পাকিস্তান-পৃষ্ঠপোষক জঙ্গি সংগঠন যেমন জইশ-ই-মুহাম্মদ (জেইএম) এবং হিজবুল মুজাহিদিন (এইচএম) ভারতীয় বাহিনীর সামরিক অভিযানের পর ঘাঁটি সরাতে শুরু করেছে। ভারতের বিমান ও সেনা বাহিনী ৭ মে ভোরে ‘অপারেশন সিন্দুর’ চালিয়ে পাকিস্তান ও পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে (পিওকে) অন্তত নয়টি জঙ্গি ক্যাম্পে হামলা করে, যাতে ১০০-রও বেশি জঙ্গি নিহত হয়। এর পর থেকেই এসব সংগঠন কৌশলগত কারণে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া (কেপিকে) প্রদেশে স্থানান্তর করছে বলে ভারতীয় গোয়েন্দা সূত্র জানাচ্ছে।
কৌশলগত পরিবর্তন
গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মতে, এ পদক্ষেপ জঙ্গি সংগঠনগুলোর বড় ধরনের কৌশলগত রদবদলের ইঙ্গিত। তারা এখন মনে করছে পিওকে ভারতের নির্ভুল হামলার মুখে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। বিপরীতে কেপিকে ভূগোলগত গভীরতা, আফগান সীমান্তের নিকটবর্তী অবস্থান এবং আফগান যুদ্ধের সময় থেকে চলে আসা জিহাদি আশ্রয়স্থলের কারণে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ।
৭ মে’র হামলা
ভারতীয় বিমানবাহিনী ৭ মে ভোরে বাহাওয়ালপুরের মার্কাজ সুবহান আল্লাহ এবং মুরিদের কাছে মার্কাজ তাইবা নামে দুটি জঙ্গি ক্যাম্পে আঘাত হানে। একই সময়ে সেনাবাহিনী শিয়ালকোটের মেহমূনা জোয়া, মুজাফফরাবাদের সাওয়াই নালা ও সাইয়েদ নাবিলাল, কোটলির গুলপুর ও আব্বাস, ভিম্বারের বারনালা এবং সারজালসহ সাতটি স্থানে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে।
সবচেয়ে দূরের লক্ষ্যবস্তু ছিল মার্কাজ সুবহান আল্লাহ। এটি সীমান্ত থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার ভেতরে অবস্থিত জেইএম-এর সদর দপ্তর, যেখানে জঙ্গি নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও মতাদর্শগত শিক্ষা দেওয়া হতো। অন্যদিকে মার্কাজ তাইবা ছিল হাফিজ সাঈদ পরিচালিত লস্কর-ই-তৈয়বার সদর দপ্তর। এখানেই ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার সঙ্গে জড়িত অনেক জঙ্গিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। আটক হওয়া আজমল কাসাব ও আমেরিকান জঙ্গি ডেভিড হেডলি এখানেই প্রশিক্ষণ নিয়েছিল।
পাকিস্তানি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভূমিকা
জঙ্গিদের এই স্থানান্তর পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সরাসরি সহায়তায় ঘটছে। সূত্রগুলো বলছে, পুলিশের সুরক্ষায় জেইএম খোলামেলা সমাবেশ করছে, পাশাপাশি জামিয়াত উলেমা-ই-ইসলাম (জেইউআই) নামের ধর্মীয়-রাজনৈতিক সংগঠনও এ কাজে ভূমিকা রাখছে।
সামরিক অভিযান ও হামলা
৭ থেকে ১০ মে পর্যন্ত চলা অভিযানে ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের ১৩টি বিমানঘাঁটি ও সামরিক স্থাপনাতেও হামলা চালায়।
কেপিকে-তে নতুন তৎপরতা
একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে কেপিকে-র মানসেহরা জেলার গরী হাবিবুল্লাহ এলাকায়। চলতি এশিয়া কাপ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে, ১৪ সেপ্টেম্বর জেইএম প্রকাশ্যে জনসমাবেশ করে নিয়োগ অভিযান চালায়।
এ সমাবেশকে ‘দেওবন্দি ধর্মীয় সমাবেশ’ হিসেবে সাজানো হলেও বাস্তবে এটি ছিল জঙ্গি সংগঠনের সাংগঠনিক কার্যক্রম। সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন জেইএম-এর খাইবার পাখতুনখোয়া অঞ্চলের আমির মাসুদ ইলিয়াস কাশ্মিরি ওরফে আবু মোহাম্মদ, যিনি ভারতের ওয়ান্টেড তালিকায় আছেন। তিনি জেইএম প্রতিষ্ঠাতা মৌলানা মাসুদ আজহার-এর ঘনিষ্ঠ এবং ‘অপারেশন সিন্দুর’-এর পর সংগঠন পুনর্গঠনে অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব।
নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সম্প্রসারণ
গোয়েন্দা মূল্যায়নে বলা হচ্ছে, এই সমাবেশের আসল লক্ষ্য ছিল মানসেহরার মার্কাজ শোহাদা-ই-ইসলাম নামের জেইএম প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের জন্য নতুন সদস্য সংগ্রহ করা। ‘অপারেশন সিন্দুর’ এর পর থেকে এই ক্যাম্পের সম্প্রসারণ চলছে। সময় ও স্থান নির্বাচনও এমনভাবে করা হয়েছে যাতে ধর্মীয়-রাজনৈতিক সমাবেশের ছদ্মবেশে নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক করে তোলা যায়।
ঝুঁকি বিশ্লেষণ: নতুন সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা
ভারতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তানি জঙ্গি গোষ্ঠীর ঘাঁটি স্থানান্তর ভবিষ্যতে বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি তৈরি করছে। ভারতের অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল প্রতাপ সিং বলেন,
“পিওকে থেকে কেপিকে-তে ঘাঁটি স্থানান্তর মানে হলো জঙ্গিরা এখন আরও সুরক্ষিত জায়গা থেকে তাদের পরিকল্পনা করতে পারবে। এটি ভারতের শহরগুলোতে আরেকটি সমন্বিত হামলার পথ প্রশস্ত করতে পারে।”
দিল্লি-ভিত্তিক সন্ত্রাসবিরোধী বিশ্লেষক নওশাদ খান মনে করেন,
“২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার মতো বড় আকারের সন্ত্রাসী পরিকল্পনা আবারও ঘটতে পারে। কেপিকে অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকা এবং আফগান সীমান্তের নৈকট্য তাদের পালানোর ও পুনর্গঠনের সুযোগ দিচ্ছে।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
আন্তর্জাতিক মহলও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। লন্ডনভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক অ্যালিস জনসন বলেন,
“পাকিস্তান বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরে এখনো জঙ্গিদের প্রতি নরম মনোভাব আছে। এই পরিস্থিতি শুধু ভারতের জন্য নয়, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও বড় হুমকি।”
জাতিসংঘের সন্ত্রাসবিরোধী কমিটির এক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে যে, পাকিস্তানের জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো আফগানিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে সন্ত্রাস রপ্তানি করতে পারে।
জঙ্গি রপ্তানির আশঙ্কা
মার্কিন সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষজ্ঞ রবার্ট মিলার মনে করেন,
“যতক্ষণ পাকিস্তান এই গোষ্ঠীগুলোকে দমন না করে, ততক্ষণ তারা শুধু ভারতেই নয়, তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত দেশগুলোতেও সন্ত্রাসী হামলার নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারে। আফগানিস্তান, কাতার, এমনকি মালয়েশিয়ার মতো দেশেও এই নেটওয়ার্ক বিস্তারের ঝুঁকি রয়েছে।”
বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তানভিত্তিক সংগঠনগুলো আসলে একটি আন্তর্জাতিক জিহাদি করিডর তৈরি করছে, যা ভবিষ্যতে বৈশ্বিক নিরাপত্তাকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে।