১১:১৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫

আফ্রিকার প্রকৃত আকার

মানচিত্রে আফ্রিকার বিকৃতি

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিশ্বের মানচিত্রগুলো আফ্রিকার প্রকৃত আকার বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছে। ষোড়শ শতকে তৈরি হওয়া মারকেটর মানচিত্র বিশ্বজুড়ে নৌ-পরিচালনা ও শিক্ষার মানদণ্ডে ব্যবহৃত হলেও এটি নিরক্ষীয় রেখা থেকে দূরের ভূখণ্ডগুলোকে বড় দেখায়। ফলে গ্রিনল্যান্ডকে প্রায় আফ্রিকার সমান দেখায়, অথচ বাস্তবে আফ্রিকা গ্রিনল্যান্ডের চেয়ে প্রায় ১৪ গুণ বড়।

কানাডা ও রাশিয়ার মতো উত্তরাঞ্চলীয় দেশগুলোও আফ্রিকার তুলনায় ছোট হলেও মারকেটর মানচিত্রে সেগুলোকে সমান বা বড় আকারে দেখা যায়। বাস্তবে আফ্রিকা কানাডার তিনগুণ এবং রাশিয়ার দেড়গুণ বড়।

“সঠিক মানচিত্র” আন্দোলন

আফ্রিকান ইউনিয়ন (এউ) সম্প্রতি “Correct The Map” নামের এক প্রচারণাকে সমর্থন দিয়েছে। এই প্রচারণা মারকেটরের পরিবর্তে “ইক্যুয়াল আর্থ প্রজেকশন (Equal Earth Projection)” মানচিত্র ব্যবহারের আহ্বান জানায়, যেখানে দেশগুলোর আকার প্রকৃত অনুপাতে উপস্থাপন করা হয়।

আফ্রিকা নো ফিল্টারের নির্বাহী পরিচালক মোকি মাকুরা বলেন, “আফ্রিকার মানচিত্রের বর্তমান আকার ভুল। এটি ইতিহাসের দীর্ঘতম ভ্রান্ত তথ্য প্রচারণা, যা এখনই বন্ধ হওয়া উচিত।”

এউ কমিশনের ডেপুটি চেয়ারপারসন সেলমা মালিকা হাদ্দাদি জানান, এটি কেবল মানচিত্রের বিষয় নয়। মারকেটর মানচিত্র আফ্রিকাকে ‘অপ্রধান’ হিসেবে উপস্থাপন করেছে, অথচ বাস্তবে এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাদেশ এবং এর জনসংখ্যা একশো কোটিরও বেশি।

বিকৃতির প্রযুক্তিগত দিক

যে কোনো মানচিত্রে কিছু বিকৃতি অনিবার্য, কারণ গোলাকার পৃথিবীকে সমতল কাগজে ফুটিয়ে তোলা সহজ নয়। যেমন কমলা ছাড়িয়ে সমানভাবে বিছাতে গেলে খোসা ফেটে যায় বা টেনে প্রসারিত হয়।

ফ্লেমিশ কার্টোগ্রাফার জেরার্ডাস মারকেটর পৃথিবীকে সিলিন্ডারের ওপর প্রক্ষেপণ করেন। এই পদ্ধতি নৌ-চালনার জন্য উপযোগী হলেও দূরবর্তী উত্তরাঞ্চলীয় দেশগুলোকে অতিরিক্ত বড় দেখায়। ফলস্বরূপ শিক্ষার্থীরা গ্রিনল্যান্ড, কানাডা বা রাশিয়াকে আফ্রিকার সমান বা তার থেকেও বড় ভেবে এসেছে।

নতুন মানচিত্রের পক্ষে যুক্তি

“Correct The Map” প্রচারণা, যা ‘আফ্রিকা নো ফিল্টার’ ও ‘স্পিক আপ আফ্রিকা’ পরিচালনা করছে, ২০১৮ সালের ইক্যুয়াল আর্থ প্রজেকশন গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছে। এই মানচিত্রে আফ্রিকার প্রকৃত আকারে দেখা যায় যে, পুরো আফ্রিকার ভেতর যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ও ইউরোপের অধিকাংশ দেশ সহজেই বসানো যায়—যা মারকেটরের মানচিত্রে বোঝা যায় না।

