ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ইতিহাসে কিছু নাম আছে যাঁদের ছাড়া পুরো ধারাটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সেই বিরল নামগুলোর অন্যতম। তিনি শুধু একজন যন্ত্রশিল্পী ছিলেন না; তিনি ছিলেন গুরু, গবেষক, সংগঠক এবং আধ্যাত্মিক সাধক। তাঁর হাত ধরে জন্ম নেয় মাইহার ঘরানা, যা আজও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এক গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে টিকে আছে। তাঁর শিষ্যরা ভারতীয় সঙ্গীতকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেন, আর তাঁর সৃষ্ট রাগগুলো আজও শিল্পী ও শ্রোতাদের সমানভাবে আবিষ্ট করে রাখে।
শৈশব ও সংগ্রামের দিন
১৮৬২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আলাউদ্দিন খাঁ। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত দুর্বল। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া এক কিশোরের পক্ষে বড় কিছু স্বপ্ন দেখা তখন সহজ ছিল না। তবুও ছোটবেলা থেকেই তাঁর মনে সঙ্গীতের প্রতি প্রবল টান ছিল। গ্রামীণ মেলা বা বিভিন্ন আসরে বাজতে থাকা বেহালা, বাঁশি বা তবলায় তিনি মুগ্ধ হতেন।
শৈশবেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে সঙ্গীতই হবে তাঁর জীবনের পথ। তবে সহজ ছিল না সেই পথ। দারিদ্র্য তাঁকে যেমন কষ্ট দিয়েছিল, তেমনি জীবনের কঠোর বাস্তবতাও তাঁকে লড়াই করতে শিখিয়েছিল।
প্রারম্ভিক সঙ্গীত শিক্ষা
প্রথমে তিনি নিজ উদ্যোগে বেহালা শেখা শুরু করেন। পরে ধীরে ধীরে বিভিন্ন গুরুজনের কাছে তবলা, সরোদ এবং অন্য বাদ্যযন্ত্রেও দক্ষতা অর্জন করেন। তবে তাঁর প্রকৃত রূপকার ছিলেন ওস্তাদ ওয়াজির খাঁ। এই গুরু তাঁর মধ্যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গভীর ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।
ওয়াজির খাঁর কাছে আলাউদ্দিন খাঁর শিক্ষাজীবন ছিল কেবল সঙ্গীত নয়, কঠোর অনুশাসনেরও বিদ্যালয়। প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত রেওয়াজ করতে হতো। অনিয়ম বা অবহেলা বরদাস্ত করা হতো না। এই কঠোর শিক্ষার মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে তাঁর চরিত্র ও সাধনার মানসিকতা।
অনুশীলনপদ্ধতি ও সাধনার দর্শন
আলাউদ্দিন খাঁর কাছে সঙ্গীত ছিল না কেবল শিল্প; এটি ছিল আধ্যাত্মিক সাধনা। তিনি বিশ্বাস করতেন, সঠিক সঙ্গীতচর্চা মানুষকে আত্মিক উন্নতির পথে নিয়ে যায়। তাঁর অনুশীলনপদ্ধতিতে কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল:
নিয়মিত রেওয়াজ – তিনি প্রতিদিন ভোরবেলায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা যন্ত্রচর্চা করতেন।
আত্মশুদ্ধি – তিনি বলতেন, “অন্তর যদি পবিত্র না হয় তবে সুর কখনো শুদ্ধ হতে পারে না।”
শারীরিক প্রস্তুতি – দীর্ঘ সময় যন্ত্র বাজানোর জন্য তিনি শিষ্যদের শারীরিক ব্যায়ামেও উৎসাহ দিতেন।
শিষ্য-গুরু সম্পর্ক – শিষ্যদের প্রতি তিনি ছিলেন একাধারে কঠোর ও স্নেহশীল। ভুল হলে কঠিন শাস্তি দিতেন, তবে সঠিক পথে আনতেও কখনো ক্লান্ত হতেন না।
প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতি – তিনি মনে করতেন ভোরবেলা বা গভীর রাতে রেওয়াজ করলে প্রকৃতির সঙ্গে সুরের মেলবন্ধন সহজ হয়।
এই সাধনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে শুধু শিল্পী নয়, সাধকের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে।
মাইহার ঘরানার প্রতিষ্ঠা
আলাউদ্দিন খাঁ জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন মধ্যপ্রদেশের মাইহারে। এখানেই তিনি রাজদরবারে কাজের সুযোগ পান এবং সঙ্গীতচর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তাঁর উদ্যোগে গড়ে ওঠে মাইহার ঘরানা।
এই ঘরানার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল—
- যন্ত্রসঙ্গীতকে রাগাশ্রিত সঙ্গীতের সমান মর্যাদা দেওয়া।
- জটিল রাগ ও তালকে সহজভাবে পরিবেশন করার ধারা।
- দেশীয় যন্ত্র ও পাশ্চাত্য যন্ত্রের সম্মিলিত ব্যবহার।
মাইহার ঘরানার মাধ্যমে ভারতীয় সঙ্গীত এক নতুন মাত্রা পায়।
মাইহার ব্যান্ড ও অর্কেস্ট্রা
মাইহারের অনাথ শিশুদের নিয়ে আলাউদ্দিন খাঁ গড়ে তোলেন এক অনন্য সঙ্গীতদল, যা পরিচিত মাইহার ব্যান্ড নামে। এখানে ছিল সেতার, সরোদ, বাঁশি, তবলা, বেহালা—একইসঙ্গে ভায়োলিন, স্যাক্সোফোন ও ক্ল্যারিনেট।
ফলে সৃষ্টি হয়েছিল এক অভিনব সঙ্গীতধারা—যেখানে ভারতীয় রাগাশ্রিত সুরের সঙ্গে পাশ্চাত্য অর্কেস্ট্রার রূপ মিশে যেত। এই ব্যান্ড শুধু রাজদরবারেই নয়, জনসমক্ষে ও উৎসবে পরিবেশনা করে জনপ্রিয়তা পায়।
রাগসৃষ্টি : নতুনত্বের দিগন্ত
আলাউদ্দিন খাঁর সবচেয়ে বড় অবদানগুলোর একটি তাঁর নতুন রাগসৃষ্টি। তিনি প্রচলিত ধারাকে ভেঙে নতুন সুরের জগৎ সৃষ্টি করেন। উল্লেখযোগ্য রাগগুলো হলো:
- হেমবিহাগ: শীতকালের আবহ ধারণ করে।
- জোগিয়া কাফি: ভক্তিমূলক আবহ, গভীর সুরেলা ধারা।
- ললিত পঞ্চমী: ভোরবেলার শান্ত ও কোমল সুর।
- মধুকৌন্স: প্রেম ও রোমান্টিক আবহে ভরা।
- শিবমঞ্জরি: আধ্যাত্মিকতার প্রতিফলন।
এই রাগগুলো আজও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে পরিবেশিত হয় এবং তাঁকে অনন্য উদ্ভাবকের মর্যাদা দেয়।
পশ্চিমা সঙ্গীতের সঙ্গে যোগাযোগ
যদিও আলাউদ্দিন খাঁ নিজে বিদেশে খুব বেশি ভ্রমণ করেননি, তাঁর শিষ্যরা ভারতীয় সঙ্গীতকে ইউরোপ ও আমেরিকায় পৌঁছে দেন। বিশেষ করে রবি শঙ্কর ও আলি আকবর খাঁ পশ্চিমা শ্রোতাদের কাছে ভারতীয় সেতার ও সরোদকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
রবি শঙ্করের মাধ্যমে দি বিটলসের জর্জ হ্যারিসন ভারতীয় রাগ ও তাল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। এতে ভারতীয় সঙ্গীত এক বৈশ্বিক পরিচিতি লাভ করে।
শিষ্য ও তাঁদের অবদান
আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্যরা তাঁর উত্তরাধিকারকে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
- পণ্ডিত রবি শঙ্কর– সেতারকে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় করে তোলেন।
- আলি আকবর খাঁ– সরোদের নতুন রূপ দেন এবং ক্যালিফোর্নিয়ায় আলি আকবর কলেজ অব মিউজিক প্রতিষ্ঠা করেন।
- আন্নপূর্ণা দেবী– সুরবাহার যন্ত্রকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে প্রতিষ্ঠিত করেন।
- নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়– হৃদয়গ্রাহী সেতার বাজনায় বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন।
সঙ্গীততত্ত্ব ও দার্শনিক ভাবনা
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর মতে, সঙ্গীত কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং আত্মার মুক্তির পথ। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাগকে আয়ত্ত করা মানে কেবল সুরচর্চা নয়, এর সঙ্গে আধ্যাত্মিক যোগও জরুরি।
তিনি বলতেন—
- সঙ্গীত মানুষকে ঈশ্বরের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে।
- গুরু-শিষ্য সম্পর্কের ভিত্তি হলো বিশ্বাস ও আত্মসমর্পণ।
- সঠিক সঙ্গীতশিল্পী হতে হলে কঠোর সাধনা অপরিহার্য।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি
ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ ও পদ্মবিভূষণ পুরস্কারে ভূষিত করে। পাশাপাশি দেশ-বিদেশে অসংখ্য সংস্থা তাঁকে সম্মানিত করে। তবে আলাউদ্দিন খাঁর কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার ছিল তাঁর শিষ্যদের সাফল্য।
শেষ জীবন ও প্রয়াণ
আলাউদ্দিন খাঁ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সঙ্গীতচর্চায় লিপ্ত ছিলেন। ১৯৭২ সালে তিনি প্রয়াণ করেন। কিন্তু তাঁর গড়ে তোলা মাইহার ঘরানা ও শিষ্যদের মাধ্যমে তাঁর ধারা আজও অমলিন।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ছিলেন কেবল এক শিল্পী নন, তিনি ছিলেন এক সাধক, এক মহামানব। তাঁর সৃষ্ট রাগ, অনন্য অনুশীলনপদ্ধতি, শিষ্যগণ ও দার্শনিক ভাবনা তাঁকে চিরকালীন করে রেখেছে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে তিনি শুধু ভারতেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও পৌঁছে দিয়েছেন।
আজও তাঁর জীবন আমাদের শিখিয়ে দেয়—সাধনা, শৃঙ্খলা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়।