০২:৩৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
লন্ডনের ডানপন্থী সমাবেশে সহিংসতা, রেকর্ড সমাগমে উত্তেজনা দোহায় হামাস নেতাদের ওপর হামলা, যুদ্ধবিরতির আলাপ জটিলতায় নতুন গবেষণা: আটলান্টিক প্রবাহ ভাঙার ঝুঁকি এখন অনেক বেশি” ডাকসু ও জাকসুতে বৈষম্যবিরোধীদের বিপর্যয়, চ্যালেঞ্জের মুখে এনসিপি? জাতীয় নির্বাচনকে ডাকসুর সঙ্গে মেলানো যাবে না, মডেল হিসেবে কাজ করবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হার – আকাশ চোপড়া-অশ্বিনকেই ‘সঠিক’ প্রমাণ করছে বাংলাদেশ? ভেঙে দেওয়া সংসদ পুনর্বহাল চায় নেপালের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো রেমিট্যান্স যেভাবে বদলে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের অনেক গ্রাম নতুন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নেওয়ার প্রথমদিনে শান্ত হতে শুরু করেছে নেপাল অবশেষে জাকসু নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা, কেনো এত সময় লাগলো?

নায়করাজ রাজ্জাক: বাংলাদেশের ছায়াছবির মহাতারকা

নায়করাজ রাজ্জাকের জন্ম ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। তাঁর পুরো নাম আব্দুর রাজ্জাক। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন প্রাণবন্ত এবং সৃজনশীল। স্কুলজীবনে পড়াশোনার পাশাপাশি নাটক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করতেন, তবে তাঁর প্রধান আগ্রহ ছিল অভিনয়ে। কলকাতার রাস্তাঘাটে বেড়ে ওঠা এই তরুণের ভেতরে শিল্পীসত্তার যে বীজ বপন হয়েছিল, তা পরবর্তী সময়ে তাকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মহাতারকায় পরিণত করে।

দেশভাগের পর পারিবারিকভাবে নানা সংকটে পড়তে হয় তাঁদের। জীবনের টানাপোড়েন তাঁকে বাস্তবতা শিখিয়েছে এবং কষ্টের অভিজ্ঞতা তাঁর অভিনয়ের আবেগকে গভীর করে তুলেছে।

ক্যারিয়ারের শুরুর সংগ্রাম

রাজ্জাকের জীবনে নায়ক হওয়ার পথ মোটেও সহজ ছিল না। কলকাতায় পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি নাটক ও ছোট ছোট মঞ্চনাটকে অভিনয় করতেন। কিন্তু চলচ্চিত্রে জায়গা করে নেওয়া সহজ ছিল না। একদিকে আর্থিক অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে পরিবার চালানোর দায় তাঁকে বারবার দ্বিধায় ফেলেছিল।

চলচ্চিত্র ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়ে তিনি অভিনয়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেন, কিন্তু তবুও বড় পর্দায় আসার সুযোগ পাচ্ছিলেন না। কলকাতার প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে তাঁর প্রতিভা প্রমাণের সুযোগ সীমিত ছিল। এই পরিস্থিতিতে তিনি নতুন আশার খোঁজে ঢাকায় আসার সিদ্ধান্ত নেন।

১৯৬১ সালে ঢাকায় এসে তিনি প্রথমে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। খুব সাধারণ দায়িত্ব পালন করলেও তিনি কখনো হাল ছাড়েননি। পর্দার আড়ালে কাজ করতে করতে চলচ্চিত্রের ভাষা, ক্যামেরা, আলো-অন্ধকার সবকিছু কাছ থেকে শিখে নেন। আর মনের ভেতর অভিনয়ের আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হতে থাকে।

১৯৬৪ সালে “তেরো নাম্বার ফেকু ওস্তাগার লেন” চলচ্চিত্রে তিনি ছোট চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান। এই ছবিই তাঁর অভিনয়জীবনের ভিত্তি তৈরি করে দেয়। যদিও চরিত্রটি ছোট ছিল, কিন্তু তাঁর প্রাণবন্ত অভিনয় অনেকের নজর কাড়ে। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে তিনি সহকারী চরিত্র থেকে প্রধান নায়ক হওয়ার পথে এগোতে থাকেন।

