পশ্চিম তীর ও দুই রাষ্ট্র সমাধান
ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরে ২৭ লাখ ফিলিস্তিনি বাস করে। বহু দশক ধরে এ অঞ্চলটি ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে, যা ইসরায়েলের পাশাপাশি বিদ্যমান থাকবে। এ মডেলটিই দুই রাষ্ট্র সমাধান নামে পরিচিত, যা বিশ্বের অধিকাংশ দেশ সমর্থন করে।
কিন্তু পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপন ক্রমে ফিলিস্তিনিদের জমি সংকুচিত করেছে। শহর ও গ্রামগুলো একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। বর্তমান ডানপন্থী সরকার বসতি স্থাপন দ্রুততর করেছে, যেখানে প্রভাবশালী প্রো-সেটলার দলগুলো পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলের সঙ্গে একীভূত করতে চায়।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বনাম ইসরায়েলি নীতি
সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, কানাডা ও পর্তুগাল ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশের অধিকাংশ আগেই স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় মিত্র যুক্তরাষ্ট্র এ পরিবর্তনের সমালোচনা করেছে। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র ইসরায়েলের জন্য নিরাপত্তা হুমকি।
ফিলিস্তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারসেন আগাবেকিয়ান শাহিন বলেছেন, এ স্বীকৃতি ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে আরও কাছে নিয়ে এসেছে। তবে শুধু স্বীকৃতি যথেষ্ট নয়; বাস্তবে বসতি স্থাপন ও দখলদার নীতি দুই রাষ্ট্র সমাধানকে প্রায় অসম্ভব করে তুলছে।
বসতি সম্প্রসারণ ও বিভক্ত পশ্চিম তীর
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে পশ্চিম তীর দখল করার পর থেকে ইসরায়েল বসতি স্থাপন করে আসছে। নতুন সড়ক ও অবকাঠামো বসতি সম্প্রসারণকে গভীরে নিয়ে গেছে, ফলে ভূমি আরও খণ্ডিত হচ্ছে।
ইসরায়েল ইতোমধ্যে জেরুজালেমকে নিজের অবিভক্ত রাজধানী ঘোষণা করেছে, যদিও আন্তর্জাতিকভাবে তা স্বীকৃত নয়। ফিলিস্তিনিরা রাজধানী হিসেবে পূর্ব জেরুজালেমকেই দাবি করে।
এদিকে, ইসরায়েলি সরকারের অনুমোদিত নতুন বসতি প্রকল্প “ই-ওয়ান” (E1) পশ্চিম তীরকে কার্যত দুই ভাগে কেটে ফেলবে এবং পূর্ব জেরুজালেম থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। এতে ২,৫০০ বেদুইন পরিবার বাস্তুচ্যুত হবে বলে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ জানায়।
মানুষের জীবনে প্রভাব
পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের জীবনে বসতির প্রভাব সরাসরি। উদাহরণস্বরূপ, আইন ইয়াবরুদ গ্রামের বাসিন্দা তারেক শিহাদে স্মৃতিচারণ করেন কিভাবে আগে তারা জমিতে জলপাই ফলাতেন ও পশুপালন করতেন। এখন তার নাতি সেই জমিতে যেতে পারে না, কারণ সশস্ত্র বসতিদের বাধা দেয় এবং হামলার আশঙ্কা থাকে।
মানবাধিকার সংস্থা বেতসেলেম জানিয়েছে, বসতকারীরা প্রায়ই কৃষকদের ওপর হামলা চালায়। অনেক বসতি এমন জমিতে তৈরি হয়েছে, যা আইনি নথিতে ফিলিস্তিনিদের নামে নিবন্ধিত।
ইতিহাস ও বর্তমান বাস্তবতা
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের পরিকল্পনা অনুযায়ী ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ফিলিস্তিনিদের জন্যও একটি রাষ্ট্র নির্ধারিত ছিল, কিন্তু আরব দেশগুলো তা প্রত্যাখ্যান করে যুদ্ধ শুরু করে। ইসরায়েল বিজয়ী হয়ে পূর্বনির্ধারিত সীমার বাইরে ৭৮% জমির নিয়ন্ত্রণ নেয়। বাকি ২২% জমিই পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুজালেমে সীমাবদ্ধ, যেখানে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণা টিকে আছে।
১৯৬৭ সালের পর থেকে বসতি স্থাপন বাড়তে থাকে। বর্তমানে পশ্চিম তীরে প্রায় ৫ লাখ ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী রয়েছে। তারা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সুরক্ষা ও আলাদা সড়ক নেটওয়ার্কের সুবিধা পায়, যা ফিলিস্তিনিদের জন্য প্রায় বন্ধ।
ওসলো চুক্তি ও ব্যর্থ শান্তি প্রক্রিয়া
১৯৯৩ সালের ওসলো চুক্তিতে পশ্চিম তীরকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়:
- এলাকা এ: ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ
- এলাকা বি: যৌথ নিয়ন্ত্রণ
- এলাকা সি: ইসরায়েলি সামরিক নিয়ন্ত্রণ
চুক্তি অনুযায়ী এলাকা সি-এর দখল অস্থায়ী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শান্তি প্রক্রিয়া ভেঙে পড়ায় এটি স্থায়ী হয়ে গেছে। এ অঞ্চলটি পশ্চিম তীরের ৬০% জমি নিয়ে গঠিত, যা মূলত কৃষিজমি। ফিলিস্তিনিরা এখানে কোনো কিছু নির্মাণ করতে গেলে প্রায় সব আবেদনই ইসরায়েল প্রত্যাখ্যান করে।
চেকপয়েন্ট, দেয়াল ও বৈষম্য
পশ্চিম তীর জুড়ে চেকপয়েন্ট, সামরিক বাধা ও সড়কগুলো ফিলিস্তিনিদের চলাচল সীমিত করে। ২০২৫ সালের শুরুতে জাতিসংঘ জানিয়েছে, পশ্চিম তীরে অন্তত ৮৫০টি চলাচল প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।
ইসরায়েল ২০০০-২০০৫ সালে নিরাপত্তা প্রাচীর নির্মাণ শুরু করে, যা অনেক জায়গায় পশ্চিম তীরের ভেতরে ঢুকে গেছে। এতে বসতিগুলো কার্যত ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত হলেও বহু ফিলিস্তিনি গ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
পানি ও সম্পদে বৈষম্য
ইসরায়েলি বসতিগুলো পর্যাপ্ত পানি ও অবকাঠামো সুবিধা পায়, কিন্তু পাশের ফিলিস্তিনি গ্রামগুলো ভয়াবহ সংকটে থাকে। কৃষি ও অর্থনীতিও এ বৈষম্যের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত।
সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন
অক্টোবর ২০২৩-এ হামাসের হামলার পর থেকে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি অভিযান ও বসতি স্থাপনকারীদের হামলা বেড়ে গেছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, অবৈধ হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতার মাত্রা তীব্রভাবে বেড়েছে।
শরণার্থী শিবিরগুলোতেও সামরিক অভিযান চালানো হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ আবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
আন্তর্জাতিকভাবে দুই রাষ্ট্র সমাধানই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পথ। কিন্তু পশ্চিম তীরে দ্রুত বসতি সম্প্রসারণ, চেকপয়েন্ট, দেয়াল ও ভূমি দখলের নীতি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে ক্রমে অবাস্তব করে তুলছে।
তবুও ফিলিস্তিনিদের কাছে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন অটুট, আর বিশ্ব সম্প্রদায়ের বড় অংশ এ সমাধানকেই সমর্থন করে। তবে ইসরায়েলের ভেতরে বসতি স্থাপনকারীদের শক্তিশালী প্রভাব এবং সরকারের নীতি এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।