শুল্কের চাপ ও এশীয় রপ্তানি খাত
এশিয়ার রপ্তানিকারকেরা যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ নিজেরা বহন করছে এবং বাকিটা ক্রেতাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে—এমন তথ্য জানিয়েছে নোমুরার এশিয়া ইকোনমিক মান্থলি রিপোর্ট (৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত)।
সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত উৎপাদন শিল্পসমৃদ্ধ দেশগুলো শুল্কের ২০% এর বেশি নিজেদের কাঁধে নিচ্ছে। অপরদিকে আসিয়ান দেশগুলো কোনো খরচই বহন করছে না। চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রে এই হার ১০% এরও কম।
কেন ভিন্নতা তৈরি হচ্ছে
নোমুরার বিশ্লেষক সোনাল ভার্মা ও তো সি ইং জানান, উন্নত উৎপাদনশীল শিল্পগুলো যেহেতু উচ্চমূল্যের পণ্য রপ্তানি করে, তাই তাদের খরচ শোষণের ক্ষমতা বেশি। কিন্তু শ্রমঘন শিল্পনির্ভর আসিয়ান দেশগুলোর কোনো মার্জিন নমনীয়তা নেই, ফলে তারা শুল্কের পুরো খরচই আমেরিকান ক্রেতাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে।
ডাবল চাপের মুখে এশিয়া
আগামী দিনে এশিয়ার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে একদিকে প্রতিযোগিতামূলক থাকতে কম মূল্যে রপ্তানি চালানো, অন্যদিকে স্থানীয় মুদ্রার মূল্য বৃদ্ধি। এর ফলে এশীয় রপ্তানিকারকদের সামনে কঠিন সিদ্ধান্ত—বেশি খরচ ক্রেতাদের উপর চাপালে বাজার হারানোর ঝুঁকি, আর খরচ নিজেরা নিলে লাভ কমে যাওয়ার শঙ্কা।

ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কহার
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈশ্বিক শুল্কহার ৭ আগস্ট রাত থেকে কার্যকর হয়েছে।
- সিঙ্গাপুর: ১০% (সর্বনিম্ন হার)
- মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া: ১৯%
- তাইওয়ান: ২০%
এই শুল্ক প্রয়োগের পর এশিয়ার রপ্তানি দামে পরিবর্তন এসেছে। গাড়ি, ইলেকট্রনিক্স, কেমিক্যাল ও অ্যালুমিনিয়াম পণ্যের দাম কমেছে। আবার টেক্সটাইল, ওষুধ, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও মোটরগাড়ির যন্ত্রাংশের দাম বেড়েছে।
নোমুরার বিশ্লেষণ
রিপোর্টে জানানো হয়েছে, জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত মার্কিন আমদানি মূল্যসূচক ও এশীয় রপ্তানি মূল্যসূচক পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে ধরা হয়েছে, ডলার দুর্বল হলে প্রায় ২৫% প্রভাব রপ্তানি দামে প্রতিফলিত হয়। তবে নোমুরা সতর্ক করেছে যে, এশীয় রপ্তানি মূল্যসূচক সামগ্রিক পর্যায়ে পাওয়া যায় বলে মার্কিন শুল্কের প্রকৃত প্রভাব কিছুটা আড়াল হতে পারে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে:
- বিশ্বব্যাপী রপ্তানিকারকেরা প্রায় ২৫% শুল্কভার বহন করছে।
- সিঙ্গাপুর: ২০% এর বেশি শোষণ
- চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া: ১০% এর কম
- অন্যান্য আসিয়ান দেশ: শূন্য শতাংশ
শিল্পভিত্তিক প্রভাব
- জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার গাড়ির দাম কমেছে।
- সিঙ্গাপুরের সেমিকন্ডাক্টর ও ইলেকট্রনিক্সের দাম হ্রাস পেয়েছে।
- চীনের ধাতব পণ্যের দাম কমেছে।
- সিঙ্গাপুরে ফার্মাসিউটিক্যালসের দাম বেড়েছে।
- আসিয়ানের টেক্সটাইল, থাইল্যান্ড-চীন-জাপান-কোরিয়ার বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, এবং জাপান-কোরিয়ার মোটরযন্ত্রাংশের দাম বেড়েছে।
প্রতিযোগিতার তীব্রতা
শুল্ক বৃদ্ধির কারণে দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়ছে।
- টেক্সটাইল: চীনের দাম কমলেও আসিয়ান দেশের দাম বেড়েছে, ফলে চীনের প্রতিযোগিতা শক্তি বাড়ছে।
- কেমিক্যাল: দক্ষিণ কোরিয়া প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় আক্রমণাত্মকভাবে দাম কমিয়েছে।
- ইলেকট্রনিক্স: জাপান ও চীন দাম কমিয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়া দাম বাড়িয়েছে।

লাভের সংকট ও ঝুঁকি
চীনে লাভ কমেছে ৪.৩%—মূলত দামের কাটছাঁটের কারণে। আসিয়ান দেশগুলো তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল রয়েছে কারণ রপ্তানি দামের বৃদ্ধি মুদ্রার শক্তিশালী হওয়া সামলে নিয়েছে। তবে আগস্টের শুল্কবৃদ্ধি এশিয়ার বাজারে আরও মার্জিন সংকট তৈরি করতে পারে।
নোমুরার মতে, এখন পর্যন্ত কিছু রপ্তানিকারক খরচ বাঁচাতে ও দক্ষতা বাড়াতে অস্থায়ী কৌশল নিয়েছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এগুলো কার্যকর নয়। খরচ চাপ বাড়লে তা হয় ক্রেতাদের উপর চাপানো হবে, নয়তো রপ্তানিকারকের লাভ আরও কমে যাবে।
অর্থনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাব
রিপোর্টে সতর্ক করা হয়েছে, যদি এশিয়ার মুনাফা সংকট আরও গভীর হয় তবে তা বাস্তব অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতিগুলোতে মূলধন ব্যয় কমানো, নতুন কর্মী না নিয়োগ বা মজুরি সীমিত রাখার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। এর ফলে বাণিজ্য ধাক্কা ও অভ্যন্তরীণ চাহিদার মধ্যে নেতিবাচক চক্র তৈরি হতে পারে।
নীতিগত করণীয়
নোমুরা বলছে, পরিস্থিতি সামাল দিতে এশীয় নীতিনির্ধারকদের লক্ষ্যভিত্তিক ভর্তুকি, কর রেয়াত বা এমনকি মুদ্রাবাজারে হস্তক্ষেপের মতো পদক্ষেপ নিতে হতে পারে। তবে প্রতিটি পদক্ষেপের নিজস্ব ঝুঁকি রয়েছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