প্রথম সাফল্য ও জনপ্রিয়তা

১৯৬৭ সালে মুক্তি পাওয়া “বেহুলা” তাঁকে রাতারাতি পরিচিত করে তোলে। পৌরাণিক কাহিনীভিত্তিক এই চলচ্চিত্রে তাঁর প্রাণবন্ত উপস্থিতি দর্শকের মনে গভীর ছাপ ফেলে। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর সোনালি পথচলা। শিগগিরই দর্শক তাঁকে “নায়করাজ” উপাধি দেয়, যা সারাজীবন তাঁর সঙ্গে থেকে গেছে।

ব্যক্তিগত জীবন

রাজ্জাক ছিলেন এক সুখী পরিবারপ্রেমী মানুষ। স্ত্রী রাজলক্ষ্মী এবং তাঁদের পাঁচ সন্তান—আরিফ, বাপ্পারাজ, শাকিল, রাহুল ও বন্যা—নিয়ে তাঁর সংসার ছিল পরিপূর্ণ। তিনি ছিলেন দায়িত্বশীল স্বামী এবং স্নেহশীল পিতা। সহকর্মীরা সবসময় উল্লেখ করেছেন, কাজের ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি পরিবারকে অগ্রাধিকার দিতেন।

কবরীর সঙ্গে অবিস্মরণীয় জুটি

বাংলা চলচ্চিত্রে নায়ক-নায়িকার অসংখ্য জুটি এসেছে, কিন্তু রাজ্জাক-কবরী জুটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাঁরা একসঙ্গে কাজ করেছেন অগণিত ছবিতে—যার মধ্যে ‘মালা’, ‘অধিকার’, ‘অগ্নিশিখা’, ‘রংবাজ’, ‘অবুঝ মন’ উল্লেখযোগ্য। তাঁদের পর্দার কেমিস্ট্রি ছিল এতটাই স্বাভাবিক যে দর্শক তাঁদের বাস্তব জীবনেও একসঙ্গে কল্পনা করত।

এই জুটি শুধু রোমান্টিকতার প্রতীক ছিল না; বরং সামাজিক বার্তা বহনকারী চলচ্চিত্রেও তাঁরা কাজ করেছেন। প্রেম, ত্যাগ, সংগ্রাম কিংবা আবেগ—সব ক্ষেত্রেই তাঁদের অভিনয় মুগ্ধ করেছে দর্শকদের।

পাঁচটি সুপারহিট চলচ্চিত্রের বিশ্লেষণ

১. বেহুলা (১৯৬৭)

এই পৌরাণিক কাহিনীভিত্তিক ছবিতে রাজ্জাক নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। চরিত্রের মধ্যে প্রাণ ঢেলে তিনি একেবারে নতুনভাবে দর্শকের কাছে আসেন। বেহুলা-লখিন্দরের গল্পে তাঁর অভিনয় ছিল স্বাভাবিক ও প্রাণবন্ত, যা তাঁকে রাতারাতি তারকা বানায়।

২. অবুঝ মন (১৯৭২)

স্বাধীনতার পর নির্মিত এই চলচ্চিত্র মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মের ভালোবাসা ও আবেগকে কেন্দ্র করে নির্মিত। এখানে রাজ্জাক ছিলেন আবেগী নায়ক, যিনি প্রেম ও মানবিকতাকে এক ভিন্ন মাত্রায় তুলে ধরেন। ছবিটি তৎকালীন দর্শকের মনে গভীর ছাপ ফেলে।

৩. রংবাজ (১৯৭৩)

বাংলা সিনেমায় ‘অ্যাকশন হিরো’ ধারার সূচনা বলা হয় এই ছবিকে। রাজ্জাক এখানে এক নতুন রূপে আবির্ভূত হন। তাঁর কণ্ঠস্বর, দেহভঙ্গি ও দৃঢ় উপস্থিতি দর্শককে মুগ্ধ করে। রংবাজের পর তাঁকে শুধু রোমান্টিক নায়ক নয়, শক্তিশালী অ্যাকশন হিরো হিসেবেও গ্রহণ করে দর্শক।

৪. অগ্নিশিখা (১৯৭৬)

সমাজবাস্তবতাকে কেন্দ্র করে নির্মিত এই চলচ্চিত্র রাজ্জাকের অভিনয়জীবনে একটি মোড় পরিবর্তন আনে। এখানে তিনি শুধু রোমান্টিক নায়ক নন, বরং সমাজ-সচেতন, সংগ্রামী মানুষ। তাঁর পরিপক্ব অভিনয় বাংলা সিনেমাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়।

