একটি নতুন বই যুক্তি দিচ্ছে যে চীনের প্রকৃত ভূ-রাজনৈতিক শক্তি তার প্রকৌশলীদের হাতে। লেখক ড্যান ওয়াং তার গ্রন্থ Breakneck: China’s Quest to Engineer the Future-এ দাবি করেছেন, চীন মূলত একটি “ইঞ্জিনিয়ারিং রাষ্ট্র”, যেখানে দ্রুত বাস্তবায়নই বড় শক্তি, আর যুক্তরাষ্ট্র আইনজীবীদের দেশ, যেখানে দীর্ঘ বিতর্কে সময় নষ্ট হয়।
চীনের ইঞ্জিনিয়ারিং সাফল্য
১৯৮০-এর দশক থেকে চীন এমন সব কাজ করেছে যা বিশ্বের কাছে বিস্ময়কর।
- আমেরিকার তুলনায় দ্বিগুণ দীর্ঘ মহাসড়ক নেটওয়ার্ক
- জাপানের তুলনায় ১৫ গুণ বড় হাইস্পিড রেলপথ
- বিশ্বে ব্যবহৃত সৌর ও বায়ুশক্তির প্রায় অর্ধেক নিজেরাই ব্যবহার করছে
- বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ উৎপাদিত পণ্য চীনেই তৈরি
এই বিশাল কর্মকাণ্ড সম্ভব হয়েছে কারণ চীনের প্রশাসনে বহু প্রকৌশলী নেতৃত্বে আছেন। ওয়াং বলেন, যেমন একজন শেফকে রান্নায় অভিজ্ঞতা দরকার, তেমনি শিল্পে দক্ষতা গড়ে উঠেছে কারখানা শ্রমিক ও ব্যবস্থাপকদের হাতে বহু বছরের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে।

বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের অবস্থান
চীনের কারখানাগুলো স্মার্টফোন, ড্রোন ও উন্নত ইলেকট্রনিক্স তৈরি করে অ্যাপল, স্যামসাং ও হুয়াওয়ের মতো কোম্পানিকে শক্তি জুগিয়েছে। এই অভিজ্ঞতাই আমেরিকার তুলনায় তাদের বড় সুবিধা। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বারবার বলেছেন, বাস্তব অর্থনীতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং শিল্পায়ন ত্যাগ করা যাবে না।
চীন ইতিমধ্যেই শীর্ষে রয়েছে নানা খাতে—
- পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তি
- আল্ট্রা-হাই ভোল্টেজ বিদ্যুৎ পরিবহন
- হাইস্পিড রেল
- ৫জি নেটওয়ার্ক

সামরিক ও কৌশলগত প্রেক্ষাপট
যদি কখনো সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে, চীনের ইঞ্জিনিয়ারিং শক্তি স্পষ্ট হতে পারে।
- ২০২২ সালে চীনের প্রায় ১,৮০০ জাহাজ নির্মাণাধীন ছিল, আর আমেরিকার মাত্র ৫টি।
- ইউক্রেন যুদ্ধে দেখা গেছে, যত গোলা-বন্দুক আমেরিকা এক মাসে তৈরি করে, ইউক্রেন দুই দিনে সেগুলো খরচ করেছে।
- ওয়াং মনে করিয়ে দেন, কেবল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুদ্ধ জিততে পারবে না; এগুলোকে অস্ত্র, ড্রোন ও গোলাবারুদে রূপান্তর করতে হবে।

চীনের চ্যালেঞ্জ
তবে সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতাও আছে।
- অতিরিক্ত উৎপাদন
- ঋণের বোঝা
- পরিবেশ ধ্বংস
- মানুষের জীবনযাত্রার চাপ
ওয়াং মনে করেন, এগুলো আসলে “ইঞ্জিনিয়ারিং রাষ্ট্র”-এর অতিরিক্ততার ফল। কিন্তু মূল সমস্যা হলো শীর্ষ-নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় একদলীয় স্বার্থে, জনগণের ব্যক্তিগত চাহিদা উপেক্ষা করে।

এক সন্তান নীতি
ওয়াং উদাহরণ দেন, কেবল একটি ইঞ্জিনিয়ারিং রাষ্ট্রেই ক্ষেপণাস্ত্র বিজ্ঞানী সঙ জিয়ানকে এক সন্তান নীতি প্রণয়নের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এর ফল—৩২১ মিলিয়ন গর্ভপাত এবং ১০৮ মিলিয়ন নারীর বন্ধ্যাকরণ। অথচ প্রকৃত ইঞ্জিনিয়ারিং মানসিকতা থাকলে ব্যয়-সুবিধার বিশ্লেষণ এবং ফলাফল অনুযায়ী সমন্বয় করা হতো।
মহামারী মোকাবিলা
ওয়াং তার তিন বছরের “শূন্য কোভিড” অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, চীন একমাত্র দেশ যেখানে মানুষকে আইবুপ্রোফেন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল, কারণ এতে জ্বর কমে গেলে শনাক্তকরণ কঠিন হয়ে পড়ত। তার মতে, এটি ইঞ্জিনিয়ারিং রাষ্ট্রের “বিকৃত যুক্তি”-র নিদর্শন। কিন্তু আসলেই এটি ছিল কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার ফল, যেখানে রাজনৈতিক ভয়ের কারণে কেউ ভিন্ন মত প্রকাশের সাহস করে না।
ওয়াংয়ের ধারণা অনুযায়ী, “ইঞ্জিনিয়ারিং রাষ্ট্র” ধারণাটি আমেরিকা-চীন শিল্প প্রতিযোগিতা বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক। কিন্তু চীনের শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতা বুঝতে হলে মূলত “একদলীয় রাষ্ট্র” ধারণার দিকে তাকাতে হবে।
সারাংশ হলো—চীন দ্রুত তৈরি করতে পারে, কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেই তৈরি মানুষের জীবনে কতটা কল্যাণ বয়ে আনে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















