আন্তর্জাতিক বিষয়ক আলোচনায় যখন একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের অনিশ্চিত পদক্ষেপ এবং অন্যদিকে তিয়ানজিনে সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন সম্মেলন আলোচনায় রয়েছে, তখন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ের কাবুল সফর তুলনামূলকভাবে আড়ালে থেকে গেছে। অথচ এই সফর যেমন তাৎপর্যপূর্ণ, তেমনি জটিলতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে শি জিনপিংয়ের বেইজিংকে।
২০২২ সালের পর এই প্রথম কাবুলে পৌঁছান ওয়াং ই। তিনি ২০ আগস্ট চীন-আফগানিস্তান-পাকিস্তান ত্রিপক্ষীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দেন। এই কাঠামো পুনরায় চালু হয় মূলত চীন ও পাকিস্তানের স্বার্থে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের ২০ বছরের সামরিক উপস্থিতি ও ২০২১ সালের আগস্টে বিশৃঙ্খল প্রত্যাহারের পর। এতে পুরোনো তালেবান সরলেই নতুন তালেবানকে স্থলাভিষিক্ত করা হয়। তবে চীন, রাশিয়া ও ইরানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পশ্চিমা সামরিক উপস্থিতি যেন আর ফিরে না আসে। অন্যদিকে পাকিস্তান চাইলে সীমিতভাবে ওয়াশিংটনকে ঘাঁটির সুযোগ দিয়ে চীনের স্বার্থে বাধাদানকারী ভূমিকা রাখতে পারে, যদিও বেইজিং ও ইসলামাবাদ নিজেদের “সব-মৌসুমী কৌশলগত মিত্র” বলে ঘোষণা দিয়েছে।
চীনের জন্য মূল সমস্যা হলো, তালেবান, পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং শক্তিশালী গোপন সংস্থা আইএসআইয়ের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর দায়িত্ব নিয়েছে তারা—ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়। দীর্ঘদিন ধরে আইএসআই তালেবানের পৃষ্ঠপোষক ও সংগঠক, এমনকি পারিবারিক ও বিবাহসূত্রেও সম্পর্কিত। কিন্তু ২০২১ সালের আগস্টের পর থেকেই তাদের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়। সাবেক প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি দেশ ছাড়ার পর কাবুলে তালেবান নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার মুহূর্তেই আইএসআই প্রধান ফায়েজ হামিদের আগমন পাকিস্তানের প্রভাব প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকে স্পষ্ট করে। এতে আংশিক সাফল্যও আসে, কারণ কুখ্যাত হাক্কানি নেটওয়ার্কের সিরাজউদ্দিন হাক্কানি অন্তর্বর্তী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন।
তবে শিগগিরই দুই পক্ষের সম্পর্ক প্রকাশ্যে ফাটল ধরে। বিতর্কিত ডুরান্ড লাইনে সীমান্ত সমস্যা তীব্র হয়। পাকিস্তান অভিযোগ তোলে, তালেবান তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)-কে অবাধ সুযোগ দিচ্ছে, যারা পাকিস্তানের ভেতরে হামলা চালায়। একইসঙ্গে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি)-এর আওতাধীন গওয়াদারসহ বিভিন্ন এলাকায় বেইজিংয়ের উপস্থিতির বিরুদ্ধে হামলা হয়। পাকিস্তানি গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২০ জন চীনা নাগরিক নিহত এবং ৩৫ জনের বেশি আহত হয়েছেন।
চীন আগে মধ্যস্থতার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বেইজিং হামাস নেতৃত্বকে আমন্ত্রণ জানায়, যেখানে তারা ফাতাহর সঙ্গে একপ্রকার ঐক্যচুক্তি স্বাক্ষর করে। ২০২৩ সালের মার্চে তারা ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ চুক্তি করায় সহায়তা করে। তবে ফিলিস্তিনি মধ্যস্থতা কেবল প্রদর্শনীমূলক ছিল, কার্যত সীমিত ফল দেয়। রিয়াদ ও তেহরানের ক্ষেত্রে, চীন মূলত সময় ও পরিস্থিতির কারণে সঠিক জায়গায় উপস্থিত হয়েছিল, যা সৌদি আরবকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বার্তা দেওয়ার সুযোগ করে দেয়।
কিন্তু পাকিস্তান-আফগানিস্তান সম্পর্ক মেরামত ভিন্ন ধরণের চ্যালেঞ্জ। চীন যদি প্রধান উদ্যোগ নেয়, তবে সীমিত অভিজ্ঞতার কারণে তারা এই অঞ্চলে গভীর জটিলতায় জড়িয়ে যেতে পারে। চীনের একমাত্র প্রচলিত কৌশল হলো অর্থ ঢেলে সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা। তাই ওয়াংয়ের সফরে ঘোষণা আসে যে আফগানিস্তানকে সিপিইসির সঙ্গে যুক্ত করা হবে। পাকিস্তানের জন্যও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লোভ দেখিয়ে বিচ্ছিন্ন তালেবানকে নিয়ন্ত্রণ করা লাভজনক হতে পারে। আর তা করতে ইসলামাবাদকে চীনের সাহায্য লাগবেই, কারণ তাদের নিজেদের অর্থনীতি পতনের মুখে।
চীনের দৃষ্টিতে এসব পরিকল্পনা কাগজে কলমে কার্যকর মনে হলেও বাস্তবে তারা এই অঞ্চলের সংস্কৃতি, মতাদর্শ ও ধর্মীয় ভিত্তি সম্পর্কে খুব সামান্যই বোঝে। নিজস্ব শিনজিয়াং প্রদেশে ইসলাম নিয়ে তাদের নীতি বিতর্কিত, যেখানে জনগণ কঠোর রাষ্ট্রীয় নজরদারির অধীনে বাস করে। অন্যদিকে, চীন তালেবানের কাছে সন্ত্রাসবাদ, বিশেষত উইঘুর যোদ্ধাদের বিষয়ে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা চায়। কিন্তু তাদের ভেঙে দেওয়ার বদলে তালেবান এসব গোষ্ঠীকে বাদাখশান প্রদেশের মতো সীমান্ত অঞ্চল থেকে সরিয়ে নেয়, যা চীনের সঙ্গে ৯০ কিলোমিটার সীমান্ত ভাগ করে। ২০২১ সাল থেকে চীন ওয়াখান করিডোরে সন্ত্রাসবিরোধী ঘাঁটি স্থাপনের চেষ্টা করছে, যা চীন, পাকিস্তান ও তাজিকিস্তানের সংযোগস্থল।
তবে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সম্পর্ক বেইজিংয়ের জন্য বড় নিরাপত্তা ফাঁদে পরিণত হতে পারে। ওয়াং আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সফর শেষ করার অল্প সময় পরই তালেবান অভিযোগ তোলে যে পাকিস্তান তাদের ভেতরে বিমান হামলা চালিয়েছে। এর জবাবে তারা পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতকে তলব করে। অথচ এ বছরের মে মাসেই পাকিস্তান রাষ্ট্রদূতের পদোন্নতি করেছিল। তালেবান আবার আঞ্চলিক কূটনীতিতেও সক্রিয়, শিগগিরই তাদের অন্তর্বর্তী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি ভারতের সফরে যেতে পারেন বলে জানা গেছে। এ পদক্ষেপ পাকিস্তানের অবিশ্বাস আরও বাড়াবে।
ভবিষ্যতে চীন হয়তো একমাত্র নিরাপত্তা নিশ্চয়তাকারী হিসেবে ভূমিকা নিতে বাধ্য হবে, যাতে তালেবান ও পাকিস্তান সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলায় না পড়ে। এই ভূমিকা একপ্রকার যুক্তরাষ্ট্রের পুরোনো ভূমিকাকে স্মরণ করিয়ে দেবে—যা নিয়ে চীন বরাবরই সমালোচনামুখর থেকেছে, একে বিদেশি হস্তক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত করে।
লেখক:কবীর তানেজা অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের উপপরিচালক ও ফেলো।