নিজের মন্তব্যের কারণে আবারও আলোচনায় এসেছেন রাজনীতিবিদ ফজলুর রহমান। বিভিন্ন সময় তার মন্তব্য ঘিরে বিতর্ক ও নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নিয়ে মন্তব্য করে আবার আলোচনায় এসেছেন এই রাজনীতিক।
এবার মি. রহমানের মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্বাচিত কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু। জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত ইসলামী ছাত্রশিবির এসেছে ডাকসুর নেতৃত্বে।
এর আগে, জুলাই গণ অভ্যুত্থান নিয়ে মন্তব্য করে গত অগাস্ট মাসে নানা আলোচনার মুখে বিএনপিতে তার প্রথমিক সদস্যপদসহ সব ধরনের পদ তিন মাসের জন্য সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। ফজলুর রহমান ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য।
মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, রাজাকার, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির নিয়ে মি. রহমানের বেশ কিছু বক্তব্যের ভিডিও গত কয়েক মাসে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করে।
একদিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সমালোচনা, অন্যদিকে নিজের দলে পদ-পদবী সাময়িকভাবে স্থগিত রয়েছে ফজলুর রহমানের।
এরই মধ্যে দুদিন আগে কিশোরগঞ্জে বিএনপির অনুষ্ঠান বা কর্মসূচিতেও ডাকা হয়নি মি. রহমানকে। বিএনপিতে সদস্যপদ স্থগিত থাকায় এ মুহূর্তে কোনো দলে নেই তিনি।
কিন্তু এমন প্রেক্ষাপটেও মি. রহমানের মন্তব্য নতুন করে আলোচনার সৃষ্টি করেছে। এখন বিএনপি কি তার মন্তব্য নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার দায় নেবে, অথবা দলে সদস্যপদ স্থগিত হওয়ার পর তিনি নিজে ভিন্ন কোনো চিন্তা থেকে আলোচনার জন্ম নেবে, এ ধরনের মন্তব্য করা অব্যাহত রাখছেন কিনা-এসব প্রশ্নে আলোচনা চলছে রাজনীতিতে।
তবে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বিবিসি বাংলাকে বলেন, ” এখন ওনার পদ তিন মাসের জন্য স্থগিত। এখন উনি যেটা বলছেন সেটা ওনার নিজের বক্তব্য। এখনতো তিনি দলের লোক না। সুতরাং সে কি বললো না বললো তার জন্য তো দল দায়িত্ব নেবে না।”
ফজলুর রহমান অবশ্য বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, তার ভিন্ন কোনো চিন্তা নেই । তিনি বিএনপিতে আছেন এবং থাকবেন।
তবে তার সর্বশেষ মন্তব্যের জের ধরে তাকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ডাকসু।
গতকাল রোববার এক বিবৃতিতে তার ‘ অবমাননাকর মন্তব্যের ‘ নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ডাকসু।
গণমাধ্যমে ডাকসুর পাঠানো ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ” ডাকসু নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বিএনপির নেতৃত্বস্থানীয় পর্যায় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে ‘বিক্রি হয়ে যাওয়া মস্তিষ্ক, ট্রেন্ডে গা ভাসানো, দাসী, এবং পশ্চাদপদ’ ইত্যাদি ঘৃণিত বিশেষণে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হাটহাজারী মাদরাসায় রূপান্তরিত হয়েছে বলেও ফজলুর রহমান মন্তব্য করেছেন, এ বিষয়ও উল্লেখ করা হয়েছে বিবৃতিতে।
ডাকসুর জিএস এস এম ফরহাদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, বিএনপির একাধিক নেতৃবৃন্দ ডাকসু নিয়ে কথা বলেছেন, সেটি দলীয় অবস্থান কি না, তা বুঝতেই বিবৃতি দেওয়া হয়েছে।
যদিও ফজলুর রহমান বলেছেন, ডাকসু নিয়ে করা বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইবেন না। তিনি বলেছেন, বিএনপি নেতা হিসেবে নয় বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা ও শিক্ষার্থী হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে তিনি কিছু মন্তব্য করেছেন।
ফজলুর রহমানের মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান ডাকসুর
ফজলুর রহমান বিএনপিতেই থাকতে চান
বিএনপিতে সব পদ তিন মাসের জন্য স্থগিত হলেও মি. রহমান দাবি করেন, বিএনপিতে তার অবস্থান রয়েছে এবং থাকবেও।
“বিএনপিতে আছি, থাকবোও। নতুন কোনো রাজনৈতিক দলে যাচ্ছি না ” বলেন তিনি।
এদিকে, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আরেকটি রাজনৈতিক দল গঠনের সম্ভাবনা নাকচ করে দেন মি. রহমান।
এটিকে গুজব বলে উল্লেখ করে ফজলুর রহমান অভিযোগ করেন, “এটা তো জামায়াত আমার নামে করতেছে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি আমার নামে করতেছে। আমি যাচ্ছি নাতো। এটা এআই করে করছে, আমি তো চ্যালেঞ্জ করছি “।
ডাকসু নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, সে ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ফজলুর রহমান জানান, বিএনপি নেতা হিসেবে নয় বরং ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী ও সাবেক ছাত্রনেতা হিসেবে কথা বলেছেন তিনি।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্র সংগঠনের সভাপতি ছিলেন বলেও এ সময় উল্লেখ করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময়ই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন উল্লেখ করে মি. রহমান বলেন, “আমি ছাত্র ছিলাম, ছাত্র রাজনীতি করছি, লেখাপড়া করছি, মুক্তিযুদ্ধে গেছি। এই দায়িত্ববোধ তো আমার ইউনিভার্সিটির প্রতি আছেই। এটা দল লাগবে কেন? “
তিনি বলেন, “ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ করে দিয়েছেন। সেখানে ৬০ হাজার ছাত্র আছে এবং তাদেরকে আমি শ্রদ্ধা করি, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদেরকেও শ্রদ্ধা করি।”
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ভালো বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে আগে আর কখনো মাদ্রাসার কোনো শিক্ষার্থী ডাকসুর ভিপি, জিএস দূরের কথা এমনকি মেম্বারও হয়নি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এমন প্রেক্ষাপটেই ‘ঢাবি এখন একটা সিনিয়র মাদ্রাসা হয়ে গেছে’ বলে মন্তব্য করেছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এ কথা আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলেছেন এবং একজন উপ – উপাচার্য বলেছেন বলেও জানান তিনি।
ফলে ডাকসুর পক্ষ থেকে তাকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার যে আহ্বান করা হয়েছে তা একেবারেই নাকচ করে দেন তিনি।
মি. রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন,” না না, কেন আমি ক্ষমা চাবো?”
তবে, মাদ্রাসা এবং মাদ্রাসার শিক্ষাকে শ্রদ্ধা করেন উল্লেখ করে তিনি জানান মাদ্রাসার শিক্ষা খারাপ এমন কথা বলেননি।
ডাকসু যে বিবৃতি দিয়েছে সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “শিবিরের ছেলেরা আমাকে ভালো বলবে এটা আমি আশা করি না। শিবিরের ছেলেরা আমার বিরোধিতা করবে না, আমার পক্ষে বলবে সেইটাও আমি আশা করি না।”
বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভির মতে, ডাকসুর জিএস এস এম ফরহাদের ‘দলকে সতর্ক করার’ বক্তব্য ফ্যাসিবাদেরই আরেক রূপ।
‘ডাকসু বিএনপিকে সতর্ক করতে চায়’
ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে এবার ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের প্রায় নিরঙ্কুশ বিজয় হয়েছে।
ডাকসুর ২৮ পদের মধ্যে ২৩টিতে এই প্যানেল জয়ী হয়েছে। নির্বাচনের ফল ঘোষণার বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতাই বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন।
এদের মধ্যে ফজলুর রহমানের করা মন্তব্য নিয়ে বেশ আলোচনা তৈরি হয়েছে।