মানচিত্র ও রাজনীতি

প্রত্যেক প্রক্ষেপণেরই সুবিধা-অসুবিধা রয়েছে। কিছু মানচিত্র আকার ঠিক রাখে, কিন্তু দূরত্ব ও দিক বিকৃত করে। আবার কিছু মানচিত্র আয়তন সঠিক দেখালেও আকৃতি বা অনুপাত বদলে দেয়। এসব পার্থক্য কেবল প্রযুক্তিগত নয়; প্রায়ই রাজনীতি ও শক্তির প্রতীক হিসেবে কাজ করে।

কারিবিয়ান কমিউনিটি (CARICOM) রিপারেশন কমিশনের সহ-সভাপতি ডরব্রেন ও’মার্ডে ইক্যুয়াল আর্থ প্রজেকশনকে সমর্থন জানিয়ে বলেন, মারকেটর মানচিত্রের “ক্ষমতা ও আধিপত্যের মতাদর্শ” প্রত্যাখ্যান করাই এর লক্ষ্য।

আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থান

আফ্রিকান ইউনিয়নসহ আঞ্চলিক সংগঠনগুলো বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘকে ইক্যুয়াল আর্থ প্রজেকশন গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, তারা উইঙ্কেল ট্রিপেল বা ইক্যুয়াল আর্থ প্রক্ষেপণ ব্যবহার করছে এবং ওয়েব মানচিত্রে মারকেটর ধীরে ধীরে বাদ দিচ্ছে।

গুগল ম্যাপস ২০১৮ সালে ডেস্কটপে মারকেটরের পরিবর্তে থ্রিডি (3D) গ্লোব ভিউ চালু করে, যদিও ব্যবহারকারীরা চাইলে মারকেটরে ফিরে যেতে পারে। তবে মোবাইল অ্যাপে এখনও মারকেটরই পূর্বনির্ধারিত (ডিফল্ট) হিসেবে রয়ে গেছে।

আফ্রিকার প্রকৃত আকার সম্পর্কে ভুল ধারণা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকে আছে। আজ নতুন মানচিত্র পদ্ধতি—ইক্যুয়াল আর্থ প্রজেকশন—আফ্রিকাকে তার প্রকৃত পরিসরে দেখাচ্ছে, যা শুধু ভৌগোলিক তথ্য নয়, বৈশ্বিক রাজনীতি ও ক্ষমতার ভারসাম্য সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে।

জনপ্রিয় সংবাদ

আফ্রিকার প্রকৃত আকার

১১:০০:২৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মানচিত্রে আফ্রিকার বিকৃতি

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিশ্বের মানচিত্রগুলো আফ্রিকার প্রকৃত আকার বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছে। ষোড়শ শতকে তৈরি হওয়া মারকেটর মানচিত্র বিশ্বজুড়ে নৌ-পরিচালনা ও শিক্ষার মানদণ্ডে ব্যবহৃত হলেও এটি নিরক্ষীয় রেখা থেকে দূরের ভূখণ্ডগুলোকে বড় দেখায়। ফলে গ্রিনল্যান্ডকে প্রায় আফ্রিকার সমান দেখায়, অথচ বাস্তবে আফ্রিকা গ্রিনল্যান্ডের চেয়ে প্রায় ১৪ গুণ বড়।

কানাডা ও রাশিয়ার মতো উত্তরাঞ্চলীয় দেশগুলোও আফ্রিকার তুলনায় ছোট হলেও মারকেটর মানচিত্রে সেগুলোকে সমান বা বড় আকারে দেখা যায়। বাস্তবে আফ্রিকা কানাডার তিনগুণ এবং রাশিয়ার দেড়গুণ বড়।

“সঠিক মানচিত্র” আন্দোলন

আফ্রিকান ইউনিয়ন (এউ) সম্প্রতি “Correct The Map” নামের এক প্রচারণাকে সমর্থন দিয়েছে। এই প্রচারণা মারকেটরের পরিবর্তে “ইক্যুয়াল আর্থ প্রজেকশন (Equal Earth Projection)” মানচিত্র ব্যবহারের আহ্বান জানায়, যেখানে দেশগুলোর আকার প্রকৃত অনুপাতে উপস্থাপন করা হয়।

আফ্রিকা নো ফিল্টারের নির্বাহী পরিচালক মোকি মাকুরা বলেন, “আফ্রিকার মানচিত্রের বর্তমান আকার ভুল। এটি ইতিহাসের দীর্ঘতম ভ্রান্ত তথ্য প্রচারণা, যা এখনই বন্ধ হওয়া উচিত।”

