০৩:৪৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

আন্তর্জাতিক কথোপকথনের আসর

জাতিসংঘ আজ ট্রিগভে লি-র সময়কার তুলনায় অনেক বড় ও জটিল প্রতিষ্ঠান। ১৯৪৬ সালে প্রথম মহাসচিব হিসেবে লি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখনকার পরিসরে জাতিসংঘের সদস্যসংখ্যা এখন তিনগুণ হয়েছে এবং বাজেটও বহুগুণ বেড়েছে। তত্ত্বগতভাবে এর প্রভাব আরও শক্তিশালী হওয়ার কথা ছিল। শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোসমুদ্র আইন প্রণয়ন কিংবা উপনিবেশমুক্তি প্রচেষ্টায় সহায়তার মাধ্যমে ১৯৪৫ সালে যেখানে ৭৫০ মিলিয়ন মানুষ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিলআজ তা নেমে এসেছে দুই মিলিয়নেরও কমে।

কিন্তু ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি প্রমাণ করেছেক্রমশ বিভক্ত ও মেরুকৃত হয়ে ওঠা বিশ্বে জাতিসংঘের প্রভাব ও প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে গভীর সন্দেহ রয়েছে। আগামী ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘের ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপন হতে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে প্রয়োজন কঠোর আত্মসমালোচনারবিশ্ব শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য কূটনৈতিক ক্ষমতা ও প্রয়োগের উপায় নিয়ে একমাত্র বৈশ্বিক সংস্থা হিসেবে জাতিসংঘ কতটা কার্যকর।

ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শুরু করে গাজাযেখানে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে অনাহার ব্যবহারের” অভিযোগ তুলেছেনসেখানে জাতিসংঘের প্রভাব কার্যত অপ্রতুল। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ঠেকাতে বা তার প্রতিক্রিয়া জানাতে জাতিসংঘ ব্যর্থ হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদ ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন সদস্য রাষ্ট্রবিশেষ করে রাশিয়া ও তার মিত্র চীনের কারণে কার্যত অচল হয়ে গেছে।

গত জুনে রাশিয়ার প্রাণঘাতী হামলায় কিয়েভে বাস্তুচ্যুতির নতুন ঢেউ সৃষ্টি হয়। মাত্র এক সপ্তাহে ৫,০০০ মানুষ এলাকা ছেড়ে পালায়। অথচ জাতিসংঘ মানবিক সহায়তার বাজেট ২.৬৩ বিলিয়ন ডলার থেকে কমিয়ে ১.৭৫ বিলিয়ন ডলার করেযা ৪.৮ মিলিয়ন মানুষকে সহায়তার জন্য নির্ধারিতপ্রাথমিকভাবে ৬ মিলিয়নের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও তা আর সম্ভব হয়নি। ফলে অগণিত দুর্বল মানুষ খাদ্যপানি বা উদ্ধার সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ২০২২ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ রাশিয়ার বিরুদ্ধে চারটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পাস করেপ্রতিটি ক্ষেত্রে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সমর্থন ছিল। এগুলো মানবিক পরিণতি ও জবরদখলের নিন্দা প্রকাশ করলেও কার্যত নিরাপত্তা পরিষদে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।

গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে নিরাপত্তা পরিষদ প্রায় ১৪টি গাজা-সংক্রান্ত প্রস্তাবের ওপর ভোট দেয়কিন্তু মাত্র চারটি গৃহীত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো অধিকাংশ প্রস্তাব আটকে দেয়। বর্তমানে পাঁচ লাখেরও বেশি গাজাবাসী দুর্ভিক্ষে আটকে রয়েছে। জাতিসংঘ নিশ্চিত করেছে সেখানে ভয়াবহ ক্ষুধা ও প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। শিশুরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। শুধু জুলাই ২০২৫-এ ১২,০০০ গুরুতর অপুষ্টির ঘটনা রিপোর্ট হয়যা জানুয়ারির তুলনায় ছয়গুণ বেশি। এর পাশাপাশি জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ-কে বাধা দেওয়া এবং সীমান্তে চলমান অবরোধের কারণে প্রায় ১,৪০০ মানুষ খাদ্যের সন্ধানে মারা গেছে।

ইউক্রেন ও গাজার পরিস্থিতি জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থীযা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মতো দেশগুলোর নেতৃত্বে রচিত হয়েছিল। সেই সনদে বলা হয়েছেনিরাপত্তা পরিষদ অনুমোদন না দিলে বা আত্মরক্ষার যুক্তি না থাকলে বলপ্রয়োগ বৈধ নয়। রাষ্ট্রগুলোকে শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে হবে এবং বৈশ্বিক শান্তির হুমকি ঠেকাতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। ব্যতিক্রমীভাবে ১৯৯০ সালে নিরাপত্তা পরিষদ ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সমর্থন জানায়যখন সাদ্দাম হোসেন কুয়েত আক্রমণ করেছিলেন। তখন মার্কিন নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক জোট তাঁকে পরাজিত করে।

কেবল ইউক্রেন বা গাজা নয়মিয়ানমার ও আফগানিস্তানের মতো আরও কিছু জায়গায় একই ধরনের মানবিক সংকট বিরাজমানযেখানে জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি।

তবু জাতিসংঘের কিছু সংস্থা এখনও গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা প্রদান করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৮৮ সাল থেকে পোলিওর সংখ্যা ৯৯% কমিয়ে এনেছে। ২০২০ সালে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই ও সংঘাতপীড়িত এলাকায় শান্তির পরিবেশ সৃষ্টিতে অবদান রাখার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার পায়। ২০২৪ সালে তারা ১২৪.৪ মিলিয়ন মানুষকে সহায়তা করেছেযদিও এর বাইরেও অনেকে সহায়তার প্রয়োজন ছিল। শান্তিরক্ষী মিশন কিছু ক্ষেত্রে সফল হয়েছেযেমন কম্বোডিয়াএল সালভাদরলাইবেরিয়া ও নামিবিয়ায়। জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় বৈশ্বিক পুনর্বাসন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে২০২৩ সালেই জমা দেওয়া প্রস্তাবে ৩৩% বৃদ্ধি ঘটেছে।

কিন্তু সংস্কারের ডাক ফলপ্রসূ হবে না যদি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পুরনো ক্ষমতার কাঠামোকে না বদলায়। বর্তমানে পাঁচ স্থায়ী সদস্যচীনফ্রান্সরাশিয়াযুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রএখানে প্রভাবশালী। অথচ বিশ্ব গত ৮০ বছরে পাল্টে গেছে। উত্তর গোলার্ধে জার্মানি ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৃহত্তম অর্থনীতিদক্ষিণে ব্রাজিল দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় অর্থনীতি। অথচ তারা সিদ্ধান্তগ্রহণের অভ্যন্তরীণ চক্রে নেই। ভারতের জনসংখ্যা এখন বিশ্বের সর্বাধিককিন্তু তারও কোনো স্থান নেই। ফলাফল হলো অচলাবস্থা। ফলে দেশগুলো বিকল্প জোট যেমন জি২০ ও ব্রিকস-এর দিকে ঝুঁকছে। এরা ক্রমশ শক্তিশালী ও উচ্চকণ্ঠ হচ্ছেযা জাতিসংঘের ভাঙনকে স্পষ্ট করছে।

এছাড়াও জাতিসংঘের ম্যান্ডেট প্রায়ই উপেক্ষিত হয়। যেমন৮০তম সাধারণ পরিষদের আগে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিদের ভিসা দেয়নিযা জাতিসংঘ সদর দপ্তর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে করা চুক্তির পরিপন্থী। ২০১৬ সালে জাতিসংঘ সমুদ্র আইন সম্পর্কিত কনভেনশনের অধীনে একটি ট্রাইব্যুনাল দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের নাইন-ড্যাশ লাইন’ দাবি অবৈধ ঘোষণা করে। ফিলিপাইনের পক্ষে রায় গেলেও চীন তা প্রত্যাখ্যান করে কোনো শাস্তি ভোগ করেনি।

জাতিসংঘকে অবশ্যই এমন ব্যবস্থা করতে হবেযাতে নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের ভেটো ক্ষমতা বিশ্বের বাকি ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের ইচ্ছাকে অমান্য করতে না পারে। বাস্তবে সাধারণ পরিষদে যদি ১৯২-১ ভোটে কোনো প্রস্তাব পাস হয়তবুও সেই একমাত্র ভেটো সেটি কার্যকর হতে দেবে না।

সংস্কার ছাড়া জাতিসংঘ হবে একতরফা ও অকার্যকর। একটি সমাধান হতে পারে সাধারণ পরিষদকে ক্ষমতাবান করাযাতে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য (প্রায় ১২৯টি দেশ) সমর্থন দিলে নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো অগ্রাহ্য করে প্রস্তাব আইনি বাধ্যবাধকতায় পরিণত করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেস প্রেসিডেন্টের ভেটো অতিক্রম করতে পারে যদি দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য সমর্থন দেন। ২০১৬ সালে কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট ওবামার ভেটো অতিক্রম করেছিল। যদিও এই ধরনের প্রস্তাব কার্যকর করা কঠিনযেমন ২০২১ পর্যন্ত ইসরায়েল অন্তত ৫৩টি নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব অমান্য করেছেতবু এই ধরনের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ অচলাবস্থা এড়াতে সহায়ক হবে।

গাজার ক্ষেত্রে সাধারণ পরিষদ ২০২৩ সালের ১২ ডিসেম্বর এবং ২০২৫ সালের ১২ জুন স্থায়ী যুদ্ধবিরতিজিম্মিদের মুক্তি ও মানবিক সহায়তার দাবিতে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় প্রস্তাব গ্রহণ করে। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। একইভাবে ২০২৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সাধারণ পরিষদ ইউক্রেনে স্থায়ী ও ন্যায়সঙ্গত শান্তির পক্ষে প্রস্তাব নেয়যা কার্যত অগ্রসর হয়নি।

ভবিষ্যৎ ইতিহাসবিদরা হয়তো জাতিসংঘের পতনকে অবশ্যম্ভাবী বলেই ধরে নেবেনযেমনটি হয়েছিল লীগ অব নেশন্সের ক্ষেত্রেযারা ১৯৩০-এর দশকে জাপানের মানচুরিয়া আক্রমণ কিংবা ইতালির আবিসিনিয়া আক্রমণ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছিল। তারই ফলশ্রুতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। যদি জাতিসংঘ জরুরি সংস্কার না আনেযেমন নিরাপত্তা পরিষদকে আধুনিক পরাশক্তিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে সম্প্রসারণ এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভোটে ভেটো অগ্রাহ্য করার ব্যবস্থাতাহলে সেটি অচল ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। অনেকের কাছেই জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই এক আন্তর্জাতিক কথোপকথনের আসর” ছাড়া আর কিছু নয়যা প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ।

আন্তর্জাতিক কথোপকথনের আসর

০৮:০৪:২০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

জাতিসংঘ আজ ট্রিগভে লি-র সময়কার তুলনায় অনেক বড় ও জটিল প্রতিষ্ঠান। ১৯৪৬ সালে প্রথম মহাসচিব হিসেবে লি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখনকার পরিসরে জাতিসংঘের সদস্যসংখ্যা এখন তিনগুণ হয়েছে এবং বাজেটও বহুগুণ বেড়েছে। তত্ত্বগতভাবে এর প্রভাব আরও শক্তিশালী হওয়ার কথা ছিল। শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোসমুদ্র আইন প্রণয়ন কিংবা উপনিবেশমুক্তি প্রচেষ্টায় সহায়তার মাধ্যমে ১৯৪৫ সালে যেখানে ৭৫০ মিলিয়ন মানুষ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিলআজ তা নেমে এসেছে দুই মিলিয়নেরও কমে।

কিন্তু ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি প্রমাণ করেছেক্রমশ বিভক্ত ও মেরুকৃত হয়ে ওঠা বিশ্বে জাতিসংঘের প্রভাব ও প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে গভীর সন্দেহ রয়েছে। আগামী ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘের ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপন হতে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে প্রয়োজন কঠোর আত্মসমালোচনারবিশ্ব শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য কূটনৈতিক ক্ষমতা ও প্রয়োগের উপায় নিয়ে একমাত্র বৈশ্বিক সংস্থা হিসেবে জাতিসংঘ কতটা কার্যকর।

ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শুরু করে গাজাযেখানে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে অনাহার ব্যবহারের” অভিযোগ তুলেছেনসেখানে জাতিসংঘের প্রভাব কার্যত অপ্রতুল। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ঠেকাতে বা তার প্রতিক্রিয়া জানাতে জাতিসংঘ ব্যর্থ হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদ ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন সদস্য রাষ্ট্রবিশেষ করে রাশিয়া ও তার মিত্র চীনের কারণে কার্যত অচল হয়ে গেছে।

গত জুনে রাশিয়ার প্রাণঘাতী হামলায় কিয়েভে বাস্তুচ্যুতির নতুন ঢেউ সৃষ্টি হয়। মাত্র এক সপ্তাহে ৫,০০০ মানুষ এলাকা ছেড়ে পালায়। অথচ জাতিসংঘ মানবিক সহায়তার বাজেট ২.৬৩ বিলিয়ন ডলার থেকে কমিয়ে ১.৭৫ বিলিয়ন ডলার করেযা ৪.৮ মিলিয়ন মানুষকে সহায়তার জন্য নির্ধারিতপ্রাথমিকভাবে ৬ মিলিয়নের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও তা আর সম্ভব হয়নি। ফলে অগণিত দুর্বল মানুষ খাদ্যপানি বা উদ্ধার সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ২০২২ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ রাশিয়ার বিরুদ্ধে চারটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পাস করেপ্রতিটি ক্ষেত্রে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সমর্থন ছিল। এগুলো মানবিক পরিণতি ও জবরদখলের নিন্দা প্রকাশ করলেও কার্যত নিরাপত্তা পরিষদে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।

গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে নিরাপত্তা পরিষদ প্রায় ১৪টি গাজা-সংক্রান্ত প্রস্তাবের ওপর ভোট দেয়কিন্তু মাত্র চারটি গৃহীত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো অধিকাংশ প্রস্তাব আটকে দেয়। বর্তমানে পাঁচ লাখেরও বেশি গাজাবাসী দুর্ভিক্ষে আটকে রয়েছে। জাতিসংঘ নিশ্চিত করেছে সেখানে ভয়াবহ ক্ষুধা ও প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। শিশুরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। শুধু জুলাই ২০২৫-এ ১২,০০০ গুরুতর অপুষ্টির ঘটনা রিপোর্ট হয়যা জানুয়ারির তুলনায় ছয়গুণ বেশি। এর পাশাপাশি জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ-কে বাধা দেওয়া এবং সীমান্তে চলমান অবরোধের কারণে প্রায় ১,৪০০ মানুষ খাদ্যের সন্ধানে মারা গেছে।

ইউক্রেন ও গাজার পরিস্থিতি জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থীযা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মতো দেশগুলোর নেতৃত্বে রচিত হয়েছিল। সেই সনদে বলা হয়েছেনিরাপত্তা পরিষদ অনুমোদন না দিলে বা আত্মরক্ষার যুক্তি না থাকলে বলপ্রয়োগ বৈধ নয়। রাষ্ট্রগুলোকে শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে হবে এবং বৈশ্বিক শান্তির হুমকি ঠেকাতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। ব্যতিক্রমীভাবে ১৯৯০ সালে নিরাপত্তা পরিষদ ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সমর্থন জানায়যখন সাদ্দাম হোসেন কুয়েত আক্রমণ করেছিলেন। তখন মার্কিন নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক জোট তাঁকে পরাজিত করে।

কেবল ইউক্রেন বা গাজা নয়মিয়ানমার ও আফগানিস্তানের মতো আরও কিছু জায়গায় একই ধরনের মানবিক সংকট বিরাজমানযেখানে জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি।

তবু জাতিসংঘের কিছু সংস্থা এখনও গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা প্রদান করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৮৮ সাল থেকে পোলিওর সংখ্যা ৯৯% কমিয়ে এনেছে। ২০২০ সালে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই ও সংঘাতপীড়িত এলাকায় শান্তির পরিবেশ সৃষ্টিতে অবদান রাখার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার পায়। ২০২৪ সালে তারা ১২৪.৪ মিলিয়ন মানুষকে সহায়তা করেছেযদিও এর বাইরেও অনেকে সহায়তার প্রয়োজন ছিল। শান্তিরক্ষী মিশন কিছু ক্ষেত্রে সফল হয়েছেযেমন কম্বোডিয়াএল সালভাদরলাইবেরিয়া ও নামিবিয়ায়। জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় বৈশ্বিক পুনর্বাসন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে২০২৩ সালেই জমা দেওয়া প্রস্তাবে ৩৩% বৃদ্ধি ঘটেছে।

কিন্তু সংস্কারের ডাক ফলপ্রসূ হবে না যদি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পুরনো ক্ষমতার কাঠামোকে না বদলায়। বর্তমানে পাঁচ স্থায়ী সদস্যচীনফ্রান্সরাশিয়াযুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রএখানে প্রভাবশালী। অথচ বিশ্ব গত ৮০ বছরে পাল্টে গেছে। উত্তর গোলার্ধে জার্মানি ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৃহত্তম অর্থনীতিদক্ষিণে ব্রাজিল দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় অর্থনীতি। অথচ তারা সিদ্ধান্তগ্রহণের অভ্যন্তরীণ চক্রে নেই। ভারতের জনসংখ্যা এখন বিশ্বের সর্বাধিককিন্তু তারও কোনো স্থান নেই। ফলাফল হলো অচলাবস্থা। ফলে দেশগুলো বিকল্প জোট যেমন জি২০ ও ব্রিকস-এর দিকে ঝুঁকছে। এরা ক্রমশ শক্তিশালী ও উচ্চকণ্ঠ হচ্ছেযা জাতিসংঘের ভাঙনকে স্পষ্ট করছে।

এছাড়াও জাতিসংঘের ম্যান্ডেট প্রায়ই উপেক্ষিত হয়। যেমন৮০তম সাধারণ পরিষদের আগে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিদের ভিসা দেয়নিযা জাতিসংঘ সদর দপ্তর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে করা চুক্তির পরিপন্থী। ২০১৬ সালে জাতিসংঘ সমুদ্র আইন সম্পর্কিত কনভেনশনের অধীনে একটি ট্রাইব্যুনাল দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের নাইন-ড্যাশ লাইন’ দাবি অবৈধ ঘোষণা করে। ফিলিপাইনের পক্ষে রায় গেলেও চীন তা প্রত্যাখ্যান করে কোনো শাস্তি ভোগ করেনি।

জাতিসংঘকে অবশ্যই এমন ব্যবস্থা করতে হবেযাতে নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের ভেটো ক্ষমতা বিশ্বের বাকি ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের ইচ্ছাকে অমান্য করতে না পারে। বাস্তবে সাধারণ পরিষদে যদি ১৯২-১ ভোটে কোনো প্রস্তাব পাস হয়তবুও সেই একমাত্র ভেটো সেটি কার্যকর হতে দেবে না।

সংস্কার ছাড়া জাতিসংঘ হবে একতরফা ও অকার্যকর। একটি সমাধান হতে পারে সাধারণ পরিষদকে ক্ষমতাবান করাযাতে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য (প্রায় ১২৯টি দেশ) সমর্থন দিলে নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো অগ্রাহ্য করে প্রস্তাব আইনি বাধ্যবাধকতায় পরিণত করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেস প্রেসিডেন্টের ভেটো অতিক্রম করতে পারে যদি দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য সমর্থন দেন। ২০১৬ সালে কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট ওবামার ভেটো অতিক্রম করেছিল। যদিও এই ধরনের প্রস্তাব কার্যকর করা কঠিনযেমন ২০২১ পর্যন্ত ইসরায়েল অন্তত ৫৩টি নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব অমান্য করেছেতবু এই ধরনের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ অচলাবস্থা এড়াতে সহায়ক হবে।

গাজার ক্ষেত্রে সাধারণ পরিষদ ২০২৩ সালের ১২ ডিসেম্বর এবং ২০২৫ সালের ১২ জুন স্থায়ী যুদ্ধবিরতিজিম্মিদের মুক্তি ও মানবিক সহায়তার দাবিতে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় প্রস্তাব গ্রহণ করে। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। একইভাবে ২০২৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সাধারণ পরিষদ ইউক্রেনে স্থায়ী ও ন্যায়সঙ্গত শান্তির পক্ষে প্রস্তাব নেয়যা কার্যত অগ্রসর হয়নি।

ভবিষ্যৎ ইতিহাসবিদরা হয়তো জাতিসংঘের পতনকে অবশ্যম্ভাবী বলেই ধরে নেবেনযেমনটি হয়েছিল লীগ অব নেশন্সের ক্ষেত্রেযারা ১৯৩০-এর দশকে জাপানের মানচুরিয়া আক্রমণ কিংবা ইতালির আবিসিনিয়া আক্রমণ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছিল। তারই ফলশ্রুতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। যদি জাতিসংঘ জরুরি সংস্কার না আনেযেমন নিরাপত্তা পরিষদকে আধুনিক পরাশক্তিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে সম্প্রসারণ এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভোটে ভেটো অগ্রাহ্য করার ব্যবস্থাতাহলে সেটি অচল ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। অনেকের কাছেই জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই এক আন্তর্জাতিক কথোপকথনের আসর” ছাড়া আর কিছু নয়যা প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ।