ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফের্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র রবিবার থেকে কম্বোডিয়ায় তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে যাচ্ছেন। এই সফরের মূল উদ্দেশ্য হলো দুই দেশের সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করা এবং সীমান্তপারের অপরাধ দমনসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা। বিশ্লেষকদের মতে, এই সফর দুই দেশের জন্য বাণিজ্য ও সহযোগিতার অপ্রকাশিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর একটি বড় সুযোগ।
সফরের প্রেক্ষাপট
প্রেসিডেন্ট মার্কোস ও তার স্ত্রী লিজা অ্যারানেতা-মার্কোস কম্বোডিয়ার রাজা নোরোদম সিহামোনির আমন্ত্রণে মঙ্গলবার পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করবেন।
এটি ২০১৬ সালের পর থেকে কোনো ফিলিপাইন প্রেসিডেন্টের প্রথম কম্বোডিয়া সফর।
এর আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত ফিলিপাইন সফর করেছিলেন। তখন দুই দেশ বাণিজ্য, কৃষি, শিক্ষা, পর্যটন এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আটটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল।
অপরাধ দমনে যৌথ উদ্যোগ
ফিলিপাইন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র অ্যাঞ্জেলিকা এসকালোনা সফরটিকে “অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ” আখ্যা দিয়েছেন। তিনি জানান, প্রেসিডেন্ট মার্কোস অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের পাশাপাশি মানবপাচার ও আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমনে সহযোগিতা বাড়াতে চান।
আগস্ট মাসে অনলাইন প্রতারণা চক্রের শিকার ২৪ জন ফিলিপিনো কম্বোডিয়া থেকে উদ্ধার হয়ে দেশে ফেরেন। তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া চাকরির বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রলুব্ধ করে কম্বোডিয়ায় নেওয়া হয়েছিল। সেখানে গিয়ে তাদেরকে জোরপূর্বক প্রতারণামূলক কার্যক্রমে যুক্ত করা হয়।
এই সফরে দুই দেশ মানবপাচার ও আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমনের পাশাপাশি উচ্চশিক্ষা ও বিমান যোগাযোগ খাতে চুক্তি স্বাক্ষরের পরিকল্পনা করেছে। এছাড়া, মার্কোস প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত এবং ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করবেন।
হুন সেনের সঙ্গে বৈঠক
মার্কোস ও তার স্ত্রীকে কম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান সিনেট প্রেসিডেন্ট হুন সেন এবং তার স্ত্রী অভ্যর্থনা জানাবেন। মার্কোস ও হুন সেনের বৈঠকে কৃষি, শিক্ষা, পর্যটন খাতের সহযোগিতা এবং অপরাধ দমন বিষয়ে আলোচনা হবে।
সাইবার অপরাধ দমনকেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক আলেকজান্ডার রামোসের মতে, দুই দেশের সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ও যাত্রী সুরক্ষা বাড়ানো জরুরি। তিনি প্রস্তাব দেন, বিমানবন্দরসহ সীমান্তে মানবপাচারবিরোধী ডেস্ক স্থাপন এবং যাত্রী তথ্য নিবন্ধন জোরদার করার।
ব্যবসা ও প্রবাসীদের সঙ্গে বৈঠক
মার্কোস ফিলিপাইন ও কম্বোডিয়ার ব্যবসায়িক নেতাদের সঙ্গে এক গোলটেবিল বৈঠক করবেন। এতে দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়াতে বাজার বৈচিত্র্য এবং সরবরাহ চেইন সম্প্রসারণ নিয়ে আলোচনা হবে।
এছাড়া, তিনি কম্বোডিয়ায় অবস্থানরত প্রায় ৭ হাজার ফিলিপিনো প্রবাসীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবেন, যাদের বেশিরভাগই শিক্ষা ও সেবা খাতে কর্মরত।
কৃষি ও পর্যটনে সম্ভাবনা
বিশ্লেষকদের মতে, কম্বোডিয়া বর্তমানে সরবরাহ চেইন বৈচিত্র্যের একটি সম্ভাবনাময় কেন্দ্র হিসেবে উদিত হচ্ছে। কৃষি, উৎপাদনশীল শিল্প ও ডিজিটাল সেবায় দুই দেশ সহযোগিতা বাড়াতে পারে।
ফিলিপাইনের ইউনিয়নব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ কার্লো আসুনসিওন বলেন, “কম্বোডিয়া কৃষি, উৎপাদন ও পর্যটনে উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা রাখে। ফিলিপাইন তার প্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি দক্ষতা দিয়ে কম্বোডিয়ার আধুনিকায়নে সহায়তা করতে পারে।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, অবকাঠামো ও শিল্পপার্কে বিনিয়োগ, পরিবহন সংযোগ জোরদার এবং কৃষি প্রযুক্তি আদান-প্রদান দুই দেশের জন্য লাভজনক হতে পারে।
রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ মাইকেল রিকাফোর্টের মতে, কৃষি, নিম্ন-দক্ষতা সম্পন্ন শিল্প, পর্যটন ও সেবাখাতে কম্বোডিয়ার উন্নয়ন হলে ফিলিপাইন এর বড় সুবিধা পাবে।
বাণিজ্যে অপূর্ণ সম্ভাবনা
গত বছর ফিলিপাইন ও কম্বোডিয়ার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল মাত্র ১১ কোটি মার্কিন ডলার। বিশ্লেষকদের মতে, এটি উভয় দেশের অপ্রকাশিত ব্যবসায়িক সম্ভাবনার প্রতিফলন।
আসুনসিওনের মতে, দুই দেশের ব্যবসায়ী মহল আগামী কয়েক বছরে বাণিজ্য ৮০০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। কৃষিপণ্য, বিশেষ করে চাল, রাবার ও ক্যাসাভা রপ্তানিতে কম্বোডিয়া এগিয়ে থাকতে পারে। অন্যদিকে ফিলিপাইন কৃষি যন্ত্রপাতি, খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ প্রযুক্তি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সুযোগ পাবে।
পর্যটনে নতুন দিগন্ত
বিশ্লেষকরা মনে করেন, দুই দেশ পর্যটন খাতে যৌথ প্রচারণা চালাতে পারে। ফিলিপাইন সরাসরি ফ্লাইট বাড়ালে এবং যৌথভাবে বিপণন কার্যক্রম চালালে কম্বোডিয়া থেকে বেশি পর্যটক আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে।
আসুনসিওন বলেন, “কম্বোডিয়ার দ্রুত বেড়ে ওঠা আউটবাউন্ড পর্যটন বাজার থেকে ফিলিপাইন উপকৃত হতে পারে। বিশেষ করে সৈকতভিত্তিক পর্যটন, ইংরেজি ভাষা শিক্ষা এবং পরিবেশভিত্তিক পর্যটনে নতুন সুযোগ তৈরি হতে পারে।”
মার্কোসের এ সফর শুধু দুই দেশের সম্পর্ক জোরদার করবে না, বরং কৃষি, বাণিজ্য, পর্যটন ও নিরাপত্তা খাতে পারস্পরিক সহযোগিতার নতুন সম্ভাবনাও তৈরি করবে। বিশ্লেষকদের মতে, এই উদ্যোগ ফিলিপাইন ও কম্বোডিয়াকে আসিয়ানের অভ্যন্তরে আরও প্রতিযোগিতামূলক এবং টেকসই করে তুলবে।