শুরুর জীবন ও ক্রিকেটের প্রতি আকর্ষণ
মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন ১৯৬৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি হায়দ্রাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হওয়া এই ক্রিকেটার ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলায় আগ্রহী ছিলেন। স্কুল জীবনে ফুটবল খেললেও কলেজে পড়ার সময় তাঁর প্রতিভা ক্রিকেটে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। হায়দ্রাবাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের মাধ্যমে নির্বাচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। তাঁর শান্ত স্বভাব, নিবেদিত মনোভাব এবং অনুশীলনে কঠোরতা তাঁকে দ্রুত ভারতীয় দলে জায়গা করে নিতে সাহায্য করে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ঝলমলে সূচনা
১৯৮৪ সালের ডিসেম্বরে কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আত্মপ্রকাশ করেন আজহারউদ্দিন। অভিষেকেই খেলেন ১১০ রানের অনবদ্য ইনিংস। এর পরের দুটি টেস্টে তিনি আরও দুটি শতক করেন—এই অনন্য কীর্তি আজও টেস্ট ইতিহাসে বিরল। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে তিনটি সেঞ্চুরি করে তিনি ভারতীয় দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নেন।
ব্যাটিং স্টাইল: কব্জির মোচড়ে শিল্পকর্ম
আজহারউদ্দিনের ব্যাটিং স্টাইল ছিল অন্য সবার থেকে আলাদা। বলকে সময় দেওয়া, কব্জির নিখুঁত মোচড়ে লেগ সাইডে শট খেলা, আর কভার ড্রাইভে সৌন্দর্যের ছাপ—এসব তাঁকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা প্রায়ই তাঁকে “Poet of Cricket” বা “Artist with the Bat” বলে অভিহিত করেছেন।

আজহারউদ্দিনের শীর্ষ ১০ ইনিংস: ব্যাটিং প্রতিভার উৎকর্ষ
১. অভিষেক টেস্ট, ১১০ রান (কলকাতা, ১৯৮৪ বনাম ইংল্যান্ড)
অভিষেকেই ইডেন গার্ডেন্সে তিন অঙ্কের ইনিংস। শান্ত ব্যাটিং, টেকনিক্যাল দক্ষতা আর কব্জির ব্যবহার—সব মিলিয়ে এক অনন্য সূচনা।
২. ১০৫ রান (চেন্নাই, ১৯৮৪ বনাম ইংল্যান্ড)
দ্বিতীয় টেস্টেই সেঞ্চুরি। ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে দেন যে তিনি দীর্ঘপথের যাত্রী।
৩. ১২২ রান (কানপুর, ১৯৮৫ বনাম ইংল্যান্ড)
টানা তৃতীয় টেস্টে শতক। রেকর্ড বইয়ে নাম লেখান। প্রথমবারেই নিজের অবস্থান নিশ্চিত করে ফেলেন ভারতীয় দলে।
৪. ১২১ রান (ম্যানচেস্টার, ১৯৯০ বনাম ইংল্যান্ড)
ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ইংল্যান্ডের আক্রমণ সামলাতে গিয়ে ধৈর্য আর কব্জির খেলা দেখান। এই ইনিংস প্রমাণ করে বিদেশের মাটিতেও তিনি সমান কার্যকর।
৫. ১৭৯ রান (এডিলেড, ১৯৯২ বনাম অস্ট্রেলিয়া)
অস্ট্রেলিয়ার শক্তিশালী বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে অনবদ্য ইনিংস। সূক্ষ্ম কভার ড্রাইভ আর ফ্লিক শটে দর্শক মুগ্ধ হন।
৬. ১৮২ রান (ইডেন গার্ডেন্স, ১৯৯৩ বনাম ইংল্যান্ড)
নিজের প্রিয় মাঠে অসাধারণ ব্যাটিং। কব্জির খেলায় অসংখ্য চার। এই ইনিংস আজও ইডেনের দর্শকের কাছে স্মৃতিময়।
৭. ১৫৩ রান (কলকাতা, ১৯৯৬ বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা)
দ্রুতগতির ইনিংস যা ম্যাচের গতি বদলে দেয়। পুরো স্টেডিয়াম তাঁর ব্যাটিং কৌশলে উল্লসিত হয়েছিল।

৮. ৭১ রান (ওডিআই, অকল্যান্ড, ১৯৯৪ বনাম নিউজিল্যান্ড)*
রান তাড়া করতে নেমে তাঁর শান্ত ও ঠান্ডা মাথার ব্যাটিং দলকে জয়ের পথে নিয়ে যায়। অধিনায়ক হিসেবেও তাঁর কৌশল প্রশংসিত হয়।
৯. ৬২ রান (ওডিআই, চেন্নাই, ১৯৯৭ বনাম পাকিস্তান)
পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্রুতগতির ইনিংস। প্রতিপক্ষ বোলারদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করেন এবং ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেন।
১০. ৯৩ রান (ওডিআই, ক্যানবেরা, ১৯৯২ বনাম অস্ট্রেলিয়া)
কঠিন পরিস্থিতিতে ঝড়ো ইনিংস। অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের বিপক্ষে আত্মবিশ্বাসী ব্যাটিং তাঁর সাহসী চরিত্র ফুটিয়ে তোলে।
অধিনায়কত্ব: সাফল্য ও চ্যালেঞ্জের পথচলা
১৯৯০ সালে তিনি ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব পান। প্রায় এক দশক তিনি দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বে ভারত:
- ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে পৌঁছায়।
- ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়া,ইংল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে বড় সিরিজ জয় করে।
- সৌরভ গাঙ্গুলি,রাহুল দ্রাবিড়, অনিল কুম্বলের মতো তরুণদের সুযোগ দেন, যারা পরবর্তীতে ভারতীয় ক্রিকেটের স্তম্ভ হয়ে ওঠেন।
তবে বিদেশের মাটিতে ফলাফল আশানুরূপ না হওয়ায় সমালোচনা হয়েছিল। তবুও তাঁর নেতৃত্ব ছিল শৃঙ্খলাপূর্ণ এবং দলে একতা তৈরি করেছিল।

বিতর্ক ও ক্যারিয়ারের পতন
২০০০ সালে ম্যাচ ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে তাঁর নাম উঠে আসে। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড তাঁকে আজীবন নিষিদ্ধ করে। যদিও ২০১২ সালে আদালত তাঁকে মুক্তি দেয়, ততদিনে তিনি ক্রিকেট থেকে অনেক দূরে। এই অধ্যায় তাঁর উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের বড় কলঙ্ক হয়ে আছে।
ব্যক্তিজীবন: আলো-আঁধারির গল্প
আজহারউদ্দিন প্রথমে নওরিনকে বিয়ে করেন, পরে বলিউড অভিনেত্রী সঙ্গীতা বিজলানির সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান। তাঁর বড় ছেলে আয়াজ এক দুর্ঘটনায় মারা যান, যা তাঁকে গভীরভাবে আঘাত করে। পরবর্তীতে রাজনীতিতে প্রবেশ করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এক অম্লমধুর স্মৃতি
আজহারউদ্দিনের নাম উচ্চারিত হলে একদিকে যেমন মনে পড়ে কব্জির মোচড়ে খেলা অসংখ্য সৌন্দর্যময় শট, তেমনি মনে পড়ে বিতর্কের অন্ধকার অধ্যায়ও। তিনি ভারতীয় ক্রিকেটকে স্টাইল, সৌন্দর্য এবং নেতৃত্ব দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর শিল্পময় ব্যাটিং আজও ক্রিকেট ইতিহাসে এক অনন্য উত্তরাধিকার।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















