১২:০৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫
আলোকে শিল্পে রূপ দেওয়া লিন্ডসি অ্যাডেলম্যান পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ ‘ইনল্যান্ড টাইপ্যান’: প্রাণঘাতী বিষ, শান্ত স্বভাবের এই সরীসৃপের অজানা বিস্ময় কুমিল্লায় দায়িত্ব পালনকালে অসুস্থ হয়ে পুলিশের মৃত্যু রবিবার থেকে কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন প্রাথমিক শিক্ষকরা ভিয়েতনামী ঔপন্যাসিক ড. ফান কুয়ে মাই শারজাহ বইমেলায় পাঠকদের মুগ্ধ করলেন মংলায় নৌকাডুবিতে নিখোঁজ প্রবাসী নারী পর্যটক ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আরও ৮৩৪ জন পাকিস্তানের দুর্ভিক্ষের বছর? প্রতিবন্ধী চাকরিপ্রত্যাশীদের আমরণ অনশন ৬৫ ঘণ্টা অতিক্রম, সরকারের নীরবতা অব্যাহত গণভোটের কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই: বিএনপি নেতা আমীর খসরু

জীবনের উদ্দেশ্য: দস্তয়েভস্কি থেকে নিটশে পর্যন্ত ভাবনার ভিন্ন পথ

মিশেল দ্য মোঁতেন একবার লিখেছিলেন, “যা আমরা সবচেয়ে কম জানি, সেটিই আমরা সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।” এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সাহিত্য ও দর্শনের ইতিহাসে বহু মহৎ রচনা আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন উত্তর খুঁজেছে। এখানে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের আলোচনার মাধ্যমে মানুষের অস্তিত্বের তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে।


দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ (ফিওদর দস্তয়েভস্কি, ১৮৮০)

উনিশ শতকের রাশিয়াকে প্রেক্ষাপটে রেখে দস্তয়েভস্কির এই উপন্যাসে মূল চরিত্র করামাজভ পরিবার। পিতা ফিওদর করামাজভ ছিলেন দায়িত্বহীন, আর পিতৃহত্যার ঘটনায় সন্দেহ পড়ে তার ছেলে দিমিত্রির ওপর। উপন্যাসে তিন ভাই—দিমিত্রি, ইভান ও আলিয়োশার ভিন্ন ভিন্ন নৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রতিক্রিয়া ফুটে ওঠে।

  • দিমিত্রি খোঁজে ভোগবিলাসে অর্থ।
  • ইভান চলে যুক্তি ও সংশয়ের পথে।
  • আলিয়োশা খোঁজে বিশ্বাস, প্রেম ও ক্ষমা।

দস্তয়েভস্কি সবার যুক্তি তুলে ধরলেও শেষ পর্যন্ত আলিয়োশার নিঃস্বার্থ ভালোবাসাকে শ্রেষ্ঠ জীবনপথ হিসেবে দেখান। তাঁর মতে, প্রতিবেশীর প্রতি ভালোবাসায় নিজেকে বিসর্জন দিলে সন্দেহ দূর হয়, আর বিশ্বাস জন্ম নেয়।


অটোবায়োগ্রাফি অব এ যোগী (পরমহংস যোগানন্দ, ১৯৪৬)

ভারতের সন্ন্যাসী যোগানন্দ পশ্চিমে হিন্দু আধ্যাত্মিকতাকে পরিচিত করেন। ১৯২০ সালে তিনি প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে বক্তৃতা দেন এবং পরবর্তীতে লস অ্যাঞ্জেলেসে আত্ম-উপলব্ধি সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর আত্মজীবনী ধ্যান, যোগ ও আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে পশ্চিমা পাঠকদের পরিচয় করায়।

যোগানন্দের মতে, জীবনের উদ্দেশ্য হলো আত্ম-উপলব্ধি—নিজেকে গভীরভাবে জানা ও আত্মসচেতন হওয়া। যত বেশি মানুষ আত্ম-উপলব্ধি অর্জন করে, ততই তার আধ্যাত্মিক শক্তি মহাবিশ্বকে প্রভাবিত করে। বাহ্যিক ওঠাপড়া তখন তাকে তেমনভাবে নাড়া দিতে পারে না।


দ্য ওয়ে অব এ পিলগ্রিম (বেনামী, ১৮৮৪)

উনিশ শতকের শেষভাগে এক তরুণ জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজতে রাশিয়াজুড়ে ভ্রমণে বের হয়। এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসী তাকে শেখান নিরন্তর প্রার্থনা করতে: “প্রভু যিশু খ্রিস্ট, আমার প্রতি দয়া করুন।”

যাত্রাপথে সে নানা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়—চুরি হয়, কাজ করে জীবিকা চালায়, এক কিশোরীকে বিয়ের হাত থেকে বাঁচায়, আবার পুরোহিতদের সঙ্গে গভীর আলোচনায় অংশ নেয়। বাস্তব বা কল্পিত যাই হোক, এই রচনার মূল বক্তব্য হলো: জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বরের সন্ধান করা।


মেডিটেশনস (মার্কাস অরেলিয়াস, খ্রিষ্টাব্দ ১২১–১৮০)

রোম সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াস যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থানকালে নিজের চিন্তাগুলো লিখে রাখেন, যা পরে “মেডিটেশনস” নামে পরিচিত হয়। এটি স্টোয়িক দর্শনের অন্যতম ভিত্তি হয়ে ওঠে।

অরেলিয়াস বিশ্বাস করতেন জীবনের উদ্দেশ্য হলো কর্তব্য পালন ও নৈতিক জীবনযাপন। তাঁর কিছু উক্তি:

  • “সকালে ঘুম থেকে উঠতে অনীহা হলে মনে করো, তুমি মানবিক কর্তব্য পালনের জন্য উঠছ।”
  • “যা ঘটে তা মেনে নাও, কর্তব্য পালন করো, আর সত্যকে সদিচ্ছাসহ প্রকাশ করো।”

তাঁর মতে, কর্তব্যবোধ, সহিষ্ণুতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণই সুখী জীবনের মূল উপাদান।


দ্য গে সায়েন্স (ফ্রিডরিখ নিটশে, ১৮৮২)

“ঈশ্বর মৃত”—নিটশের এই বিখ্যাত ঘোষণা আসে “দ্য গে সায়েন্স”-এ। এখানে তিনি বিজ্ঞান ও যুক্তির প্রভাবে ভেঙে পড়া আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের পরও জীবনের প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন।

নিটশে বলেন, জীবনের গভীর অর্থ খুঁজে না পেয়ে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বরং উদ্দেশ্যহীনতাকে হাস্যরসের চোখে দেখা উচিত। তাঁর মতে, আত্ম-উপহাসই প্রকৃত জ্ঞানের সঙ্গী হতে পারে। তাই তিনি পরামর্শ দেন—অর্থ খুঁজে পেতে হন্যে না হয়ে প্রতিদিনকে উপভোগ করো এবং জীবনের অযৌক্তিকতাকে হাসিমুখে গ্রহণ করো।


দস্তয়েভস্কির ভালোবাসা, যোগানন্দের আত্ম-উপলব্ধি, বেনামী তীর্থযাত্রীর ঈশ্বর অনুসন্ধান, অরেলিয়াসের কর্তব্যবোধ কিংবা নিটশের আত্ম-উপহাস—সবাই জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন পথ দেখিয়েছেন। দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা হলেও একটি বিষয় স্পষ্ট—মানুষ তার অস্তিত্বকে বোঝার জন্য সবসময় নতুন পথ খুঁজে চলে।

জনপ্রিয় সংবাদ

আলোকে শিল্পে রূপ দেওয়া লিন্ডসি অ্যাডেলম্যান

জীবনের উদ্দেশ্য: দস্তয়েভস্কি থেকে নিটশে পর্যন্ত ভাবনার ভিন্ন পথ

০৪:৫৪:৫৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মিশেল দ্য মোঁতেন একবার লিখেছিলেন, “যা আমরা সবচেয়ে কম জানি, সেটিই আমরা সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।” এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সাহিত্য ও দর্শনের ইতিহাসে বহু মহৎ রচনা আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন উত্তর খুঁজেছে। এখানে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের আলোচনার মাধ্যমে মানুষের অস্তিত্বের তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে।


দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ (ফিওদর দস্তয়েভস্কি, ১৮৮০)

উনিশ শতকের রাশিয়াকে প্রেক্ষাপটে রেখে দস্তয়েভস্কির এই উপন্যাসে মূল চরিত্র করামাজভ পরিবার। পিতা ফিওদর করামাজভ ছিলেন দায়িত্বহীন, আর পিতৃহত্যার ঘটনায় সন্দেহ পড়ে তার ছেলে দিমিত্রির ওপর। উপন্যাসে তিন ভাই—দিমিত্রি, ইভান ও আলিয়োশার ভিন্ন ভিন্ন নৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রতিক্রিয়া ফুটে ওঠে।

  • দিমিত্রি খোঁজে ভোগবিলাসে অর্থ।
  • ইভান চলে যুক্তি ও সংশয়ের পথে।
  • আলিয়োশা খোঁজে বিশ্বাস, প্রেম ও ক্ষমা।

দস্তয়েভস্কি সবার যুক্তি তুলে ধরলেও শেষ পর্যন্ত আলিয়োশার নিঃস্বার্থ ভালোবাসাকে শ্রেষ্ঠ জীবনপথ হিসেবে দেখান। তাঁর মতে, প্রতিবেশীর প্রতি ভালোবাসায় নিজেকে বিসর্জন দিলে সন্দেহ দূর হয়, আর বিশ্বাস জন্ম নেয়।


অটোবায়োগ্রাফি অব এ যোগী (পরমহংস যোগানন্দ, ১৯৪৬)

ভারতের সন্ন্যাসী যোগানন্দ পশ্চিমে হিন্দু আধ্যাত্মিকতাকে পরিচিত করেন। ১৯২০ সালে তিনি প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে বক্তৃতা দেন এবং পরবর্তীতে লস অ্যাঞ্জেলেসে আত্ম-উপলব্ধি সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর আত্মজীবনী ধ্যান, যোগ ও আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে পশ্চিমা পাঠকদের পরিচয় করায়।

যোগানন্দের মতে, জীবনের উদ্দেশ্য হলো আত্ম-উপলব্ধি—নিজেকে গভীরভাবে জানা ও আত্মসচেতন হওয়া। যত বেশি মানুষ আত্ম-উপলব্ধি অর্জন করে, ততই তার আধ্যাত্মিক শক্তি মহাবিশ্বকে প্রভাবিত করে। বাহ্যিক ওঠাপড়া তখন তাকে তেমনভাবে নাড়া দিতে পারে না।


দ্য ওয়ে অব এ পিলগ্রিম (বেনামী, ১৮৮৪)

উনিশ শতকের শেষভাগে এক তরুণ জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজতে রাশিয়াজুড়ে ভ্রমণে বের হয়। এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসী তাকে শেখান নিরন্তর প্রার্থনা করতে: “প্রভু যিশু খ্রিস্ট, আমার প্রতি দয়া করুন।”

যাত্রাপথে সে নানা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়—চুরি হয়, কাজ করে জীবিকা চালায়, এক কিশোরীকে বিয়ের হাত থেকে বাঁচায়, আবার পুরোহিতদের সঙ্গে গভীর আলোচনায় অংশ নেয়। বাস্তব বা কল্পিত যাই হোক, এই রচনার মূল বক্তব্য হলো: জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বরের সন্ধান করা।


মেডিটেশনস (মার্কাস অরেলিয়াস, খ্রিষ্টাব্দ ১২১–১৮০)

রোম সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াস যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থানকালে নিজের চিন্তাগুলো লিখে রাখেন, যা পরে “মেডিটেশনস” নামে পরিচিত হয়। এটি স্টোয়িক দর্শনের অন্যতম ভিত্তি হয়ে ওঠে।

অরেলিয়াস বিশ্বাস করতেন জীবনের উদ্দেশ্য হলো কর্তব্য পালন ও নৈতিক জীবনযাপন। তাঁর কিছু উক্তি:

  • “সকালে ঘুম থেকে উঠতে অনীহা হলে মনে করো, তুমি মানবিক কর্তব্য পালনের জন্য উঠছ।”
  • “যা ঘটে তা মেনে নাও, কর্তব্য পালন করো, আর সত্যকে সদিচ্ছাসহ প্রকাশ করো।”

তাঁর মতে, কর্তব্যবোধ, সহিষ্ণুতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণই সুখী জীবনের মূল উপাদান।


দ্য গে সায়েন্স (ফ্রিডরিখ নিটশে, ১৮৮২)

“ঈশ্বর মৃত”—নিটশের এই বিখ্যাত ঘোষণা আসে “দ্য গে সায়েন্স”-এ। এখানে তিনি বিজ্ঞান ও যুক্তির প্রভাবে ভেঙে পড়া আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের পরও জীবনের প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন।

নিটশে বলেন, জীবনের গভীর অর্থ খুঁজে না পেয়ে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বরং উদ্দেশ্যহীনতাকে হাস্যরসের চোখে দেখা উচিত। তাঁর মতে, আত্ম-উপহাসই প্রকৃত জ্ঞানের সঙ্গী হতে পারে। তাই তিনি পরামর্শ দেন—অর্থ খুঁজে পেতে হন্যে না হয়ে প্রতিদিনকে উপভোগ করো এবং জীবনের অযৌক্তিকতাকে হাসিমুখে গ্রহণ করো।


দস্তয়েভস্কির ভালোবাসা, যোগানন্দের আত্ম-উপলব্ধি, বেনামী তীর্থযাত্রীর ঈশ্বর অনুসন্ধান, অরেলিয়াসের কর্তব্যবোধ কিংবা নিটশের আত্ম-উপহাস—সবাই জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন পথ দেখিয়েছেন। দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা হলেও একটি বিষয় স্পষ্ট—মানুষ তার অস্তিত্বকে বোঝার জন্য সবসময় নতুন পথ খুঁজে চলে।