১০:২৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ: ট্রাম্পের সৃষ্ট শূন্যতায় কি নেতৃত্বের আসনে উঠবে চীন?

জাতিসংঘের ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বিশ্বনেতারা যখন নিউইয়র্কে সমবেত হচ্ছেন, তখন ট্রাফিক জট, স্থানীয় বাসিন্দাদের বিরক্তি, আর ভিন্নধর্মী বার্তায় ভরে উঠছে আন্তর্জাতিক মঞ্চ। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের অবস্থান, জাতিসংঘ সংস্কারের অনিশ্চয়তা এবং প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা প্রশ্ন ঘিরে ফেলেছে এ আয়োজনকে।

ট্রাম্পের নীতির প্রভাব

ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি, বৈশ্বিক রীতি ভাঙা সিদ্ধান্ত ও জাতিসংঘ থেকে সরে আসার ধারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অস্থিরতা তৈরি করেছে। তবুও চীন সরাসরি নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করেনি। বরং তারা নিজেদের স্থিতিশীল ও ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছে।

বিশ্লেষক জেরেমি চ্যান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র যখন নিজেই পিছিয়ে যাচ্ছে, তখন চীন কিছু না করেই প্রভাব বাড়াচ্ছে।”

ট্রাম্পের প্রত্যাশিত বক্তব্য

বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প তার বক্তব্যে ইরান, ইসরায়েল ও গাজা ইস্যুতে অবস্থান জানাবেন, জাতিসংঘের বৈচিত্র্য ও সমতার নীতি আক্রমণ করবেন এবং নিজেকে শান্তির দূত হিসেবে তুলে ধরবেন। তিনি দাবি করেছেন, “আমি সাতটি বড় যুদ্ধ বন্ধ করেছি।”

অন্যদিকে, বহুপাক্ষিক কাঠামোর সমালোচক হলেও ট্রাম্প জাতিসংঘকে তুলনামূলক ইতিবাচকভাবে দেখেছেন। প্রথম প্রেসিডেন্সিতে তিনি প্রতি বছর সাধারণ পরিষদে বক্তৃতা দিয়েছেন এবং সেখানে চীনকে মহামারির জন্য দায়ী করেছেন, বৈশ্বিকতাবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং উত্তর কোরিয়ার নেতাকে “রকেট ম্যান” বলে আখ্যায়িত করেছেন।

চীনের অবস্থান

চীনের প্রধানমন্ত্রী লি চিয়াং এই অধিবেশনে অংশ নিচ্ছেন। তার বক্তব্যে আগের মতোই বহুপাক্ষিকতার গুরুত্ব, ঐকমত্য, বৈশ্বিক দক্ষিণের ক্ষমতায়ন এবং জাতিসংঘ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা আসবে। এছাড়া চীনের “উইন-উইন” ধারণার ওপরও জোর দেওয়া হবে।

বিশ্লেষক ইরিনা সুকারম্যান বলেন, “চীনের বার্তা অপরিবর্তিত থাকবে, কারণ এই কৌশল তাদের জন্য কার্যকর।”

অর্থনৈতিক সংকট ও তহবিল সংকট

ট্রাম্প প্রশাসন জাতিসংঘের বাজেটে বড় কাটছাঁট করেছে। শান্তিরক্ষা ও অন্যান্য খাতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা নাটকীয়ভাবে কমানো হয়েছে। ফলে জাতিসংঘ অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে।

চীনও তহবিলে দেরিতে অর্থ প্রদান করে সমস্যার অংশীদার হয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ২২ শতাংশ ও চীন ২০ শতাংশ বাজেট বহন করে। তবে চীন মানবিক কর্মসূচির বদলে প্রযুক্তি, উন্নয়ন ও শান্তিরক্ষা মিশনে বিনিয়োগ করতে বেশি আগ্রহী।

চীন যদিও মে মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় পাঁচ বছরে ৫০০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তবুও জাতিসংঘের আর্থিক শূন্যতা পূরণে তারা সক্রিয় ভূমিকা নেয়নি।

চীনের কৌশলগত সুবিধা

জাতিসংঘে চীনের ভেটো ক্ষমতা, রাশিয়ার সমর্থন এবং প্রায় ৯০টি উন্নয়নশীল দেশের সমর্থন তাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করছে। এটি বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের মাধ্যমে আরও বিস্তৃত হয়েছে।

জাতিসংঘ চীনকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও প্রযুক্তিগত মান নির্ধারণে বৈশ্বিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগও দিচ্ছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র সরে গেলে চীন তেমন কিছু না করেই প্রভাব বাড়াতে পারছে।

নেতৃত্ব ও প্রভাব বিস্তার

বিশ্লেষকদের মতে, চীনের আরও বেশি প্রার্থী জাতিসংঘের উচ্চপদে জায়গা পাবে। শান্তিরক্ষা বিভাগের নেতৃত্ব, যা আগে ফ্রান্সের হাতে ছিল, সেটিও চীনের হাতে যেতে পারে।

এতে চীন বৈশ্বিক দক্ষিণের নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে, বিশেষ করে গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থন পেয়েছে।

সতর্ক কৌশল

তবে চীন অতিরিক্ত আক্রমণাত্মকভাবে জাতিসংঘে নেতৃত্ব নিতে চাইছে না। ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যখন ডাভোসে বৈশ্বিকতাবাদের রক্ষক হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন, এখন তারা অনেকটা সংযত অবস্থানে আছেন।

একদিকে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া ঘনিষ্ঠতা চীনকে কিছুটা সতর্ক করেছে, অন্যদিকে ট্রাম্প-শি সম্ভাব্য বৈঠকের আগে যুক্তরাষ্ট্রকে বিরক্ত না করার চেষ্টা চলছে।

জাতিসংঘ সংস্কার সংকট

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ কেটে দেওয়া জাতিসংঘে অস্তিত্ব সংকট তৈরি করেছে। নিরাপত্তা পরিষদ জলবায়ু পরিবর্তন, রোগব্যাধি ও সংঘাত সমাধানে ব্যর্থ হওয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে।

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ব্যয় ২০ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন এবং ৪০ হাজার ম্যান্ডেট পর্যালোচনা শুরু করেছেন। কিছু সংস্থা নিউইয়র্ক ও জেনেভার বদলে কম খরচের শহরে স্থানান্তরের কথাও ভাবছে।

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ

চীন ও যুক্তরাষ্ট্র সংস্কারে একমত হতে পারে, তবে ১৯১টি দেশের স্বার্থ মেলানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্লেষকদের মতে, চীন সম্পূর্ণ জাতিসংঘকে নিজেদের পক্ষে বদলাতে না পারলেও ব্লকভিত্তিক প্রভাব বিস্তারে সফল হবে।

জাতিসংঘের সংকট অনেকের কাছে পরিবর্তনের সুযোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার জাতিসংঘ থেকে সরে আসা যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব স্থায়ীভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। বিশ্লেষক মার্ক লিমন বলেন, “চীন তাদের কৌশল চালিয়ে যাবে; বাস্তবে তারা জয়ী হয়ে গেছে।”

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের ইতিহাস ও নেতৃত্ব নিয়ে নতুন গ্রন্থ

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ: ট্রাম্পের সৃষ্ট শূন্যতায় কি নেতৃত্বের আসনে উঠবে চীন?

০৬:০০:৫০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

জাতিসংঘের ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বিশ্বনেতারা যখন নিউইয়র্কে সমবেত হচ্ছেন, তখন ট্রাফিক জট, স্থানীয় বাসিন্দাদের বিরক্তি, আর ভিন্নধর্মী বার্তায় ভরে উঠছে আন্তর্জাতিক মঞ্চ। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের অবস্থান, জাতিসংঘ সংস্কারের অনিশ্চয়তা এবং প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা প্রশ্ন ঘিরে ফেলেছে এ আয়োজনকে।

ট্রাম্পের নীতির প্রভাব

ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি, বৈশ্বিক রীতি ভাঙা সিদ্ধান্ত ও জাতিসংঘ থেকে সরে আসার ধারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অস্থিরতা তৈরি করেছে। তবুও চীন সরাসরি নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করেনি। বরং তারা নিজেদের স্থিতিশীল ও ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছে।

বিশ্লেষক জেরেমি চ্যান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র যখন নিজেই পিছিয়ে যাচ্ছে, তখন চীন কিছু না করেই প্রভাব বাড়াচ্ছে।”

ট্রাম্পের প্রত্যাশিত বক্তব্য

বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প তার বক্তব্যে ইরান, ইসরায়েল ও গাজা ইস্যুতে অবস্থান জানাবেন, জাতিসংঘের বৈচিত্র্য ও সমতার নীতি আক্রমণ করবেন এবং নিজেকে শান্তির দূত হিসেবে তুলে ধরবেন। তিনি দাবি করেছেন, “আমি সাতটি বড় যুদ্ধ বন্ধ করেছি।”

অন্যদিকে, বহুপাক্ষিক কাঠামোর সমালোচক হলেও ট্রাম্প জাতিসংঘকে তুলনামূলক ইতিবাচকভাবে দেখেছেন। প্রথম প্রেসিডেন্সিতে তিনি প্রতি বছর সাধারণ পরিষদে বক্তৃতা দিয়েছেন এবং সেখানে চীনকে মহামারির জন্য দায়ী করেছেন, বৈশ্বিকতাবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং উত্তর কোরিয়ার নেতাকে “রকেট ম্যান” বলে আখ্যায়িত করেছেন।

চীনের অবস্থান

চীনের প্রধানমন্ত্রী লি চিয়াং এই অধিবেশনে অংশ নিচ্ছেন। তার বক্তব্যে আগের মতোই বহুপাক্ষিকতার গুরুত্ব, ঐকমত্য, বৈশ্বিক দক্ষিণের ক্ষমতায়ন এবং জাতিসংঘ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা আসবে। এছাড়া চীনের “উইন-উইন” ধারণার ওপরও জোর দেওয়া হবে।

বিশ্লেষক ইরিনা সুকারম্যান বলেন, “চীনের বার্তা অপরিবর্তিত থাকবে, কারণ এই কৌশল তাদের জন্য কার্যকর।”

অর্থনৈতিক সংকট ও তহবিল সংকট

ট্রাম্প প্রশাসন জাতিসংঘের বাজেটে বড় কাটছাঁট করেছে। শান্তিরক্ষা ও অন্যান্য খাতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা নাটকীয়ভাবে কমানো হয়েছে। ফলে জাতিসংঘ অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে।

চীনও তহবিলে দেরিতে অর্থ প্রদান করে সমস্যার অংশীদার হয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ২২ শতাংশ ও চীন ২০ শতাংশ বাজেট বহন করে। তবে চীন মানবিক কর্মসূচির বদলে প্রযুক্তি, উন্নয়ন ও শান্তিরক্ষা মিশনে বিনিয়োগ করতে বেশি আগ্রহী।

চীন যদিও মে মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় পাঁচ বছরে ৫০০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তবুও জাতিসংঘের আর্থিক শূন্যতা পূরণে তারা সক্রিয় ভূমিকা নেয়নি।

চীনের কৌশলগত সুবিধা

জাতিসংঘে চীনের ভেটো ক্ষমতা, রাশিয়ার সমর্থন এবং প্রায় ৯০টি উন্নয়নশীল দেশের সমর্থন তাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করছে। এটি বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের মাধ্যমে আরও বিস্তৃত হয়েছে।

জাতিসংঘ চীনকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও প্রযুক্তিগত মান নির্ধারণে বৈশ্বিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগও দিচ্ছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র সরে গেলে চীন তেমন কিছু না করেই প্রভাব বাড়াতে পারছে।

নেতৃত্ব ও প্রভাব বিস্তার

বিশ্লেষকদের মতে, চীনের আরও বেশি প্রার্থী জাতিসংঘের উচ্চপদে জায়গা পাবে। শান্তিরক্ষা বিভাগের নেতৃত্ব, যা আগে ফ্রান্সের হাতে ছিল, সেটিও চীনের হাতে যেতে পারে।

এতে চীন বৈশ্বিক দক্ষিণের নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে, বিশেষ করে গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থন পেয়েছে।

সতর্ক কৌশল

তবে চীন অতিরিক্ত আক্রমণাত্মকভাবে জাতিসংঘে নেতৃত্ব নিতে চাইছে না। ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যখন ডাভোসে বৈশ্বিকতাবাদের রক্ষক হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন, এখন তারা অনেকটা সংযত অবস্থানে আছেন।

একদিকে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া ঘনিষ্ঠতা চীনকে কিছুটা সতর্ক করেছে, অন্যদিকে ট্রাম্প-শি সম্ভাব্য বৈঠকের আগে যুক্তরাষ্ট্রকে বিরক্ত না করার চেষ্টা চলছে।

জাতিসংঘ সংস্কার সংকট

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ কেটে দেওয়া জাতিসংঘে অস্তিত্ব সংকট তৈরি করেছে। নিরাপত্তা পরিষদ জলবায়ু পরিবর্তন, রোগব্যাধি ও সংঘাত সমাধানে ব্যর্থ হওয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে।

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ব্যয় ২০ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন এবং ৪০ হাজার ম্যান্ডেট পর্যালোচনা শুরু করেছেন। কিছু সংস্থা নিউইয়র্ক ও জেনেভার বদলে কম খরচের শহরে স্থানান্তরের কথাও ভাবছে।

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ

চীন ও যুক্তরাষ্ট্র সংস্কারে একমত হতে পারে, তবে ১৯১টি দেশের স্বার্থ মেলানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্লেষকদের মতে, চীন সম্পূর্ণ জাতিসংঘকে নিজেদের পক্ষে বদলাতে না পারলেও ব্লকভিত্তিক প্রভাব বিস্তারে সফল হবে।

জাতিসংঘের সংকট অনেকের কাছে পরিবর্তনের সুযোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার জাতিসংঘ থেকে সরে আসা যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব স্থায়ীভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। বিশ্লেষক মার্ক লিমন বলেন, “চীন তাদের কৌশল চালিয়ে যাবে; বাস্তবে তারা জয়ী হয়ে গেছে।”