গণমাধ্যমে ডাকসুর পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “ডাকসু নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বিএনপির নেতৃত্বস্থানীয় পর্যায় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে বিক্রি হয়ে যাওয়া মস্তিষ্ক, ট্রেন্ডে গা ভাসানো, দাসী, পশ্চাদপদ ইত্যাদি ঘৃণিত বিশেষণে আখ্যায়িত করা হয়েছে।”
ডাকসুর জিএস এস এম ফরহাদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, বিএনপির একাধিক নেতৃবৃন্দ ডাকসু নিয়ে কথা বলেছেন, সেটি দলীয় অবস্থান কি না বুঝতেই বিবৃতি দেওয়া হয়েছে।
“দলকে কোয়েশ্চেন না করে জাস্ট দলকে কানেক্ট করা হয়েছে। যাতে দল স্ট্যান্ডের (অবস্থান) ব্যাপারে অন্তত ক্লিয়ার থাকে ” বলেন ডাকসুর জিএস।
কেন বিএনপির নেতৃত্বস্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের কথা বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি জানান, এর মাধ্যমে দলকেও (বিএনপি) সতর্ক করা হয়েছে।
” এটা ওনাদেরকে অ্যালার্ট(সতর্ক) করা আরকি। বাকি কথাগুলোতে ডি-মোরালাইজ করা হয়নি, অন্যদের কথাগুলোতে এটা সত্য। কিন্তু ট্রল করা হইছে। ওনাদেরকে ক্লিয়ার করা, যেটুকু করছেন এবার থেমে যান। আর যাতে না আগান ” বলেন মি. ফরহাদ।
তার মতে, আগে শিক্ষার্থীদেরকে যেভাবে ‘ক্লাসিফাই’ করা হতো, যেমন কেউ মাদ্রাসার, কেউ অন্য ধর্মের এমন দৃষ্টিভঙ্গি ডাকসু নির্বাচনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
ফজলুর রহমানের বক্তব্যেও এমন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বলে উল্লেখ করেন ডাকসুর জিএস।
আর এ কারণেই ফজলুর রহমানের মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ডাকসু।
বিএনপি নেতা হিসেবে নয় বরং ঢাবির সাবেক ছাত্রনেতা ও শিক্ষার্থী হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে ডাকসু নিয়ে মন্তব্য করেছেন বলে দাবি ফজলুর রহমানের।
অটোক্রেসি দেখতে পাচ্ছি, বললেন রিজভী
নির্বাচনের পাঁচ মাস আগে ফজলুর রহমানের নানা মন্তব্য বা বক্তব্যে দলে কোনো প্রভাব বা তার অবস্থান নড়বড় হবে কি না- এমন বিষয় জানতে চাইলে মি. রিজভী জানান, এটা পরের বিষয়।
“না, এই মুহূর্তে তো, সে আর দলের লোক না ” উল্লেখ করেন মি. রিজভী।
তিন মাস পরে ফজলুর রহমানের দলীয় পদের স্থগিতাদেশের কি হবে- এমন প্রশ্নে তিনি জানান সেটা সে সময় দেখা যাবে।
“এখন তো সে আমাদের কেউ না, সুতরাং সে কি বললো না বললো তার জন্য রেসপন্স নিবো না ” বলেন মি. রিজভী।
দল হিসেবে বিএনপিকেও সতর্ক করা হয়েছে বলে ডাকসুর জিএস মি. ফরহাদ যে মন্তব্য করেছেন, এমন বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন বিএনপি নেতা মি. রিজভী।
মি. রিজভির মতে, এমন বক্তব্য ফ্যাসিবাদেরই আরেক রূপ। গণতন্ত্রে ভিন্নমত, বিতর্ক ও আলোচনা, সমালোচনা থাকবেই। সত্যিকারের গণতন্ত্র হলে ভিন্নমত প্রকাশের অবকাশ থাকবেই।
এক দল আরেক দলের নানা কর্মকাণ্ডে অসঙ্গতি দেখলে সমালোচনা করবে, এটাই গণতন্ত্রের ‘নর্মস বা রীতি-নীতি’ বলে মন্তব্য করেন মি. রিজভী।
“কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে কথা বললে সেটা একেবারে সংবিধান বরখেলাপ হবে? গণতন্ত্রেতো উন্মুক্ত আলোচনার কথা বলা হয়েছে ” ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন এই বিএনপি নেতা।
ডাকসুর জিএসের ওই মন্তব্যকে ইঙ্গিত করে মি. রিজভীর দাবি, যদি সত্যিকারের গণতন্ত্র হয়, তবে সেখানে ভিন্নমত প্রকাশের যথেষ্ট অবকাশ থাকে। তারা যেটার কথা বলছে সেটা ভিন্নমত প্রকাশের নয়।
এখন বাংলাদেশে ধর্মীয় উন্মাদনার স্বৈরতন্ত্র দেখছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ” এর আগে এক ধরনের চেতনা নিয়ে সেক্যুলার স্রিজোফ্রেনিক অটোক্রেসি দেখলাম, এখন একটা ধর্মীয় উন্মাদনার অটোক্রেসি দেখতে পাচ্ছি।”
বিবিসি নিউজ বাংলা, ঢাকা