয় করে।

(৮) কুমার-ইহারা মৃন্ময় ঘটাদি প্রস্তুত এবং বিক্রয় করে।

(৯) পুটুলি-গন্ধবণিক, শঙ্খবণিক, তত্ত্ববায়, ময়রা এই কয়েক জাতি পুঁটুলি বলিয়া

জনপ্রিয় সংবাদ

ট্রাম্প যখন যুদ্ধ শেষের দম্ভ দেখাচ্ছেন, চীন তখন নীরবে শান্তির পথে কাজ করছে

রাজসাহীর ইতিহাস (পর্ব -১১)

০৪:৫৬:৪২ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

নরহরিদাসের বংশ-নরহরির তিন পুত্র। তাহারা কনিষ্ঠ পুত্র বগুড়ায় বাস করেন। এই নরহরি দাসের বংশধরেরা ময়দান দিঘি, চৌপাকিয়া, পাবনা, মালঞ্চি, কেচুয়াডাঙা, মেহেরপুর প্রভৃতি স্থানে বসতি বিস্তার করেন। ইহাদের অনেকেই সুশিক্ষিত।

ভূগুনন্দীর বংশ-ভূগুনন্দীর কালু ও মাধব দুই পুত্র। ইহারা পাবনা জেলার অন্তর্গত পোতাজিয়ার নিকট অষ্টমনিষা গ্রামে বাস করেন। কালু ও মাধবের বংশধরেরা পোতাজিয়া, অষ্টমনিষা প্রভৃতি স্থানে বাস করিয়া বিখ্যাত হয়। এই বংশের গোবিন্দ রায় নামক একজন পোতাজিয়া গ্রামে একটি বৃহৎ নবরত্ন নির্মাণ করেন। সেই জন্য ইহার বংশধরেরা “নবরত্নপাড়ার রায়” নামে প্রসিদ্ধ। এই বংশীয় রূপরাম রায় নামে একজন পারসি ও আরবি ভাষায় বিশেষ পণ্ডিত ছিলেন। নবাব সায়েস্তা খাঁর অধীনে কোন প্রধান পদে রূপরাম ছিলেন। পিতার সহিত মনান্তর হওয়ায় ইনি পোতাজিয়া ত্যাগ করিয়া রাজসাহীর অন্তর্গত ডিহি কাশীপুরের মধ্যে বাসভবন নির্দেশ করেন। কাশীপুর প্রভৃতি ২৭ খান গ্রাম রূপরামের সম্পত্তি ছিল।

মুরারি চাকীর বংশ-মুরারি চাকীর দুই স্ত্রী। প্রথম পক্ষের বণিতার সন্তানেরা অষ্ট মণিষা, মেদবাড়ি, কেচুয়াডাঙা প্রভৃতি গ্রামে এবং শেষ পক্ষের বণিতার সন্তানেরা দুর্লভপুর, ঢাকঢোর, দিলপসার প্রভৃতি গ্রামে বাস করেন।

জটাধর নাগের বংশ-জটাধর নাগের সন্তানেরা মালঞ্চি, গাঁড়াদহ, সরগ্রাম প্রভৃতি স্থানে বাস করেন। জটাধর নাগের সন্তানগণ মধ্যে সরগ্রামের নাগবংশই শ্রেষ্ঠ। ইহারা সোনাবাজু পরগণার বিখ্যাত জমিদার ছিল। এই বংশের রূপরাম নাগ সমাজে বিশেষ সম্মানিত হন।

ও র ও )

জটাধর নাগের বংশের এক ব্যক্তি রাজসাহী জেলার অন্তর্গত ডাঙাপাড়া গ্রামে বাস করেন। ডাঙাপাড়াদিগর একটি বিস্তৃত জমিদারি লাভ করিয়া, ইনি বিশেষ বিখ্যাত হন। ইহার বংশধরেরা সমাজে বিশেষ পরিচিত এবং গৌরবান্বিত। এই বংশে অনেকে সুশিক্ষিত। ইহাদের ডাঙাপাড়াদিগরের জমিদারি এখনও আছে। ইহারা ডাঙাপাড়ার চৌধুরি বলিয়া পরিচিত। ইহারা চৌদ্দ চৌধুরির এক চৌধুরি বলিয়া প্রসিদ্ধ।

গশবাড়ির নাগবংশও বিশেষ মাননীয়।

তাড়াষের জমিদার বংশ-তাড়াষ বিল চলনের নিকটবর্তী গ্রাম। পূর্বে এই গ্রাম রাজসাহী

প্রদেশের অন্তর্গত ছিল। এইক্ষণ এই গ্রাম পাবনা জেলার অন্তর্গত। চড়িয়ার দেব বংশোদ্ভব বলরাম নামক এক ব্যক্তি বারেন্দ্র কায়স্থ সমাজে বিশেষ পরিচিত ছিলেন। এই ব্যক্তি নাটোর রাজ সংসারে প্রধান কার্যকারক ছিলেন। এই সময় কুসুম্বি পরগণা প্রভৃতি বিস্তর জমিদারি লাভ করেন। “ধনেনকুল” এই বাক্যের সার্থকতা লাভ করেন। সুতরাং সমাজে বিশেষ পরিচিত হইলেন। রাজসাহী ও পাবনা জেলায় বিস্তৃত জমিদারি লাভ করিয়া তাড়াষ গ্রামে বাস নির্দেশ করেন। বর্তমান তাড়াষের প্রধান জমিদারগণ এই বলরাম রায়ের বংশ সম্ভূত।

রঙ্গুর জেলার অন্তর্গত বর্ধন কুঠির জমিদার দেব বংশীয়। এই বংশে ভগবান নামক এক ব্যক্তি মানসিংহের সময় রাজা উপাধি প্রাপ্ত হন। ঐ জেলার অন্তর্গত কাকিনার জমিদারও কুলীন নহে। কিন্তু বিস্তৃত জমিদারি লাভ করিয়া, সমাজে এ বংশ প্রসিদ্ধ হইয়াছিল।

এই বারেন্দ্র শ্রেণি কায়স্থগণের আচার ব্যবহার, সামাজিক রীতিনীতি বঙ্গজ ও রাঢ়ীয় শ্রেণি কায়স্থগণের সঙ্গে কোন অংশ মিল নাই। রাজসাহীতে ২/৪ ঘর বঙ্গজ কায়স্থের বাস; অবশিষ্ট কায়স্থ সমুদয় বারেন্দ্র শ্রেণি। এই রাজসাহীতে আচার ভ্রষ্ট কায়স্থও কম নহে। ইহারা বারেন্দ্র শ্রেণি বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকে। কিন্তু বারেন্দ্র শ্রেণি সদাচারী সদ্বংশজাত কায়স্থগণের সহিত ইহারা আহার ব্যবহার করণকারণ কিছুই করিতে পারে না। ইহারা প্রায়ই অশিক্ষিত। রাজসাহীতে সর্বসমেত বারেন্দ্র কায়স্থ ১০০০ ঘরের কম হইবে না। ডাঙাপাড়া, মাঝগ্রাম, বারিয়াহাটি, ঢাকঢোর, ছাতারপাড়া, করচমাড়িয়া, মুরাদপুর প্রভৃতি স্থানে সদাচারী সদ্বংশজাত ধনী বারেন্দ্র কায়স্থের বাস। ইহাদের অনেকেই সুশিক্ষিত।

৬। নবশাখ বা নবশায়ক-শূদ্রজাতি নয় শাখায় বিভক্ত বলিয়া এই জাতির নাম নবশাখ হয়। তিলি, মালি, তামুলি, গোপ, নাপিত, গোছালি, কামার, কুমার, পুঁটুলি এই নয় জাতি নবশাখ আখ্যায় পরিচিত।২২ ইহাদের ব্যবসায় অনুযায়ী জাতি নির্ণয় করা হইয়াছে। অতিপুরাকালে আর্যজাতিরা যাহাদের পরাজিত করিয়া বন্দি করেন, তাহারা আচারভ্রষ্ট শূদ্র

আখ্যা প্রাপ্ত হইয়া ত্রৈবর্ণের কার্যে নিযুক্ত হয়। তখন সংসার যাত্রা নির্বাহ জন্য স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র

ব্যবসায়ী জাতিরও প্রয়োজন হইল। সে সময় ত্রৈবর্ণের নিচে শূদ্র ভিন্ন অন্য জাতি ছিল না।