৫. চন্দ্রনাথ (১৯৮৪)

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে রাজ্জাকের অভিনয় ছিল অনবদ্য। চরিত্রের সংবেদনশীল দিকগুলো তিনি এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন যে, দর্শকের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নেন। চন্দ্রনাথ আজও বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসে একটি স্মরণীয় নাম।

জনপ্রিয়তা ও সাধারণ মানুষের ভালোবাসা

রাজ্জাক ছিলেন বাংলার মানুষের সত্যিকারের নায়ক। তাঁর সিনেমা মুক্তি মানেই ছিল সিনেমা হলে ভিড় জমে যাওয়া। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্র তাঁর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছিল। দর্শক শুধু তাঁর অভিনয় উপভোগ করত না, তাঁকে নিজের মানুষ বলেও মনে করত। “নায়করাজ” উপাধি ছিল সাধারণ মানুষের ভালোবাসার প্রতিফলন।

পুরস্কার ও সম্মাননা

নায়করাজ রাজ্জাক তাঁর জীবদ্দশায় অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেছেন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাঁচবার পেয়েছেন তিনি। স্বাধীনতা পদকসহ বহু রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি সম্মাননা তাঁর ঝুলিতে জমা হয়েছে। তাঁর অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে ‘চলচ্চিত্রের মহাতারকা’ বলা হয়ে থাকে।

পরিচালক ও প্রযোজক রাজ্জাক

নায়ক হওয়ার পাশাপাশি রাজ্জাক পরিচালক ও প্রযোজক হিসেবেও কাজ করেছেন। তিনি ‘রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশনস’ নামে একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের সুযোগ করে দেওয়ার পাশাপাশি চলচ্চিত্রশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে তিনি নিরলসভাবে কাজ করেন।

জীবনের শেষ অধ্যায়

২০১৭ সালের ২১ আগস্ট রাজ্জাক মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার বনানী কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর মৃত্যুতে পুরো দেশ শোকাহত হয়েছিল। সহকর্মী, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিল। তাঁর মৃত্যু এক যুগের অবসান ঘটায়।

সামাজিক প্রভাব ও উত্তরাধিকার

নায়করাজ রাজ্জাকের চলচ্চিত্র শুধু বিনোদন নয়, সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ারও ছিল। তিনি দর্শকদের আনন্দ দিয়েছেন, আবার সামাজিক সমস্যাগুলোকে পর্দায় তুলে ধরেছেন। তরুণ প্রজন্মের জন্য তিনি অনুপ্রেরণা।

চলচ্চিত্রে তাঁর অবদান আজও অমলিন। তাঁর অভিনয়, সংগ্রাম ও শিল্পচর্চা বাংলা সিনেমার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

টাইমলাইন: নায়করাজ রাজ্জাকের ক্যারিয়ারের মাইলফলক

  • ১৯৪২ – পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় জন্ম
  • ১৯৫০-এর দশক – স্কুল ও কলেজ জীবনে নাটক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়
  • ১৯৬০ – কলকাতার চলচ্চিত্র ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ
  • ১৯৬১ – ঢাকায় আগমন, সহকারী পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু
  • ১৯৬৪ – ছোট চরিত্রে প্রথম চলচ্চিত্র: তেরো নাম্বার ফেকু ওস্তাগার লেন
  • ১৯৬৭ – বড় সাফল্য: বেহুলা মুক্তি, রাতারাতি নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত
  • ১৯৭২ – অবুঝ মন দিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্মের হৃদয়ে জায়গা করে নেন
  • ১৯৭৩ – রংবাজ এর মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রথম অ্যাকশন হিরো হিসেবে খ্যাতি অর্জন
  • ১৯৭৬ – অগ্নিশিখা দিয়ে সমাজ-বাস্তবতাভিত্তিক ছবিতে শক্ত অবস্থান
  • ১৯৮৪ – চন্দ্রনাথ এ অসাধারণ অভিনয়, সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্রে সাফল্য
  • ১৯৮০৯০ দশক – পরিচালক ও প্রযোজক হিসেবে রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশনস প্রতিষ্ঠা
  • ২০১৭ – ২১ আগস্ট মৃত্যুবরণ, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বনানীতে সমাহিত