এউ কমিশনের ডেপুটি চেয়ারপারসন সেলমা মালিকা হাদ্দাদি জানান, এটি কেবল মানচিত্রের বিষয় নয়। মারকেটর মানচিত্র আফ্রিকাকে ‘অপ্রধান’ হিসেবে উপস্থাপন করেছে, অথচ বাস্তবে এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাদেশ এবং এর জনসংখ্যা একশো কোটিরও বেশি।

বিকৃতির প্রযুক্তিগত দিক

যে কোনো মানচিত্রে কিছু বিকৃতি অনিবার্য, কারণ গোলাকার পৃথিবীকে সমতল কাগজে ফুটিয়ে তোলা সহজ নয়। যেমন কমলা ছাড়িয়ে সমানভাবে বিছাতে গেলে খোসা ফেটে যায় বা টেনে প্রসারিত হয়।

ফ্লেমিশ কার্টোগ্রাফার জেরার্ডাস মারকেটর পৃথিবীকে সিলিন্ডারের ওপর প্রক্ষেপণ করেন। এই পদ্ধতি নৌ-চালনার জন্য উপযোগী হলেও দূরবর্তী উত্তরাঞ্চলীয় দেশগুলোকে অতিরিক্ত বড় দেখায়। ফলস্বরূপ শিক্ষার্থীরা গ্রিনল্যান্ড, কানাডা বা রাশিয়াকে আফ্রিকার সমান বা তার থেকেও বড় ভেবে এসেছে।

নতুন মানচিত্রের পক্ষে যুক্তি

“Correct The Map” প্রচারণা, যা ‘আফ্রিকা নো ফিল্টার’ ও ‘স্পিক আপ আফ্রিকা’ পরিচালনা করছে, ২০১৮ সালের ইক্যুয়াল আর্থ প্রজেকশন গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছে। এই মানচিত্রে আফ্রিকার প্রকৃত আকারে দেখা যায় যে, পুরো আফ্রিকার ভেতর যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ও ইউরোপের অধিকাংশ দেশ সহজেই বসানো যায়—যা মারকেটরের মানচিত্রে বোঝা যায় না।

মানচিত্র ও রাজনীতি

প্রত্যেক প্রক্ষেপণেরই সুবিধা-অসুবিধা রয়েছে। কিছু মানচিত্র আকার ঠিক রাখে, কিন্তু দূরত্ব ও দিক বিকৃত করে। আবার কিছু মানচিত্র আয়তন সঠিক দেখালেও আকৃতি বা অনুপাত বদলে দেয়। এসব পার্থক্য কেবল প্রযুক্তিগত নয়; প্রায়ই রাজনীতি ও শক্তির প্রতীক হিসেবে কাজ করে।

কারিবিয়ান কমিউনিটি (CARICOM) রিপারেশন কমিশনের সহ-সভাপতি ডরব্রেন ও’মার্ডে ইক্যুয়াল আর্থ প্রজেকশনকে সমর্থন জানিয়ে বলেন, মারকেটর মানচিত্রের “ক্ষমতা ও আধিপত্যের মতাদর্শ” প্রত্যাখ্যান করাই এর লক্ষ্য।

আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থান

আফ্রিকান ইউনিয়নসহ আঞ্চলিক সংগঠনগুলো বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘকে ইক্যুয়াল আর্থ প্রজেকশন গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, তারা উইঙ্কেল ট্রিপেল বা ইক্যুয়াল আর্থ প্রক্ষেপণ ব্যবহার করছে এবং ওয়েব মানচিত্রে মারকেটর ধীরে ধীরে বাদ দিচ্ছে।

গুগল ম্যাপস ২০১৮ সালে ডেস্কটপে মারকেটরের পরিবর্তে থ্রিডি (3D) গ্লোব ভিউ চালু করে, যদিও ব্যবহারকারীরা চাইলে মারকেটরে ফিরে যেতে পারে। তবে মোবাইল অ্যাপে এখনও মারকেটরই পূর্বনির্ধারিত (ডিফল্ট) হিসেবে রয়ে গেছে।

আফ্রিকার প্রকৃত আকার সম্পর্কে ভুল ধারণা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকে আছে। আজ নতুন মানচিত্র পদ্ধতি—ইক্যুয়াল আর্থ প্রজেকশন—আফ্রিকাকে তার প্রকৃত পরিসরে দেখাচ্ছে, যা শুধু ভৌগোলিক তথ্য নয়, বৈশ্বিক রাজনীতি ও ক্ষমতার ভারসাম্য সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে।