০৫:৩৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মান্না: ঢাকার সিনেমার এক কিংবদন্তি নায়ক

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এমন অনেক নাম আছে, যারা সময়ের সঙ্গে ফিকে হয়ে গেছে। কিন্তু এমন একজন নায়কের নাম এখনও কোটি দর্শকের হৃদয়ে অমলিন—তিনি মান্না। অভিনয়, পরিশ্রম, মানবিকতা ও দর্শকপ্রিয়তার এক অনন্য সমন্বয় ঘটিয়ে মান্না হয়ে উঠেছিলেন ‘জনতার হিরো’। তিনি শুধু রুপালি পর্দার তারকা ছিলেন না, ছিলেন সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন।

শৈশব ও বেড়ে ওঠা

১৯৬৪ সালের ৬ এপ্রিল টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী উপজেলার এলাঙ্গা ইউনিয়নের দাপুনিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এসএম আসলাম তালুকদার, যিনি পরে চলচ্চিত্রে মান্না নামে পরিচিত হন। ছোটবেলা থেকেই প্রাণবন্ত ও দুঃসাহসী মান্না ছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়। স্কুল ও কলেজে পড়ার সময় থেকেই নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। এভাবেই অভিনয়ের প্রতি তাঁর ভালোবাসা তৈরি হয়।

চলচ্চিত্রে আগমন

১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (এফডিসি) আয়োজিত ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মান্নার চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে। প্রথম ছবি ছিল ‘তওবা’। শুরুর দিকে তেমন সাফল্য না এলেও ধীরে ধীরে তিনি নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেন। নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু হয় তাঁর উত্থান, যা তাঁকে নিয়ে যায় ঢাকাই সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়কদের শীর্ষে।

জনপ্রিয়তার বিস্তার

১৯৯১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দাঙ্গা’ এবং ‘অধিকার’-এর মাধ্যমে আলোচনায় আসেন মান্না। এরপর একে একে ‘লাল বাদশাহ’, ‘আম্মাজান’, ‘বাস্তব’, ‘বাস্তবতার রূপকথা’ প্রভৃতি ছবির মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন প্রযোজক-পরিচালকদের নির্ভরযোগ্য নাম। তাঁর সংলাপ বলার ভঙ্গি, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং শরীরী ভাষা দর্শককে মুগ্ধ করত।

মান্না ছিলেন সেই সময়ের অন্যতম বাণিজ্যিক ভরসা। প্রযোজকরা জানতেন, মান্নাকে নিয়ে ছবি করলে হলে দর্শক আসবেই। বক্স অফিসের দাপট, গণমানুষের ভালোবাসা এবং ভিন্নধর্মী চরিত্রে সফল অভিনয় তাঁকে পরিণত করেছিল এক ‘জনতার হিরো’তে।

ব্যক্তিগত জীবন ও মানবিকতা

১৯৮৮ সালে মান্না বিয়ে করেন শেলি মান্নাকে। তাঁদের একমাত্র সন্তান সাদমান সাদ। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন পরিবারকেন্দ্রিক, স্নেহশীল ও শান্ত স্বভাবের মানুষ।

অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি সামাজিক কর্মকাণ্ডেও যুক্ত ছিলেন। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় সহায়তা করা, শিল্পীদের কল্যাণে কাজ করা—এসব ছিল তাঁর জীবনের অংশ। এই মানবিক গুণাবলিই তাঁকে আলাদা মর্যাদা এনে দেয়।

পুরস্কার ও সম্মাননা

চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা অর্জন করেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর সময়ে শিল্পী সমিতির কার্যক্রম ছিল প্রাণবন্ত, যা পরবর্তী সময় অনেকের কাছেই উদাহরণ হিসেবে গণ্য হয়।

আইকনিক ছবির বিশ্লেষণ

১. দাঙ্গা (১৯৯১)

রাজনৈতিক অস্থিরতা ও গোষ্ঠীগত সংঘর্ষকে ঘিরে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে মান্না অভিনয় করেন প্রতিবাদী চরিত্রে।
বিশ্লেষণ: এ ছবির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় মান্নার ‘অ্যাকশন হিরো’ ইমেজ। সংলাপের দৃঢ়তা ও শরীরী ভাষার শক্তি তাঁকে আলাদা আসনে বসায়।

২. লাল বাদশাহ (১৯৯৯)

শিবলী সাদিক পরিচালিত এ ছবিতে মান্না অভিনয় করেন এক ন্যায়পরায়ণ যোদ্ধার চরিত্রে, যিনি দুর্বল মানুষের পাশে দাঁড়ান।
বিশ্লেষণ: এ ছবির মাধ্যমে মান্না গণমানুষের নায়ক হয়ে ওঠেন। দর্শক তাঁর চরিত্রে নিজেদের সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেয়েছিল।

৩. আম্মাজান (১৯৯৯)

মায়ের প্রতি সন্তানের অগাধ ভালোবাসার কাহিনি ঘিরে নির্মিত এ ছবিতে মান্না মাতৃভক্ত সন্তানের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
বিশ্লেষণ: ছবিটি মান্নাকে আবেগঘন নায়ক হিসেবে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। ব্যবসায়িকভাবেও এটি ঢাকাই সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম সেরা সাফল্য।

৪. বাস্তব (২০০২)

চাষী নজরুল ইসলামের পরিচালনায় নির্মিত এ ছবিটি অপরাধজগত ও সমাজভিত্তিক বাস্তবতা তুলে ধরে।
বিশ্লেষণ: এখানে মান্না ছিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তিনি দর্শকের কাছে হয়ে ওঠেন শুধু নায়ক নন, সামাজিক সচেতনতার প্রতীক।

৫. বাস্তবতার রূপকথা (২০০৪)

দুর্নীতি, রাজনৈতিক দমননীতি ও সাধারণ মানুষের সংগ্রামই ছিল এ ছবির মূল বিষয়।
বিশ্লেষণ: ছবিটি প্রমাণ করে, জীবনের শেষ প্রান্তেও মান্না ছিলেন সমান শক্তিশালী ও প্রভাবশালী নায়ক।

সমসাময়িক অন্যান্য নায়কের সঙ্গে তুলনা

মান্নার সময়ের অন্যান্য নায়ক ছিলেন রুবেল, সালমান শাহ, ওমর সানী, আলমগীর প্রমুখ।

  • সালমান শাহ ছিলেন রোমান্টিক নায়কের প্রতীক। কিন্তু ১৯৯৬ সালে তাঁর অকাল মৃত্যু ঢালিউডে বড় শূন্যতা তৈরি করে।
  • রুবেল ছিলেন অ্যাকশন ঘরানার আরেক জনপ্রিয় মুখ, তবে তিনি দীর্ঘমেয়াদে বাণিজ্যিক সাফল্য ধরে রাখতে পারেননি।
  • আলমগীর ছিলেন বহুমাত্রিক চরিত্রের অভিনেতা, তবে নব্বইয়ের দশকে তিনি কিছুটা প্রযোজনা ও পরিচালনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

এই প্রেক্ষাপটে মান্না একাই হয়ে ওঠেন ঢাকাই সিনেমার প্রধান ভরসা। তিনি একইসঙ্গে অ্যাকশন, আবেগ ও সামাজিক বার্তাধর্মী চরিত্রে সমানভাবে সাফল্য পান—যা তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করে।

চলচ্চিত্র শিল্পে তাঁর প্রভাব

মান্না প্রমাণ করেছিলেন, একজন নায়ক কেবল পর্দার সাফল্যের জন্য নন, সামাজিক প্রভাবের কারণেও প্রজন্মের পর প্রজন্ম মনে রাখবে। তাঁর ছবিগুলো শুধু বিনোদন নয়, অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।

প্রযোজকরা মান্নাকে নিয়ে বিনিয়োগ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন, কারণ তাঁর ছবির টিকিট বিক্রি নিশ্চিত ছিল। এ কারণে তাঁকে বলা হতো “বক্স অফিস হিরো”।

