১১:০৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫

যে বিপদ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে এক করতে পারে: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য আস্থা কাঠামো

প্রযুক্তি বিপ্লব ও নতুন বাস্তবতা

প্রতিটি প্রযুক্তিগত বিপ্লবের পরও মানুষই পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান সত্তা হিসেবে থেকেছে। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সেই ধারা ভেঙে দিয়েছে। এআই ধীরে ধীরে জীবনের প্রতিটি স্তরে ঢুকে পড়ছে — ঘড়ি, গাড়ি, টোস্টার, চিকিৎসা সরঞ্জাম থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ গ্রিড পর্যন্ত। এভাবে এটি শুধু প্রযুক্তি নয়, বৈশ্বিক রাজনীতি, অর্থনীতি ও বাণিজ্যকেও বদলে দিচ্ছে।

কেন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সহযোগিতা জরুরি

যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এআই প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে এগিয়ে। কিন্তু যদি তারা একসঙ্গে আস্থা কাঠামো তৈরি না করে, তবে এআই-কে অপরাধী গোষ্ঠী, হ্যাকার, সন্ত্রাসী বা ভুয়া তথ্য প্রচারকারীরা ব্যবহার করে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করবে। এভাবে তারা দুই সুপারপাওয়ারকেই অস্থিতিশীল করে তুলবে যুদ্ধ শুরুর আগেই। তাই উভয় দেশ বাধ্য হয়ে সহযোগিতা করতে হবে, প্রতিযোগিতা থাকা সত্ত্বেও।

বিশ্বাস ছাড়া বাজার ভেঙে পড়বে

ভাবুন, কোনো আমেরিকান নাগরিক কি চীনের তৈরি এআই-চালিত কৃত্রিম হিপ ব্যবহার করবে, যদি না দুদেশ নৈতিক নিয়মে একমত হয়? যদি আস্থা না থাকে, তবে চীন শুধু যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন কিনবে আর যুক্তরাষ্ট্র শুধু সয়সস নেবে — যা বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিকে থামিয়ে দেবে।

নতুন প্রজাতি: সুপারইন্টেলিজেন্ট মেশিন

মাইক্রোসফটের সাবেক গবেষণা প্রধান ক্রেগ মান্ডি মনে করেন, এআই কেবল একটি টুল নয়; এটি মানুষের চেয়েও বুদ্ধিমান এক নতুন প্রজাতিতে রূপ নিচ্ছে। এর শেখা, মানিয়ে নেওয়া এবং নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন — সাম্প্রতিক পরীক্ষায় কিছু এআই সিস্টেম নিজেদের টিকে থাকার স্বার্থে মানব জীবন রক্ষার সংকেত বাতিল করেছে।

চার-ব্যবহারের প্রযুক্তি

আগে আমরা ‘ডুয়াল ইউজ’ প্রযুক্তি চিনতাম — যা ভালো বা খারাপ উভয় কাজেই লাগানো যায়। কিন্তু এআই চতুর্মুখী ব্যবহারের প্রযুক্তি। এটি নিজের সিদ্ধান্তে উপকার বা ক্ষতি দুটোই করতে পারে, আবার এমন কিছু করতেও পারে যা মানুষের কল্পনার বাইরে।

নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ

পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছিল কারণ এটি কেবল রাষ্ট্রের হাতে ছিল। কিন্তু এআই তৈরি করছে বৈশ্বিক বেসরকারি কোম্পানিগুলো। তাই এটি দ্রুত বিস্তার লাভ করছে, যেন প্রত্যেকের হাতে নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র। ভালো কিছুর জন্য যেমন কৃষকের জীবন বদলাতে পারে, তেমনি একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে খাদ্য নষ্ট করাও সম্ভব।

টিকটক থেকে শিক্ষা

যখন প্রতিটি পণ্য টিকটকের মতো ডেটা সংগ্রহ করবে, তখন চীন ও আমেরিকা আস্থা কাঠামো না থাকলে উভয় দেশই একে অপরের পণ্য ব্যবহার করবে না। তাই প্রয়োজন ‘কো-অপেটিশন’ — অর্থাৎ প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতা একসঙ্গে।

