ট্রাম্পের শুল্ক নীতির ক্ষতিকর প্রভাব থাকলেও নয়াদিল্লি ও বেইজিং স্বভাবগতভাবেই প্রতিদ্বন্দ্বী।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি ভারত-চীন-রাশিয়া একটি উদীয়মান জোটকে ভয় পাওয়া উচিত? গত সপ্তাহে চীনের তিয়ানজিনে সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) শীর্ষ বৈঠকে ভারতের অংশগ্রহণের পর অনেক বিশ্লেষক ও রাজনীতিবিদ এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এই উদ্বেগ মোটেই যৌক্তিক নয়। যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক তীব্রভাবে শীতল হয়ে পড়লেও নয়াদিল্লি বেইজিংয়ের সঙ্গে জোট বাঁধবে—এই সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পাশাপাশি দাঁড়ানো ছবি উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে যে এই তিন দেশ একত্রে হাত মিলাচ্ছে। সিএনএনের ভাষ্যকার ভ্যান জোন্স বলেছেন, এ ধরনের ছবি “প্রত্যেক আমেরিকানের মেরুদণ্ডে শিহরণ জাগানো উচিত। এটি পশ্চিমের হৃদয়ে বিদ্ধ হওয়া এক খঞ্জর।”
পিবিএসে অ্যাটলান্টিক-এর সম্পাদক জেফরি গোল্ডবার্গ মন্তব্য করেছেন, “মোদির অবস্থান যেন চীন-রাশিয়ার শিবিরে চলে গেছে।” শুক্রবার ট্রাম্প ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ শি, পুতিন ও মোদির ছবি শেয়ার করেন। তিনি লেখেন, “দেখা যাচ্ছে আমরা ভারত ও রাশিয়াকে হারালাম অন্ধকারতম চীনের কাছে।” তবে একই দিনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, তিনি মনে করেন না যে ভারতকে চীনের কাছে হারিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং মোদির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো।
নিঃসন্দেহে বেইজিং-মস্কো-নয়াদিল্লি অক্ষ ওয়াশিংটনের জন্য দুঃসংবাদ হবে। চীন, রাশিয়া ও ভারত ইউরেশীয় মহাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিন শক্তি। তিন দেশেই আছে পারমাণবিক অস্ত্র। ট্রাম্পের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক বসানোর আগে পর্যন্ত ভারতকে ১০ দেশের ব্রিকস জোটে (যেখানে চীন ও রাশিয়াও আছে) সবচেয়ে প্রো-আমেরিকান দেশ হিসেবে দেখা হতো। বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল দেশ এবং পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতিকে চীনের দিকে ঠেলে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিশাল ভুল হবে।
তবে ভূরাজনীতি এত সহজ নয়। ট্রাম্প ভারতের সঙ্গে মার্কিন কূটনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন বটে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে নয়াদিল্লি বেইজিংয়ের মিত্র হবে। কারণ দুই দেশের বিভেদ খুব গভীর।
প্রথমত, ভারত ও চীনের মধ্যে প্রায় ২,২০০ মাইল দীর্ঘ বিতর্কিত সীমান্ত রয়েছে। সীমান্ত বিরোধের সমাধান না করতে পারায় ১৯৬২ সালে দুই দেশের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ হয়েছিল। ২০২০ সালে ভারত ও চীনের সেনাদের হাতাহাতিতে কমপক্ষে ২০ জন ভারতীয় ও ৪ জন চীনা সেনা নিহত হয়। এরপর থেকে দুই দেশই সীমান্তে হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করেছে। বিশ্লেষকরা অনুমান করেন, ২০২০ সালের পর থেকে চীন ভারতের অন্তত ৮০০ বর্গমাইল ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছে। ৩০ বারেরও বেশি বৈঠক সত্ত্বেও চীন ২০২০-পূর্ব সীমান্তে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
এছাড়া চীন ভারতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে কূটনৈতিক ও সামরিকভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে। পাকিস্তানের সামরিক আমদানির প্রায় ৮০ শতাংশ সরবরাহ করে চীন, এবং গত মে মাসে চার দিনের ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে পাকিস্তানের বিমানবাহিনীকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত চীনা বিনিয়োগকারীদের সরিয়ে আনতে চেষ্টা করেছে এবং চীন ভারতের শিল্পায়ন মন্থর করতে টানেল-বোরিং মেশিন ও রেয়ার আর্থ ম্যাগনেট রপ্তানি আটকে দিয়েছে। এছাড়া চীন অ্যাপলের উপ-ঠিকাদার ফক্সকনকে চীনা প্রকৌশলীদের ভারতীয়দের প্রশিক্ষণ না দেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছে।
রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও জটিল। গত এক দশকে ভারত রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট অনুমান করছে, ২০০৯-১৩ সময়ে ভারতের অস্ত্র আমদানির ৭৬ শতাংশ এসেছিল রাশিয়া থেকে, কিন্তু ২০১৯-২৩ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩৬ শতাংশে। এর ফলে লাভবান হয়েছে ফ্রান্স, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র।
তবে একই সঙ্গে ভারত রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল রয়ে গেছে সামরিক যন্ত্রাংশ ও উন্নত অস্ত্র প্রযুক্তির জন্য, যার মধ্যে রয়েছে মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও যৌথভাবে তৈরি ক্রুজ মিসাইল। ২০২২ সালে ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে ভারত রাশিয়া থেকে ছাড়কৃত দামে তেল আমদানি ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ভারতের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপের অন্যতম কারণ। অনেক ভারতীয় রাশিয়াকে—চীনের বিপরীতে—একজন বিশ্বস্ত অংশীদার হিসেবে দেখে।
এই জটিল বাস্তবতায় রাশিয়া-চীন-ভারত জোট গড়ে ওঠার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তবে ট্রাম্পের শুল্ক নীতি এরই মধ্যে প্রভাব ফেলবে।
যুক্তরাষ্ট্র ঝুঁকিতে ফেলছে দশকের পর দশক ধরে ধৈর্য ও দক্ষতায় গড়ে তোলা ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সাফল্যগুলো। ভারত চীনকে বিরক্ত করার ঝুঁকি নিয়েছে কোয়াডে (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াসহ চার জাতির জোট) অংশ নিয়ে। এশিয়ার অনেক দেশের বিপরীতে ভারত হুয়াওয়ে, বাইটড্যান্স ও বিওয়াইডির মতো চীনা কোম্পানিকে সীমিত করেছে, প্রকাশ্যে বেইজিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের বিরোধিতা করেছে এবং ইসরায়েল ও অস্ট্রেলিয়ার মতো মার্কিন মিত্রদের কাছে গেছে। ভারতের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ট্রাম্প আসলে ভারতীয় রাজনীতিতে চীনপন্থী ও রাশিয়াপন্থী কণ্ঠগুলোকে শক্তিশালী করছেন, যারা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে ওয়াশিংটনকে বিশ্বাস করা যায় না।
মঙ্গলবার ট্রাম্প ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ মোদিকে তাঁর “অত্যন্ত ভালো বন্ধু” বলে উল্লেখ করেন এবং দাবি করেন, দুই দেশ অবশ্যই একটি বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছাবে। যদি তা হয়, তবে নয়াদিল্লি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন নীতি পুনরায় সঠিক পথে ফিরতে পারে। ভারতের সবচেয়ে প্রাকৃতিক অংশীদার ওয়াশিংটন, বেইজিং নয়।