নতুন প্রজন্মের চোখে মান্না

মৃত্যুর পর এক যুগ পেরিয়ে গেলেও নতুন প্রজন্ম মান্নাকে ভোলেনি। ইউটিউব ও টেলিভিশনের পুনঃপ্রচার দেখে তরুণরা এখনও তাঁর অভিনয়ে মুগ্ধ হয়। অনেক সমালোচক বলেন, মান্না যদি বেঁচে থাকতেন তবে ঢাকাই সিনেমার সংকট এত গভীর হতো না।

তরুণ চলচ্চিত্রপ্রেমীরা মান্নাকে দেখেন “বাস্তবের নায়ক” হিসেবে, যিনি কেবল রূপালি পর্দায় লড়াই করেননি, বরং সাধারণ মানুষের সংগ্রামকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

আকস্মিক মৃত্যু ও শূন্যতা

২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৪৪ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মান্নার মৃত্যু হয়। তাঁর চলে যাওয়া ঢাকাই সিনেমায় এক অপূরণীয় শূন্যতা সৃষ্টি করে। আজও সেই শূন্যতা পূরণ হয়নি।

মান্না ছিলেন এমন এক নায়ক, যিনি একইসঙ্গে বাণিজ্যিক সাফল্য ও সামাজিক বার্তা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন পরিশ্রমী, মানবিক এবং দর্শকের প্রতি দায়বদ্ধ। তাঁর সময়কালে চলচ্চিত্রশিল্পে স্থবিরতা থাকলেও মান্না ছিলেন ভরসার প্রতীক।

আজও ভক্তরা তাঁকে মনে রাখে ‘জনতার হিরো’ হিসেবে। ঢাকাই সিনেমার ইতিহাসে মান্না শুধু একজন নায়ক নন, বরং এক কিংবদন্তি, যাঁর স্মৃতি ও প্রভাব অমলিন হয়ে থাকবে।

মান্না: ঢাকার সিনেমার এক কিংবদন্তি নায়ক

১১:০১:০৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এমন অনেক নাম আছে, যারা সময়ের সঙ্গে ফিকে হয়ে গেছে। কিন্তু এমন একজন নায়কের নাম এখনও কোটি দর্শকের হৃদয়ে অমলিন—তিনি মান্না। অভিনয়, পরিশ্রম, মানবিকতা ও দর্শকপ্রিয়তার এক অনন্য সমন্বয় ঘটিয়ে মান্না হয়ে উঠেছিলেন ‘জনতার হিরো’। তিনি শুধু রুপালি পর্দার তারকা ছিলেন না, ছিলেন সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন।

শৈশব ও বেড়ে ওঠা

১৯৬৪ সালের ৬ এপ্রিল টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী উপজেলার এলাঙ্গা ইউনিয়নের দাপুনিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এসএম আসলাম তালুকদার, যিনি পরে চলচ্চিত্রে মান্না নামে পরিচিত হন। ছোটবেলা থেকেই প্রাণবন্ত ও দুঃসাহসী মান্না ছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়। স্কুল ও কলেজে পড়ার সময় থেকেই নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। এভাবেই অভিনয়ের প্রতি তাঁর ভালোবাসা তৈরি হয়।

চলচ্চিত্রে আগমন

১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (এফডিসি) আয়োজিত ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মান্নার চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে। প্রথম ছবি ছিল ‘তওবা’। শুরুর দিকে তেমন সাফল্য না এলেও ধীরে ধীরে তিনি নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেন। নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু হয় তাঁর উত্থান, যা তাঁকে নিয়ে যায় ঢাকাই সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়কদের শীর্ষে।

জনপ্রিয়তার বিস্তার

১৯৯১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দাঙ্গা’ এবং ‘অধিকার’-এর মাধ্যমে আলোচনায় আসেন মান্না। এরপর একে একে ‘লাল বাদশাহ’, ‘আম্মাজান’, ‘বাস্তব’, ‘বাস্তবতার রূপকথা’ প্রভৃতি ছবির মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন প্রযোজক-পরিচালকদের নির্ভরযোগ্য নাম। তাঁর সংলাপ বলার ভঙ্গি, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং শরীরী ভাষা দর্শককে মুগ্ধ করত।

মান্না ছিলেন সেই সময়ের অন্যতম বাণিজ্যিক ভরসা। প্রযোজকরা জানতেন, মান্নাকে নিয়ে ছবি করলে হলে দর্শক আসবেই। বক্স অফিসের দাপট, গণমানুষের ভালোবাসা এবং ভিন্নধর্মী চরিত্রে সফল অভিনয় তাঁকে পরিণত করেছিল এক ‘জনতার হিরো’তে।

ব্যক্তিগত জীবন ও মানবিকতা

১৯৮৮ সালে মান্না বিয়ে করেন শেলি মান্নাকে। তাঁদের একমাত্র সন্তান সাদমান সাদ। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন পরিবারকেন্দ্রিক, স্নেহশীল ও শান্ত স্বভাবের মানুষ।

অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি সামাজিক কর্মকাণ্ডেও যুক্ত ছিলেন। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় সহায়তা করা, শিল্পীদের কল্যাণে কাজ করা—এসব ছিল তাঁর জীবনের অংশ। এই মানবিক গুণাবলিই তাঁকে আলাদা মর্যাদা এনে দেয়।

পুরস্কার ও সম্মাননা

চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা অর্জন করেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর সময়ে শিল্পী সমিতির কার্যক্রম ছিল প্রাণবন্ত, যা পরবর্তী সময় অনেকের কাছেই উদাহরণ হিসেবে গণ্য হয়।

আইকনিক ছবির বিশ্লেষণ

১. দাঙ্গা (১৯৯১)

রাজনৈতিক অস্থিরতা ও গোষ্ঠীগত সংঘর্ষকে ঘিরে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে মান্না অভিনয় করেন প্রতিবাদী চরিত্রে।
বিশ্লেষণ: এ ছবির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় মান্নার ‘অ্যাকশন হিরো’ ইমেজ। সংলাপের দৃঢ়তা ও শরীরী ভাষার শক্তি তাঁকে আলাদা আসনে বসায়।

২. লাল বাদশাহ (১৯৯৯)

শিবলী সাদিক পরিচালিত এ ছবিতে মান্না অভিনয় করেন এক ন্যায়পরায়ণ যোদ্ধার চরিত্রে, যিনি দুর্বল মানুষের পাশে দাঁড়ান।
বিশ্লেষণ: এ ছবির মাধ্যমে মান্না গণমানুষের নায়ক হয়ে ওঠেন। দর্শক তাঁর চরিত্রে নিজেদের সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেয়েছিল।

৩. আম্মাজান (১৯৯৯)

মায়ের প্রতি সন্তানের অগাধ ভালোবাসার কাহিনি ঘিরে নির্মিত এ ছবিতে মান্না মাতৃভক্ত সন্তানের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
বিশ্লেষণ: ছবিটি মান্নাকে আবেগঘন নায়ক হিসেবে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। ব্যবসায়িকভাবেও এটি ঢাকাই সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম সেরা সাফল্য।

৪. বাস্তব (২০০২)

চাষী নজরুল ইসলামের পরিচালনায় নির্মিত এ ছবিটি অপরাধজগত ও সমাজভিত্তিক বাস্তবতা তুলে ধরে।
বিশ্লেষণ: এখানে মান্না ছিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তিনি দর্শকের কাছে হয়ে ওঠেন শুধু নায়ক নন, সামাজিক সচেতনতার প্রতীক।

৫. বাস্তবতার রূপকথা (২০০৪)

দুর্নীতি, রাজনৈতিক দমননীতি ও সাধারণ মানুষের সংগ্রামই ছিল এ ছবির মূল বিষয়।
বিশ্লেষণ: ছবিটি প্রমাণ করে, জীবনের শেষ প্রান্তেও মান্না ছিলেন সমান শক্তিশালী ও প্রভাবশালী নায়ক।

সমসাময়িক অন্যান্য নায়কের সঙ্গে তুলনা

মান্নার সময়ের অন্যান্য নায়ক ছিলেন রুবেল, সালমান শাহ, ওমর সানী, আলমগীর প্রমুখ।

  • সালমান শাহ ছিলেন রোমান্টিক নায়কের প্রতীক। কিন্তু ১৯৯৬ সালে তাঁর অকাল মৃত্যু ঢালিউডে বড় শূন্যতা তৈরি করে।
  • রুবেল ছিলেন অ্যাকশন ঘরানার আরেক জনপ্রিয় মুখ, তবে তিনি দীর্ঘমেয়াদে বাণিজ্যিক সাফল্য ধরে রাখতে পারেননি।
  • আলমগীর ছিলেন বহুমাত্রিক চরিত্রের অভিনেতা, তবে নব্বইয়ের দশকে তিনি কিছুটা প্রযোজনা ও পরিচালনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

এই প্রেক্ষাপটে মান্না একাই হয়ে ওঠেন ঢাকাই সিনেমার প্রধান ভরসা। তিনি একইসঙ্গে অ্যাকশন, আবেগ ও সামাজিক বার্তাধর্মী চরিত্রে সমানভাবে সাফল্য পান—যা তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করে।

চলচ্চিত্র শিল্পে তাঁর প্রভাব

মান্না প্রমাণ করেছিলেন, একজন নায়ক কেবল পর্দার সাফল্যের জন্য নন, সামাজিক প্রভাবের কারণেও প্রজন্মের পর প্রজন্ম মনে রাখবে। তাঁর ছবিগুলো শুধু বিনোদন নয়, অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।

প্রযোজকরা মান্নাকে নিয়ে বিনিয়োগ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন, কারণ তাঁর ছবির টিকিট বিক্রি নিশ্চিত ছিল। এ কারণে তাঁকে বলা হতো “বক্স অফিস হিরো”।

নতুন প্রজন্মের চোখে মান্না

মৃত্যুর পর এক যুগ পেরিয়ে গেলেও নতুন প্রজন্ম মান্নাকে ভোলেনি। ইউটিউব ও টেলিভিশনের পুনঃপ্রচার দেখে তরুণরা এখনও তাঁর অভিনয়ে মুগ্ধ হয়। অনেক সমালোচক বলেন, মান্না যদি বেঁচে থাকতেন তবে ঢাকাই সিনেমার সংকট এত গভীর হতো না।

তরুণ চলচ্চিত্রপ্রেমীরা মান্নাকে দেখেন “বাস্তবের নায়ক” হিসেবে, যিনি কেবল রূপালি পর্দায় লড়াই করেননি, বরং সাধারণ মানুষের সংগ্রামকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

আকস্মিক মৃত্যু ও শূন্যতা

২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৪৪ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মান্নার মৃত্যু হয়। তাঁর চলে যাওয়া ঢাকাই সিনেমায় এক অপূরণীয় শূন্যতা সৃষ্টি করে। আজও সেই শূন্যতা পূরণ হয়নি।

মান্না ছিলেন এমন এক নায়ক, যিনি একইসঙ্গে বাণিজ্যিক সাফল্য ও সামাজিক বার্তা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন পরিশ্রমী, মানবিক এবং দর্শকের প্রতি দায়বদ্ধ। তাঁর সময়কালে চলচ্চিত্রশিল্পে স্থবিরতা থাকলেও মান্না ছিলেন ভরসার প্রতীক।

আজও ভক্তরা তাঁকে মনে রাখে ‘জনতার হিরো’ হিসেবে। ঢাকাই সিনেমার ইতিহাসে মান্না শুধু একজন নায়ক নন, বরং এক কিংবদন্তি, যাঁর স্মৃতি ও প্রভাব অমলিন হয়ে থাকবে।