ফ্রান্সের ঐতিহাসিক ঘোষণা
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ঘোষণা করেছেন যে ফ্রান্স এখন আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তিনি বলেন, “শান্তির সময় এসেছে” এবং গাজায় চলমান যুদ্ধকে কোনো কিছুতেই ন্যায্যতা দেওয়া যায় না।
এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে ফ্রান্স বিশ্বের সেই দেশগুলোর কাতারে যোগ দিল, যারা সাম্প্রতিক সময়ে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।
দুই রাষ্ট্র সমাধানের উদ্যোগ
জাতিসংঘে ফ্রান্স ও সৌদি আরব যৌথভাবে একদিনের সম্মেলনের আয়োজন করেছে, যেখানে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পরিকল্পনা কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল। তবে জি-৭ দেশগুলোর মধ্যে জার্মানি, ইতালি এবং যুক্তরাষ্ট্র এতে অংশ নেয়নি।
ইতোমধ্যেই যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও পর্তুগাল ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। অচিরেই বেলজিয়াম, লুক্সেমবুর্গ, মাল্টা, আন্ডোরা ও সান মারিনো একই ঘোষণা দিতে চলেছে।
আন্তর্জাতিক চাপ ও ইসরায়েলের অবস্থান
গাজায় মানবিক সংকট এবং পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন নিয়ে ইসরায়েলের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ ক্রমশ বাড়ছে। তবে ইসরায়েলের বক্তব্য, এই স্বীকৃতি দেওয়া মানে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলার জন্য হামাসকে পুরস্কৃত করা, যে হামলায় প্রায় ১,২০০ ইসরায়েলি নিহত ও ২৫১ জন জিম্মি হয়েছিল।
গাজার হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি অনুযায়ী, এরপর থেকে ইসরায়েলি হামলায় ইতোমধ্যেই ৬৫-হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। ইসরায়েলি সেনারা বর্তমানে গাজা সিটিতে স্থল অভিযান চালাচ্ছে, যেখানে আগে প্রায় ১০ লাখ মানুষ বসবাস করত এবং সম্প্রতি সেখানে দুর্ভিক্ষেরও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
ম্যাক্রোঁর বার্তা
প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ সম্মেলনে বলেন, যুদ্ধ থামাতে হবে এবং হামাসের হাতে আটক ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্ত করতে হবে। তিনি সতর্ক করেন, ‘অবিরাম যুদ্ধের বিপদ’ থেকে বের হয়ে আসতে হবে এবং জোর দিয়ে বলেন, ন্যায় সর্বদা শক্তির ওপরে জয়ী হওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখনো মধ্যপ্রাচ্যে একটি ন্যায়সংগত ও স্থায়ী শান্তি গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। এজন্য এখনই সব শক্তি প্রয়োগ করতে হবে, যাতে দুই রাষ্ট্র সমাধান বাস্তবায়নের সম্ভাবনা অক্ষুণ্ণ থাকে।
সৌদি আরব, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের অবস্থান
সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান আল সৌদও জাতিসংঘে বক্তব্য দেন এবং পুনর্ব্যক্ত করেন যে স্থায়ী শান্তির একমাত্র পথ হলো দুই রাষ্ট্র সমাধান।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেয়েন জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন গাজা পুনর্গঠনের জন্য নতুন আর্থিক কাঠামো তৈরি করবে এবং “প্যালেস্টাইন ডোনার গ্রুপ” গঠন করা হবে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস পরিস্থিতিকে “নৈতিক, আইনি ও রাজনৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য” আখ্যা দিয়ে বলেন, দুই রাষ্ট্র সমাধানই একমাত্র গ্রহণযোগ্য পথ।
মাহমুদ আব্বাসের ভিডিও বার্তা
ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বাতিল করায় জাতিসংঘের অধিবেশনে উপস্থিত থাকতে পারেননি। তিনি ভিডিও বার্তায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান এবং স্পষ্ট করে বলেন, গাজা শাসনে হামাসের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না। তিনি হামাসকে অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানান।
আব্বাস আরও বলেন, “আমরা একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র চাই, যেখানে অস্ত্র থাকবে না।” একইসঙ্গে তিনি ৭ অক্টোবরের হামলার নিন্দা জানান এবং ইসরায়েলিদের উদ্দেশে বলেন, “আমাদের ভবিষ্যৎ ও আপনাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে শান্তির ওপর। যথেষ্ট রক্তপাত ও যুদ্ধ হয়েছে।”
ফ্রান্সের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ম্যাক্রোঁ বলেন, ফ্রান্স গাজায় “স্থিতিশীলতা মিশন”-এ অংশ নিতে প্রস্তুত এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী প্রশাসন গঠনের আহ্বান জানান, যা হামাসকে রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় করবে।
তবে তিনি শর্ত দিয়ে বলেন, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রে ফ্রান্স তখনই দূতাবাস খুলবে, যখন সব জিম্মি মুক্তি পাবে এবং যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হবে।
ইসরায়েলের কঠোর প্রতিক্রিয়া
ফ্রান্সের ঘোষণার কিছুক্ষণ আগে জাতিসংঘে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন বলেন, ৭ অক্টোবরের ঘটনার পর দুই রাষ্ট্র সমাধান আর কোনো আলোচনার বিষয় নয়। তিনি জাতিসংঘের বৈঠককে “প্রহসন” আখ্যা দেন।
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বহুবার বলেছেন, জর্ডান নদীর পশ্চিমে কোনো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নই আসে না। প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হার্জগ বলেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া মানে হবে “অন্ধকার শক্তিকে উৎসাহিত করা”।
ইউরোপে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া
প্যারিসের আইফেল টাওয়ারে রবিবার রাতে ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি পতাকা প্রদর্শন করা হয়। ফ্রান্সের অনেক পৌরসভাও সোমবার ফিলিস্তিনি পতাকা উত্তোলন করেছে, যদিও সরকার স্থানীয় প্রশাসনকে নিরপেক্ষ থাকতে নির্দেশ দিয়েছিল।
ইতালির ৮০টি শহর ও নগরে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভ হয়েছে। ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি সম্প্রতি বলেছেন, অস্তিত্বহীন একটি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া “বিপরীত ফল” বয়ে আনতে পারে।
অন্যদিকে জার্মানি জানিয়েছে, এখনই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র স্বীকৃতির সময় নয়। তবে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোহান ভাডেফুল বলেছেন, “জার্মানির কাছে স্বীকৃতি প্রক্রিয়ার শেষ ধাপে আসবে। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া শুরু হওয়া জরুরি।”
এই স্বীকৃতির মাধ্যমে ফ্রান্স মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিনের জটিল সংকটে নতুন মাত্রা যোগ করেছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর চাপ আরও বাড়িয়েছে, যাতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দুই রাষ্ট্র সমাধানের বাস্তবায়ন এগিয়ে যায়।