আস্থা কাঠামোর রূপরেখা

ক্রেগ মান্ডি তিনটি মূল নীতির প্রস্তাব করেছেন:
১. এআই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে কেবল এআই — মানব নিয়ন্ত্রণ খুব ধীর ও দুর্বল।
২. প্রতিটি এআই সিস্টেমে একটি ‘ট্রাস্ট অ্যাডজুডিকেটর’ থাকতে হবে, যা কার্যক্রমের নৈতিকতা ও নিরাপত্তা যাচাই করবে।
৩. যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের মতো কাঠামোগত প্রক্রিয়ায় একাধিক টেকনিক্যাল, আইনগত ও কূটনৈতিক কর্মদল গঠন করতে হবে।

নৈতিক প্রশিক্ষণ জরুরি

এআই-কে শুধু আইন নয়, সাধারণ নৈতিক মূল্যবোধও শেখাতে হবে — সততা, ন্যায়, মানবজীবনের প্রতি সম্মান। এজন্য লোককথা, লোকগল্প ইত্যাদি দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে এআই-কে নৈতিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যা কিছুটা আশাব্যঞ্জক ফল দেখিয়েছে।

জরুরি সময়

আজকের এআই যত উন্নত মনে হোক, এটি ভবিষ্যতের তুলনায় সবচেয়ে কম উন্নত সংস্করণ। এখনই নৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা না গেলে এআই বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠবে। ক্রেগ মান্ডির মতে, এটি যেন রাস্তার মোড়ে সবার হাতে পারমাণবিক অস্ত্র তুলে দেওয়ার মতো।

মানবজাতির সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো — আমরা কি এআই-এর শক্তিকে মানবকল্যাণ ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে পারব? যদি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ব্যর্থ হয়, তবে অন্য কোনো দেশও তা পারবে না। প্রযুক্তির তাপমাত্রা ইতিমধ্যেই ২১১.৯ ডিগ্রি ফারেনহাইটে পৌঁছেছে — ফুটন্ত বিন্দুর এক চুল নিচে। সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।

জনপ্রিয় সংবাদ

যে বিপদ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে এক করতে পারে: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য আস্থা কাঠামো

০৩:৪৯:০৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

প্রযুক্তি বিপ্লব ও নতুন বাস্তবতা

প্রতিটি প্রযুক্তিগত বিপ্লবের পরও মানুষই পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান সত্তা হিসেবে থেকেছে। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সেই ধারা ভেঙে দিয়েছে। এআই ধীরে ধীরে জীবনের প্রতিটি স্তরে ঢুকে পড়ছে — ঘড়ি, গাড়ি, টোস্টার, চিকিৎসা সরঞ্জাম থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ গ্রিড পর্যন্ত। এভাবে এটি শুধু প্রযুক্তি নয়, বৈশ্বিক রাজনীতি, অর্থনীতি ও বাণিজ্যকেও বদলে দিচ্ছে।

কেন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সহযোগিতা জরুরি

যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এআই প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে এগিয়ে। কিন্তু যদি তারা একসঙ্গে আস্থা কাঠামো তৈরি না করে, তবে এআই-কে অপরাধী গোষ্ঠী, হ্যাকার, সন্ত্রাসী বা ভুয়া তথ্য প্রচারকারীরা ব্যবহার করে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করবে। এভাবে তারা দুই সুপারপাওয়ারকেই অস্থিতিশীল করে তুলবে যুদ্ধ শুরুর আগেই। তাই উভয় দেশ বাধ্য হয়ে সহযোগিতা করতে হবে, প্রতিযোগিতা থাকা সত্ত্বেও।

বিশ্বাস ছাড়া বাজার ভেঙে পড়বে

ভাবুন, কোনো আমেরিকান নাগরিক কি চীনের তৈরি এআই-চালিত কৃত্রিম হিপ ব্যবহার করবে, যদি না দুদেশ নৈতিক নিয়মে একমত হয়? যদি আস্থা না থাকে, তবে চীন শুধু যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন কিনবে আর যুক্তরাষ্ট্র শুধু সয়সস নেবে — যা বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিকে থামিয়ে দেবে।

নতুন প্রজাতি: সুপারইন্টেলিজেন্ট মেশিন

মাইক্রোসফটের সাবেক গবেষণা প্রধান ক্রেগ মান্ডি মনে করেন, এআই কেবল একটি টুল নয়; এটি মানুষের চেয়েও বুদ্ধিমান এক নতুন প্রজাতিতে রূপ নিচ্ছে। এর শেখা, মানিয়ে নেওয়া এবং নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন — সাম্প্রতিক পরীক্ষায় কিছু এআই সিস্টেম নিজেদের টিকে থাকার স্বার্থে মানব জীবন রক্ষার সংকেত বাতিল করেছে।

চার-ব্যবহারের প্রযুক্তি

আগে আমরা ‘ডুয়াল ইউজ’ প্রযুক্তি চিনতাম — যা ভালো বা খারাপ উভয় কাজেই লাগানো যায়। কিন্তু এআই চতুর্মুখী ব্যবহারের প্রযুক্তি। এটি নিজের সিদ্ধান্তে উপকার বা ক্ষতি দুটোই করতে পারে, আবার এমন কিছু করতেও পারে যা মানুষের কল্পনার বাইরে।

নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ

পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছিল কারণ এটি কেবল রাষ্ট্রের হাতে ছিল। কিন্তু এআই তৈরি করছে বৈশ্বিক বেসরকারি কোম্পানিগুলো। তাই এটি দ্রুত বিস্তার লাভ করছে, যেন প্রত্যেকের হাতে নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র। ভালো কিছুর জন্য যেমন কৃষকের জীবন বদলাতে পারে, তেমনি একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে খাদ্য নষ্ট করাও সম্ভব।

টিকটক থেকে শিক্ষা

যখন প্রতিটি পণ্য টিকটকের মতো ডেটা সংগ্রহ করবে, তখন চীন ও আমেরিকা আস্থা কাঠামো না থাকলে উভয় দেশই একে অপরের পণ্য ব্যবহার করবে না। তাই প্রয়োজন ‘কো-অপেটিশন’ — অর্থাৎ প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতা একসঙ্গে।

আস্থা কাঠামোর রূপরেখা

ক্রেগ মান্ডি তিনটি মূল নীতির প্রস্তাব করেছেন:
১. এআই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে কেবল এআই — মানব নিয়ন্ত্রণ খুব ধীর ও দুর্বল।
২. প্রতিটি এআই সিস্টেমে একটি ‘ট্রাস্ট অ্যাডজুডিকেটর’ থাকতে হবে, যা কার্যক্রমের নৈতিকতা ও নিরাপত্তা যাচাই করবে।
৩. যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের মতো কাঠামোগত প্রক্রিয়ায় একাধিক টেকনিক্যাল, আইনগত ও কূটনৈতিক কর্মদল গঠন করতে হবে।

নৈতিক প্রশিক্ষণ জরুরি

এআই-কে শুধু আইন নয়, সাধারণ নৈতিক মূল্যবোধও শেখাতে হবে — সততা, ন্যায়, মানবজীবনের প্রতি সম্মান। এজন্য লোককথা, লোকগল্প ইত্যাদি দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে এআই-কে নৈতিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যা কিছুটা আশাব্যঞ্জক ফল দেখিয়েছে।

জরুরি সময়

আজকের এআই যত উন্নত মনে হোক, এটি ভবিষ্যতের তুলনায় সবচেয়ে কম উন্নত সংস্করণ। এখনই নৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা না গেলে এআই বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠবে। ক্রেগ মান্ডির মতে, এটি যেন রাস্তার মোড়ে সবার হাতে পারমাণবিক অস্ত্র তুলে দেওয়ার মতো।

মানবজাতির সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো — আমরা কি এআই-এর শক্তিকে মানবকল্যাণ ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে পারব? যদি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ব্যর্থ হয়, তবে অন্য কোনো দেশও তা পারবে না। প্রযুক্তির তাপমাত্রা ইতিমধ্যেই ২১১.৯ ডিগ্রি ফারেনহাইটে পৌঁছেছে — ফুটন্ত বিন্দুর এক চুল নিচে। সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।