সুতরাং শূদ্রগণের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসায়ী লোকের সৃষ্টি হইল। এই আচারভ্রষ্ট শূদ্রগণ মধ্যে যাহারা ত্রৈবর্ণের সেবায় বা সংস্রবে জ্ঞান লাভ করেন, তাহারা শূদ্র মধ্যে উৎকর্ষ লাভ করিয়া সম্মানিত হইতে লাগিলেন এবং যাহারা অজ্ঞানই রহিল বা নিকৃষ্ট কর্মে রত হইল, তাহারা নিকৃষ্ট শূদ্র শ্রেণিতে পরিগণিত হইল। এই অপেক্ষাকৃত জ্ঞানী শূদ্রগণ উল্লিখিত নয় শাখায় বিভক্ত হইয়া ব্যবসানুযায়ী নবশাখ বলিয়া পরিচিত হইল। ইহাই বেশি সম্ভব। কিন্তু “সম্বন্ধ নির্ণয়ের” গ্রন্থকার পণ্ডিত প্রবর লালমোহন বিদ্যানিধি মহাশয় নবশাখের অন্যরূপ ব্যাখ্যা করেন। “যৎকালে মহাবীর পরশুরাম পৃথিবীকে একবিংশতিবার নিঃক্ষত্রিয় করেন তৎকালে

এই কয়েক জাতির সাহায্য লইয়া তিনি ক্ষত্রিয় বংশের ধ্বংস করিতে সমর্থ হন। ইহাদিগেরই সাহায্যে পরশুরামের প্রতিজ্ঞা সিদ্ধ হয় (অর্থাৎ ক্ষত্রিয়কুলের বিনাশ বিষয়ে ইহারা শায়ক (বান) স্বরূপ হয়)। ইহারা পূর্বে কায়স্থের তুল্য ছিল না; ঐ সময়াবধি কায়স্থের তুল্য হয়। পরশুরাম দ্বারা সমাজ মধ্যে এতাদৃশ মর্যাদা পাইয়াই ইহারা ক্ষত্রিয়দিগের বিরুদ্ধে উত্থান করিয়াছিল”। এই উদ্ধৃত অংশ পৌরাণিক কথা। ইহার সারাংশ গ্রহণ করিলে, ইহা প্রতীত হইবে নবশাখ শূদ্রজাতি এবং ক্ষত্রিয়ের নিচ বলিয়া তাহাদের বিরুদ্ধে উত্থান হয়। এস্থলে ইহাও বলা যাইতে পারে যে, যদি কায়স্থ ক্ষত্রিয় না হইয়া নবশাখের মত শূদ্রজাতি হইত, তাহা হইলে কায়স্থ ও ক্ষত্রিয়ের ধ্বংস জন্য পরশুরামকে সাহায্য করিত। আবার “শায়ক” শব্দের সহিত “নব” শব্দ সংযোজিত করিলে “নবশায়ক” হইল। তবে কি “নবশায়ক” শব্দে “নূতনবান” কি “নয়বান” বুঝাইবে। “নবশায়ক” শব্দে নূতন বান বা নয়বান বুঝাইতে পারে। শূদ্রেরা নূতনবান গ্রহণ করিয়া ক্ষত্রিয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বা শূদ্রের নয় শ্রেণি একত্রিত হইয়া যুদ্ধ করে এই হেতু ইহারা নবশায়ক বা নবশাক নাম ধারণ করিল। অতএব উদ্ধৃত অংশের উপর ভিত্তিস্থাপন করিয়া নবশাক না বলিয়া নবশায়ক বলিলেও কোন বিশেষ ক্ষতি দেখি না। আবার বিদ্যানিধি মহাশয় বলিয়াছেন নবশাকেরা “সচ্ছদ্র বলিয়া পরিগণিত”। আমরা বিদ্যানিধি মহাশয়ের পক্ষ সমর্থন করিতে পারিলাম না। ধরণীকোষ মতে সচ্ছদ্র কেবল ক্ষত্রিয়কেই বুঝায়। ইহা নিম্ন উদ্ধত শ্লোকে প্রমাণ হইবে।-

“সজ্জুদ্র, মসীশদেব কায়স্থশ্চ শ্রীবৎসজঃ।

অন্বষ্ঠো মাথুরীভট্টঃ সূর্যধ্বজশ্চ গৌড়কঃ।।”

ধরণী মতে কায়স্থ ক্ষত্রিয় এবং ক্ষত্রিয় সচ্ছদ্র। আবার স্কন্দপুরাণ মতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, সচ্ছদ্র এবং ইহারা শালগ্রামশীলা স্পর্শ করিতে সক্ষম। এ বিষয়ে নিম্নবচনে প্রমাণ হইবে:-

“ব্রাহ্মণ ক্ষত্র বৈশ্যানাং সচ্ছদ্রানা মথাপিবা।

শালগ্রামেহধিকারোক্তি নচান্যেষাং কদাচন।।”

নবশাখ যে সচ্ছদ্র নহে তাহার সন্দেহ রহিল না। নবশাখ শূদ্রজাতীয়। কিন্তু ইহারা ভাল শূদ্র এবং ইহাদের স্পর্শীয় জল সকল জাতিই পান করিতে পারে। “নবশাখেরা কায়স্থ সদৃশ সদাচার সম্পন্ন। ইহাদিগের পুরোহিত ও কায়স্থদিগের পুরোহিত এক।”২০ একথা কতদূর ঠিক তাহা আমরা বলিতে পারি না। পূর্ববঙ্গে যে সকল বঙ্গজ কায়স্থ বসতি করিতেছেন, তাহাদের এবং সেই দেশবাসী নাবশাখ বিধবা রমণীদের আচার ব্যবহার ও ক্রিয়াকলাপ দেখিলে “নবশাখেরা কায়স্থ সদৃশ সদাচার সম্পন্ন” বলা ভ্রমপদ হইবে। বঙ্গজ কায়স্থ সমাজে বিধবা রমণীদের আচার ব্যবহার ঠিক ব্রাহ্মণ বিধবা রমণীর ন্যায়। বঙ্গের কায়স্থ বিধবা রমণী ব্রহ্মচর্য-ব্রত-চারিণী। পক্ষান্তরে নবশাখ বিধবা রমণীগণেরা ব্রহ্মচর্য ব্রতচারিণী নহে। ইহাদের মধ্যে অনেকেই স্বেচ্ছাচারিণী। এই রূপে কায়স্থ ও নবশাখ পুরুষদের আচার ব্যবহারে অনেক প্রভেদ আছে। পূর্ববঙ্গে নবশাখেরা বঙ্গজ কায়স্থদের ব্রাহ্মণের ন্যায় সম্মান করিয়া থাকে। কিন্তু রাজসাহীতে এরূপ ভাব দেখা যায় না। এজেলায় নবশাখদের মধ্যে অনেক বিধবা রমণী ব্রহ্মচর্য-ব্রত-চারিণী নহে এবং পুরুষেরাও যথেষ্ট আচার ভ্রষ্ট। রাজসাহীর নবশাখেরা কায়স্থদের ব্রাহ্মণের ন্যায় সম্মান করে না। ইহার কারণ এই যে রাজসাহীতে বারেন্দ্র কায়স্থের সমাজ প্রধান, বঙ্গজ কায়স্থ দুই চারি ঘর মাত্র আছে। বারেন্দ্র কায়স্থের আচার ব্যবহার বঙ্গজ কায়স্থের সদৃশ নয় বলিয়াই নবশাখেরা রাজসাহীর কায়স্থদের বঙ্গজ কায়স্থদের ন্যায় সম্মান করে না। মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের কাল হইতে নবদ্বীপ এবং তন্নিকটবর্তী স্থানের নবশাখগণের আচার ব্যবহার অনেক সংশোধিত হইয়াছে বলিয়া সেই প্রদেশের নবশাখদের আচার ব্যবহার দক্ষিণ

রাঢ়ীয় কায়স্থ সদৃশ দেখা যায়। আমরা স্বীকার করি নবশাখের শিক্ষা, সভ্যতা, ধন ও সম্মান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের আচার ব্যবহারের অনেক পরিবর্তন হইতেছে। এমতাবস্থায়ও দেখিতে পাওয়া যায় যে অনেক স্থলে বঙ্গজ কায়স্থের ও নবশাখের পুরোহিত এক নহে। অনেক বঙ্গজ কায়স্থও নবশাখের পুরোহিত দ্বারা ক্রিয়া কলাপ নির্বাহ করান না। পক্ষান্তরে ইহাও দেখা যায় ব্রাহ্মণ ও কায়স্থের পুরোহিত এক। তাই বলিয়া কি কায়স্থ ব্রাহ্মণ সদৃশ হইতে পারে?

(১) তিলি-তিল শস্য বিক্রেতাকে আদিতে তিলি জাতি বলিত। এক্ষণ ব্যবসায়ী জাতিকে তিলি বলে। রাজসাহীতে পাঁচুপুর, গোবিন্দপুর, হাতিয়ানদহ, আড়ানী, মালঞ্চি প্রভৃতি স্থানে তিলি জাতীয় অনেক ধনী লোক আছে। তিলি জাতির মধ্যে দিঘাপতিয়ার রাজা প্রসিদ্ধ। এই ডিলি জাতিতে প্রায়শই দরিদ্র নাই। এই জাতির আর একটি শ্রেণি তেলি নামে কথিত আছে। ইহারা তৈলবিক্রেতা। কোন কোন স্থানে তেলি জল-অনাচরণীয় জাতি বলিয়া প্রসিদ্ধ।

(২) মালি-ইহারা মালকার নামে প্রসিদ্ধ। ইহাদের ব্যবসা পুষ্পচয়ন করা এবং মালা গ্রন্থন দেওয়া। অধুনা ইহারা বিবাহ, চূড়াকরণ প্রভৃতি মাঙ্গলিক কার্যে শোলার মুকুট ও ফুল প্রস্তুত এবং দেবপ্রতিমাদি চিত্র করিয়া থাকে।

(৩) তামূলি-ইহাদের আদি ব্যবসা পান বিক্রয় করা। এই রাজসাহীতে গোয়ালকান্দি ও আমরাইল গ্রামে যে তামুলি আছে তাহারা জমিদার। তামুলিরা কুসিদজীবী। ইহা কথিত আছে যে তামুলিরা এত বেশি হারে সুদ গ্রহণ করিত যে অধমর্ণেরা এত বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট হইয়াছিল যে প্রায় ৬৫ কি ৭০ বৎসর পূর্বে ‘তামুলি লুট’ নামে একটি বৃহদাকারে বড়গাছিতে তামুলির বাড়ি লুট হয়। বড়গাছি রামপুর-বোয়ালিয়া হইতে প্রায় ১২ মাইল উত্তর। তাহিরপুর পরগণার প্রজারাই বেশি প্রপীড়িত হয়। ইহারা ও অন্যান্য প্রজারা লুট করে। খত, খাতা, ও যাবতীয় কাগজপত্র অগ্নিসাৎ করে। এই ঘটনা হইতে তামুলি জাতিকে সেক্সপিয়ারের সাইলক (Shy-lock) বলিলে অত্যুক্তি হইত না। এক্ষণ তামুলি জাতির কুসিদ ব্যবসায় উন্নতি নাই। এক্ষণ প্রায় সকল জাতিই কুসিদজীবী।

(৪) গোপ-শব্দার্থে গো রক্ষককে গোপ বলে। বঙ্গের দক্ষিণ ভাগে সদ্‌দগোপকে গোপ বলে। ইহাদের সাধারণ ব্যবসা কৃষি। হুগলি জেলাতে অনেক সদ্বংশজাত শিক্ষিত সঙ্গোপের বাস। কিন্তু ঐ দেশে যাহাদের গোয়ালা বলে তাহারা নবশাখ নহে এবং তাহারা অনাচরণীয়। রাজসাহীতে যাহাদের গোপ বলে তাহারা দধি দুগ্ধ ব্যবসায়ী এবং তাহারা জল আচরণীয়। রাজসাহীতে দক্ষিণ দেশের ন্যায় গোয়ালা নাই। দক্ষিণদেশ সদৃশ সদগোপ এ জেলায় অতি অল্প সংখ্যক। ইহাদের ব্যবসা কৃষি। ইহাদের কুটুম্ব হুগলি, বীরভূম, বাঁকুড়া প্রভৃতি জেলায় আছে।

(৫) নাপিত-ইহাদের ব্যবসা ক্ষৌর কার্য। মহাপ্রভু চৈতন্যদেব সন্ন্যাস গ্রহণ সময় মধু নাপিত তাহার মস্তক মুণ্ডন করে। এই সময় হইতে মধু নাপিতের বংশধরেরা ক্ষৌর কর্ম ত্যাগ করিয়া মোদকাদি প্রস্তুত এবং বিক্রয় করে। রাজসাহীর অন্তর্গত কলম, ডায়া প্রভৃতি গ্রামে কতিপয় মধুবংশীয় নাপিত আছে।

(৬) গোছালি-ইহারা পান প্রস্তুত করে এবং বিক্রয় করে। ইহাদের সাধারণত ‘পানতীয়া’ বা বারুই বলে। গুচ্ছ শব্দে আঁটি বুঝায়। যে পানের আঁটি বা গুচ্ছ বাঁধে তাহাকে গোছালি বলা যায়।

(৭) কামার-ইহারা লৌহদ্রব্য প্রস্তুত এবং বিক্রয় করে।

(৮) কুমার-ইহারা মৃন্ময় ঘটাদি প্রস্তুত এবং বিক্রয় করে।

(৯) পুটুলি-গন্ধবণিক, শঙ্খবণিক, তত্ত্ববায়, ময়রা এই কয়েক জাতি পুঁটুলি বলিয়া