নায়করাজ রাজ্জাক ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের এক জীবন্ত কিংবদন্তি। তাঁর অসংখ্য কাজ, সাধারণ মানুষের প্রতি টান এবং চলচ্চিত্রপ্রেমে ভরা জীবন তাঁকে অমর করে রেখেছে। যতদিন বাংলা সিনেমা ও সংস্কৃতি থাকবে, নায়করাজ রাজ্জাক ততদিন মানুষের হৃদয়ে অম্লান হয়ে থাকবেন।

লন্ডনের ডানপন্থী সমাবেশে সহিংসতা, রেকর্ড সমাগমে উত্তেজনা

নায়করাজ রাজ্জাক: বাংলাদেশের ছায়াছবির মহাতারকা

১০:০০:০৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

নায়করাজ রাজ্জাকের জন্ম ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। তাঁর পুরো নাম আব্দুর রাজ্জাক। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন প্রাণবন্ত এবং সৃজনশীল। স্কুলজীবনে পড়াশোনার পাশাপাশি নাটক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করতেন, তবে তাঁর প্রধান আগ্রহ ছিল অভিনয়ে। কলকাতার রাস্তাঘাটে বেড়ে ওঠা এই তরুণের ভেতরে শিল্পীসত্তার যে বীজ বপন হয়েছিল, তা পরবর্তী সময়ে তাকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মহাতারকায় পরিণত করে।

দেশভাগের পর পারিবারিকভাবে নানা সংকটে পড়তে হয় তাঁদের। জীবনের টানাপোড়েন তাঁকে বাস্তবতা শিখিয়েছে এবং কষ্টের অভিজ্ঞতা তাঁর অভিনয়ের আবেগকে গভীর করে তুলেছে।

ক্যারিয়ারের শুরুর সংগ্রাম

রাজ্জাকের জীবনে নায়ক হওয়ার পথ মোটেও সহজ ছিল না। কলকাতায় পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি নাটক ও ছোট ছোট মঞ্চনাটকে অভিনয় করতেন। কিন্তু চলচ্চিত্রে জায়গা করে নেওয়া সহজ ছিল না। একদিকে আর্থিক অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে পরিবার চালানোর দায় তাঁকে বারবার দ্বিধায় ফেলেছিল।

চলচ্চিত্র ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়ে তিনি অভিনয়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেন, কিন্তু তবুও বড় পর্দায় আসার সুযোগ পাচ্ছিলেন না। কলকাতার প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে তাঁর প্রতিভা প্রমাণের সুযোগ সীমিত ছিল। এই পরিস্থিতিতে তিনি নতুন আশার খোঁজে ঢাকায় আসার সিদ্ধান্ত নেন।

১৯৬১ সালে ঢাকায় এসে তিনি প্রথমে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। খুব সাধারণ দায়িত্ব পালন করলেও তিনি কখনো হাল ছাড়েননি। পর্দার আড়ালে কাজ করতে করতে চলচ্চিত্রের ভাষা, ক্যামেরা, আলো-অন্ধকার সবকিছু কাছ থেকে শিখে নেন। আর মনের ভেতর অভিনয়ের আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হতে থাকে।

১৯৬৪ সালে “তেরো নাম্বার ফেকু ওস্তাগার লেন” চলচ্চিত্রে তিনি ছোট চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান। এই ছবিই তাঁর অভিনয়জীবনের ভিত্তি তৈরি করে দেয়। যদিও চরিত্রটি ছোট ছিল, কিন্তু তাঁর প্রাণবন্ত অভিনয় অনেকের নজর কাড়ে। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে তিনি সহকারী চরিত্র থেকে প্রধান নায়ক হওয়ার পথে এগোতে থাকেন।

প্রথম সাফল্য ও জনপ্রিয়তা

১৯৬৭ সালে মুক্তি পাওয়া “বেহুলা” তাঁকে রাতারাতি পরিচিত করে তোলে। পৌরাণিক কাহিনীভিত্তিক এই চলচ্চিত্রে তাঁর প্রাণবন্ত উপস্থিতি দর্শকের মনে গভীর ছাপ ফেলে। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর সোনালি পথচলা। শিগগিরই দর্শক তাঁকে “নায়করাজ” উপাধি দেয়, যা সারাজীবন তাঁর সঙ্গে থেকে গেছে।

