ভারতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) বাজার দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে। আমেরিকার বড় প্রযুক্তি কোম্পানি থেকে শুরু করে নতুন স্টার্টআপ পর্যন্ত সবাই ভারতের বিপুল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করতে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ওপেনএআই, মাইক্রোসফট, গুগল, মেটা এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এই বাজারে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে কাজ করছে।
ওপেনএআইয়ের সম্প্রসারণ পরিকল্পনা
ওপেনএআইয়ের সহ-প্রতিষ্ঠাতা স্যাম অল্টম্যান জানিয়েছেন, ভারতে এআই গ্রহণের হার বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় দ্রুত। ওপেনএআই ব্যবহারকারীর সংখ্যায় ভারত বর্তমানে দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার এবং শিগগিরই এটি সবচেয়ে বড় বাজার হতে পারে। আগস্টে ভারতে সাশ্রয়ী মূল্যের চ্যাটজিপিটি চালু করা হয়েছে। বছরের শেষ নাগাদ নয়াদিল্লিতে অফিস খোলার পরিকল্পনা রয়েছে। অল্টম্যান সেপ্টেম্বরে ভারত সফরে যাচ্ছেন এবং ব্লুমবার্গের তথ্য অনুযায়ী, তিনি সফরে একটি বড় ডেটা সেন্টার চালুর ঘোষণা দিতে পারেন।
প্রতিযোগিতায় শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো
ওপেনএআই একা নয়, অন্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানও সমানভাবে সক্রিয়।
- মাইক্রোসফট ঘোষণা করেছে, তারা আগামী কয়েক বছরে ভারতে এআই অবকাঠামোতে ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে।
- গুগল ও মেটা রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের সঙ্গে অংশীদারিত্বে ডেটা সেন্টার গড়ে তুলছে এবং ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে এআই ব্যবহারের প্রসার ঘটাচ্ছে।
- নতুন প্রতিষ্ঠান পারপ্লেক্সিটি এ বছরের জুলাইয়ে এয়ারটেলের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এর ফলে ৩৬০ মিলিয়ন গ্রাহক এক বছরের জন্য বিনামূল্যে তাদের এআই সেবা পাচ্ছেন, যা সাধারণত বছরে ২৪০ ডলার খরচ হতো। চুক্তির পরপরই ভারতে অ্যাপটির ডাউনলোড ৮০০% বেড়ে যায়।
ভারতের বাজার: সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা
ভারতে প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে, যা বিশ্বে অন্যতম বৃহত্তম সংখ্যা। তবে এখান থেকে মুনাফা অর্জন করা সহজ নয়।
- উদাহরণস্বরূপ, নেটফ্লিক্স ভারতে মাসে মাত্র ১.৬৯ ডলার, যেখানে আমেরিকায় এর খরচ ৭.৯৯ ডলার।
- এআই সেবা প্রদানে খরচ আরও বেশি, কারণ প্রতিটি ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তর তৈরিতে বিপুল ডেটা প্রক্রিয়া করতে হয়।
পারপ্লেক্সিটির কর্মকর্তা দিমিত্রি শেভেলেনকো স্বীকার করেছেন, বিনামূল্যে সেবা দেওয়া ব্যয়সাপেক্ষ। তবে তিনি বিশ্বাস করেন, ভারতের ব্যবহারকারীরা অত্যন্ত সক্রিয়, যা ভবিষ্যতে সাবস্ক্রিপশন-ভিত্তিক বাজার গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।
বৈচিত্র্যময় ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা
ভারতের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা নানা ভাষা ও সামাজিক স্তরের মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করে। অনেকে পড়তে বা লিখতে না জানায় কীবোর্ড ব্যবহার না করে কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে এআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ফলে এটি নতুন পণ্য পরীক্ষার জন্য আদর্শ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।
ভারত ইতিমধ্যে “ইন্ডিয়া স্ট্যাক” নামে একটি ডিজিটাল অবকাঠামো তৈরি করেছে, যার মধ্যে রয়েছে বায়োমেট্রিক আইডি ও ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে কোটি কোটি মানুষ প্রথমবারের মতো অনলাইনে যুক্ত হয়েছেন। তাদের তথ্য ও প্রশ্ন এআই মডেলকে আরও কার্যকরভাবে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
নীতিমালা ও ডেটা সুবিধা
ভারতে ডেটা সীমান্ত অতিক্রমে বড় কোনো বাধা নেই। ফলে আমেরিকান কোম্পানিগুলো এখানে সংগৃহীত তথ্য বিদেশে নিয়ে গিয়ে মডেল প্রশিক্ষণে ব্যবহার করতে পারছে। নতুন ডেটার চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে, আর ভারত হয়ে উঠছে সেই চাহিদা মেটানোর অন্যতম প্রধান উৎস।
উদ্বেগ ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
যদিও ভারতীয় ব্যবহারকারীরা বিদেশি এআই প্রতিষ্ঠানকে স্বাগত জানাচ্ছেন, তবুও কিছু উদ্বেগ রয়েছে।
- দেশীয় আইটি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
- দীর্ঘমেয়াদে আমেরিকান প্ল্যাটফর্মের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
- ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের ওপর শুল্ক আরোপ করায় এ উদ্বেগ আরও বেড়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, আমেরিকান কোম্পানিগুলো তাদের শক্তিশালী অর্থ ও অবকাঠামোর কারণে স্থানীয় স্টার্টআপগুলোর অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করতে পারে। যদিও ভারতে বিপুল সংখ্যক ডেভেলপার আছে, এআই গবেষকের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।
স্যাম অল্টম্যান অবশ্য আশাবাদী। তার মতে, ভারত এআই বিপ্লবের অন্যতম নেতৃত্বদানকারী দেশে পরিণত হতে পারে। তবে প্রশ্ন রয়ে যায়— ভারত কি কেবল বিশাল ব্যবহারকারীর কারণে নেতৃত্ব নেবে, নাকি নিজস্ব প্রযুক্তি উন্নয়নের মাধ্যমে সত্যিকারের অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে?