আর্থিক বাজারে তরলতার সুনামি এখন এক ধ্বংসাত্মক ঢেউ হয়ে আমাদের সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে। বাজার এই অতিরিক্ত তরলতাকে কোনো অর্থবহ পথে পরিচালিত করছে না। গত কয়েক দিনের তাদের উন্মাদ আচরণেই তা স্পষ্ট।
নিউইয়র্ক থেকে টোকিও পর্যন্ত শেয়ারবাজারগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সামান্য সুদহার কমানোর সিদ্ধান্তের ফলে তরলতা বাড়বে—এই প্রত্যাশায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি বন্ড বাজার সংকেত দিচ্ছে পশ্চাদপসরণের, যা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হতে পারে।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যখন অনুপস্থিত—আবারও যুক্তরাষ্ট্র থেকে জাপান পর্যন্ত, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতির আঘাতে বিঘ্নিত এবং বৈশ্বিক মুদ্রানীতি যখন টালমাটাল, তখনই শুরু হয়েছে এই বাজারের উন্মাদনা।
এটি কোনো ভয় দেখানো নয়; এটি সাধারণ বোধবুদ্ধি, তুলনায় বাজারের অন্ধ দৌড়ঝাঁপের, যেগুলো সর্বোচ্চ মুনাফার খোঁজে ছুটছে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ঝুঁকি উপেক্ষা করে।
শেয়ারবাজার সময় সময় “অযৌক্তিক উচ্ছ্বাসে” আক্রান্ত হয়—যে শব্দবন্ধটি জনপ্রিয় করেছিলেন সাবেক মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ চেয়ারম্যান অ্যালান গ্রিনস্প্যান। ট্রাম্প যখন কিছু শুল্ক সামান্য কমানোর ভান করলেন—যদিও আগের তুলনায় তা এখনো বেশি—তখন থেকেই বাজার অস্বাভাবিক চরম অবস্থায় পৌঁছে গেছে।
মনে হতে পারে বাজারের চাকা আরেকবার ঘুরলেই সত্য প্রকাশ পাবে: “তরলতার ফাঁদ” ক্রমেই দ্রুততর হয়ে ঘুরছে, একদিকে মহামারি-পরবর্তী সহজ ঋণের প্রভাবে, অন্যদিকে পেনশন ফান্ডের মতো সঞ্চয় নিয়মিত শেয়ারবাজারে ঢালার কারণে।
কিন্তু এভাবে দীর্ঘদিন চলতে পারে না। অতিরিক্ত তরলতার ভরসাতেও শেষ পর্যন্ত বাজারকে স্বীকার করতে হয় মৌলিক অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে। আর সেই বাস্তবতাগুলো—সুদের হারের অনিশ্চয়তা থেকে শুরু করে ধীরগতির প্রবৃদ্ধি পর্যন্ত—এই মুহূর্তে বেশ নড়বড়ে।
বন্ডের ফলন বাড়ছে এবং সতর্কবার্তা দিচ্ছে বাজারের শকুনেরা। এর মানে হলো দীর্ঘমেয়াদি বন্ডের দাম পড়ার ঝুঁকিতে আছে—কারণ সরকার ও কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত ঋণ নিচ্ছে। এটি এক বিপদের সংকেত।
সাধারণ মানুষ হয়তো ভাবতে পারেন ফলন বাড়া মানে ভালো—বিনিয়োগকারীরা বেশি রিটার্ন পাচ্ছেন। কিন্তু এর মানে হলো বন্ডধারীদের মূলধনের ক্ষতি, যা বৈশ্বিক বিনিয়োগের জন্য অশুভ লক্ষণ।
শেয়ারমূল্য আকাশছোঁয়া হয়ে বাজারের উন্মাদনাকে প্রকাশ করছে, ওয়াল স্ট্রিটসহ নানা স্থানে সূচক সর্বোচ্চ পর্যায়ে। কিন্তু বন্ডের জগৎ ভিন্ন, যেখানে ফলন বাড়লে দাম পড়ে যায়। তাই সেখানে চিত্র এতটা স্পষ্ট নয়।
প্রায় ১৪৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের স্থির আয়ের সিকিউরিটিজ (বন্ড) বাজার শেয়ারবাজারের তুলনায় অনেক বড়। আকার যত বড়, পতনও তত ভয়াবহ। তাই আমাদের সবারই বন্ড নিয়ে চিন্তিত হওয়া উচিত।
সরকারি বন্ড বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার মেরুদণ্ড। কিন্তু শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, জাপানসহ অনেক দেশই এখন নিজেদের সামর্থ্যের বাইরে খরচ ও ঋণ করছে।
আটলান্টিক কাউন্সিলের জিওইকোনমিক্স সেন্টারের সিনিয়র ফেলো এবং সাবেক আইএমএফ কর্মকর্তা হাং ট্রান সম্প্রতি বলেছেন: “উন্নত দেশের সরকারি বন্ড দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ সম্পদ ও বৃহৎ দীর্ঘমেয়াদি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের (যেমন পেনশন ফান্ড, বীমা কোম্পানি) জন্য ভরসার জায়গা ছিল।”
তিনি আরও সতর্ক করেছেন: “উন্নত দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের জারি করা বন্ডের মান নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে। প্রতিরক্ষা, অবকাঠামো ও অন্যান্য খাতে ব্যয় বাড়ানোর চাপ রয়েছে, অথচ বাজেট ঘাটতি ও সরকারি ঋণ ইতিমধ্যেই বিপজ্জনক স্তরে।”
এখন শুধু সরকার নয়, বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও দিনকে দিন ঋণে জর্জরিত হচ্ছে। বৈশ্বিক করপোরেট ঋণের বাজার জুলাই পর্যন্ত প্রায় ২৫.৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ের তুলনায় ৫.৫ শতাংশ বেশি—এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল রেটিংসের তথ্য অনুযায়ী। এর মধ্যে রয়েছে বিনিয়োগযোগ্য এবং জল্পনাভিত্তিক—উভয় ধরনের ঋণ। আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয় এমন ইস্যুকারীরা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বাড়িয়েছে, যার ফলে উচ্চ সুদের কারণে পুনঃঅর্থায়নের ঝুঁকি এখন করপোরেট ও সরকার উভয়ের জন্য বেড়ে গেছে।
ফলে বন্ডের ফলন বা ঘোষিত সুদের হার (কুপন রেট) বেড়ে ২৫ বছরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে কিছু ক্ষেত্রে। বাজার ক্রমেই এই প্রবণতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হচ্ছে।
জেনা বার্নার্ড, জানুস হেন্ডারসন ইনভেস্টরস-এর বৈশ্বিক বন্ড বিভাগের প্রধান, সম্প্রতি বলেছেন: “ফলন বাড়লে বন্ডের দাম পড়ে যায় এবং বিপরীতও ঘটে। তাই দীর্ঘমেয়াদি বন্ডের সাম্প্রতিক ফলন বৃদ্ধির ফলে ওই খাতে দুর্বলতা (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক রিটার্ন) দেখা দিয়েছে।”
এখনও অনেকে মনে করেন বাজার ভবিষ্যৎ সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রবণতার নির্ভরযোগ্য সূচক। কিন্তু যদি এই চিত্রটি অতিরিক্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হয়, তার কারণ হলো সূচকটি বিকল। বাজারচাপ পরিমাপের যন্ত্রে তরলতার পারদ এতটাই বেড়ে গেছে যে সেটি সঠিক সংকেত দিতে পারছে না। বরং বিনিয়োগকারীদের মানসিকতার স্রোতে তা উপরের দিকে ওঠে যাচ্ছে—যতক্ষণ না একসময় ভেঙে পড়ে। সেই সময় আর দূরে নয়।