ব্যক্তিগত জীবন

রাজ্জাক ছিলেন এক সুখী পরিবারপ্রেমী মানুষ। স্ত্রী রাজলক্ষ্মী এবং তাঁদের পাঁচ সন্তান—আরিফ, বাপ্পারাজ, শাকিল, রাহুল ও বন্যা—নিয়ে তাঁর সংসার ছিল পরিপূর্ণ। তিনি ছিলেন দায়িত্বশীল স্বামী এবং স্নেহশীল পিতা। সহকর্মীরা সবসময় উল্লেখ করেছেন, কাজের ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি পরিবারকে অগ্রাধিকার দিতেন।

কবরীর সঙ্গে অবিস্মরণীয় জুটি

বাংলা চলচ্চিত্রে নায়ক-নায়িকার অসংখ্য জুটি এসেছে, কিন্তু রাজ্জাক-কবরী জুটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাঁরা একসঙ্গে কাজ করেছেন অগণিত ছবিতে—যার মধ্যে ‘মালা’, ‘অধিকার’, ‘অগ্নিশিখা’, ‘রংবাজ’, ‘অবুঝ মন’ উল্লেখযোগ্য। তাঁদের পর্দার কেমিস্ট্রি ছিল এতটাই স্বাভাবিক যে দর্শক তাঁদের বাস্তব জীবনেও একসঙ্গে কল্পনা করত।

এই জুটি শুধু রোমান্টিকতার প্রতীক ছিল না; বরং সামাজিক বার্তা বহনকারী চলচ্চিত্রেও তাঁরা কাজ করেছেন। প্রেম, ত্যাগ, সংগ্রাম কিংবা আবেগ—সব ক্ষেত্রেই তাঁদের অভিনয় মুগ্ধ করেছে দর্শকদের।

পাঁচটি সুপারহিট চলচ্চিত্রের বিশ্লেষণ

১. বেহুলা (১৯৬৭)

এই পৌরাণিক কাহিনীভিত্তিক ছবিতে রাজ্জাক নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। চরিত্রের মধ্যে প্রাণ ঢেলে তিনি একেবারে নতুনভাবে দর্শকের কাছে আসেন। বেহুলা-লখিন্দরের গল্পে তাঁর অভিনয় ছিল স্বাভাবিক ও প্রাণবন্ত, যা তাঁকে রাতারাতি তারকা বানায়।

২. অবুঝ মন (১৯৭২)

স্বাধীনতার পর নির্মিত এই চলচ্চিত্র মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মের ভালোবাসা ও আবেগকে কেন্দ্র করে নির্মিত। এখানে রাজ্জাক ছিলেন আবেগী নায়ক, যিনি প্রেম ও মানবিকতাকে এক ভিন্ন মাত্রায় তুলে ধরেন। ছবিটি তৎকালীন দর্শকের মনে গভীর ছাপ ফেলে।

৩. রংবাজ (১৯৭৩)

বাংলা সিনেমায় ‘অ্যাকশন হিরো’ ধারার সূচনা বলা হয় এই ছবিকে। রাজ্জাক এখানে এক নতুন রূপে আবির্ভূত হন। তাঁর কণ্ঠস্বর, দেহভঙ্গি ও দৃঢ় উপস্থিতি দর্শককে মুগ্ধ করে। রংবাজের পর তাঁকে শুধু রোমান্টিক নায়ক নয়, শক্তিশালী অ্যাকশন হিরো হিসেবেও গ্রহণ করে দর্শক।

৪. অগ্নিশিখা (১৯৭৬)

সমাজবাস্তবতাকে কেন্দ্র করে নির্মিত এই চলচ্চিত্র রাজ্জাকের অভিনয়জীবনে একটি মোড় পরিবর্তন আনে। এখানে তিনি শুধু রোমান্টিক নায়ক নন, বরং সমাজ-সচেতন, সংগ্রামী মানুষ। তাঁর পরিপক্ব অভিনয় বাংলা সিনেমাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়।

৫. চন্দ্রনাথ (১৯৮৪)

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে রাজ্জাকের অভিনয় ছিল অনবদ্য। চরিত্রের সংবেদনশীল দিকগুলো তিনি এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন যে, দর্শকের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নেন। চন্দ্রনাথ আজও বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসে একটি স্মরণীয় নাম।

জনপ্রিয়তা ও সাধারণ মানুষের ভালোবাসা

রাজ্জাক ছিলেন বাংলার মানুষের সত্যিকারের নায়ক। তাঁর সিনেমা মুক্তি মানেই ছিল সিনেমা হলে ভিড় জমে যাওয়া। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্র তাঁর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছিল। দর্শক শুধু তাঁর অভিনয় উপভোগ করত না, তাঁকে নিজের মানুষ বলেও মনে করত। “নায়করাজ” উপাধি ছিল সাধারণ মানুষের ভালোবাসার প্রতিফলন।

পুরস্কার ও সম্মাননা

নায়করাজ রাজ্জাক তাঁর জীবদ্দশায় অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেছেন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাঁচবার পেয়েছেন তিনি। স্বাধীনতা পদকসহ বহু রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি সম্মাননা তাঁর ঝুলিতে জমা হয়েছে। তাঁর অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে ‘চলচ্চিত্রের মহাতারকা’ বলা হয়ে থাকে।

পরিচালক ও প্রযোজক রাজ্জাক

নায়ক হওয়ার পাশাপাশি রাজ্জাক পরিচালক ও প্রযোজক হিসেবেও কাজ করেছেন। তিনি ‘রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশনস’ নামে একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের সুযোগ করে দেওয়ার পাশাপাশি চলচ্চিত্রশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে তিনি নিরলসভাবে কাজ করেন।

জীবনের শেষ অধ্যায়

২০১৭ সালের ২১ আগস্ট রাজ্জাক মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার বনানী কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর মৃত্যুতে পুরো দেশ শোকাহত হয়েছিল। সহকর্মী, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিল। তাঁর মৃত্যু এক যুগের অবসান ঘটায়।

সামাজিক প্রভাব ও উত্তরাধিকার

নায়করাজ রাজ্জাকের চলচ্চিত্র শুধু বিনোদন নয়, সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ারও ছিল। তিনি দর্শকদের আনন্দ দিয়েছেন, আবার সামাজিক সমস্যাগুলোকে পর্দায় তুলে ধরেছেন। তরুণ প্রজন্মের জন্য তিনি অনুপ্রেরণা।

চলচ্চিত্রে তাঁর অবদান আজও অমলিন। তাঁর অভিনয়, সংগ্রাম ও শিল্পচর্চা বাংলা সিনেমার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

টাইমলাইন: নায়করাজ রাজ্জাকের ক্যারিয়ারের মাইলফলক

  • ১৯৪২ – পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় জন্ম
  • ১৯৫০-এর দশক – স্কুল ও কলেজ জীবনে নাটক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়
  • ১৯৬০ – কলকাতার চলচ্চিত্র ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ
  • ১৯৬১ – ঢাকায় আগমন, সহকারী পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু
  • ১৯৬৪ – ছোট চরিত্রে প্রথম চলচ্চিত্র: তেরো নাম্বার ফেকু ওস্তাগার লেন
  • ১৯৬৭ – বড় সাফল্য: বেহুলা মুক্তি, রাতারাতি নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত
  • ১৯৭২ – অবুঝ মন দিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্মের হৃদয়ে জায়গা করে নেন
  • ১৯৭৩ – রংবাজ এর মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রথম অ্যাকশন হিরো হিসেবে খ্যাতি অর্জন
  • ১৯৭৬ – অগ্নিশিখা দিয়ে সমাজ-বাস্তবতাভিত্তিক ছবিতে শক্ত অবস্থান
  • ১৯৮৪ – চন্দ্রনাথ এ অসাধারণ অভিনয়, সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্রে সাফল্য
  • ১৯৮০৯০ দশক – পরিচালক ও প্রযোজক হিসেবে রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশনস প্রতিষ্ঠা
  • ২০১৭ – ২১ আগস্ট মৃত্যুবরণ, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বনানীতে সমাহিত

নায়করাজ রাজ্জাক ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের এক জীবন্ত কিংবদন্তি। তাঁর অসংখ্য কাজ, সাধারণ মানুষের প্রতি টান এবং চলচ্চিত্রপ্রেমে ভরা জীবন তাঁকে অমর করে রেখেছে। যতদিন বাংলা সিনেমা ও সংস্কৃতি থাকবে, নায়করাজ রাজ্জাক ততদিন মানুষের হৃদয়ে অম্লান হয়ে থাকবেন।