বাংলাদেশে অপহরণের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে এই অপরাধ দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে অপহরণের শিকার হয়েছেন ৭১৫ জন মানুষ। গত বছর একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল ৩৪০।
এক মাসেই সর্বোচ্চ রেকর্ড
অপহরণের দিক থেকে ২০২৫ সালের জুলাই মাস ভয়ংকর রেকর্ড গড়েছে। শুধু এই মাসেই অপহরণের শিকার হয়েছেন ১০৯ জন। গড়ে প্রতিদিন তিনজনের বেশি মানুষ অপহৃত হচ্ছেন—যা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বড় অবনতির ইঙ্গিত দেয়।
বাংলাদেশ পুলিশের মাসিক অপরাধ পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই চিত্র উঠে এসেছে। যদিও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পর্যবেক্ষণে সংখ্যায় সামান্য তারতম্য দেখা যায়, তবুও সবাই বলছে—অপরাধ বাড়ছে।
পুলিশের ব্যাখ্যা
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপুলিশ পরিদর্শক (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এইচ এম শাহাদাত হোসাইন বলেন, “প্রতি মাসেই অপরাধের পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়, যাতে বর্তমান প্রবণতা বোঝা যায়। কোনো অপরাধ বাড়তে দেখলেই আমরা কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করি।”
তবে সমালোচকরা বলছেন, শুধু ব্যাখ্যা দেওয়ার বদলে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি।

সংখ্যার পরিসংখ্যান
২০২৪ সালে মোট অপহরণের শিকার হয়েছিলেন ৬৪২ জন। এর মধ্যে আগস্ট পর্যন্ত সংখ্যা ছিল ৩৪০। সেই হিসাবে মাসে গড়ে অপহরণ হয়েছিল প্রায় ৪২ জন। অথচ চলতি বছরের একই সময়ে মাসিক গড় বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯০ জনে। অর্থাৎ এক বছরে দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) বলছে, গত ছয় বছরের মধ্যে ২০২৫ সালের জুলাই মাসই একক মাস হিসেবে সর্বোচ্চ অপহরণের রেকর্ড করেছে।
মানবাধিকার সংগঠনের উদ্বেগ
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চেয়ারম্যান জেড আই খান পান্না বলেন, “আমরা যত মামলা দেখি, প্রকৃত ঘটনা তার চেয়ে অনেক বেশি। অনেক সময় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে মামলা করা যায় না। দেশে আইন নেই, আইনের শাসনও নেই—ফলে অপরাধও বাড়ছে।”
বিশেষজ্ঞদের মত
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মনে করেন, “প্রতিদিন গড়ে তিনজন অপহরণের শিকার হওয়া মানে দেশে আইনের শাসনের বড় ঘাটতি আছে। যখন অপরাধ বাড়ে, তখন সেটিকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এতে অপরাধীরা আরও সুযোগ পায়।”

অর্থনৈতিক চাপও দায়ী
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক ও পারিবারিক শত্রুতা থেকে অনেক অপহরণ ঘটে। তবে সবচেয়ে বেশি অপহরণ হয় আর্থিক কারণে। পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যখন কাজ হারান, তখন প্রথমে সঞ্চয় খরচ হয়, পরে ঋণ নেওয়া হয়, আর শেষ পর্যন্ত অনেকে অপরাধে জড়িয়ে পড়েন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, গত এক বছরে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে এক লাখ ৬০ হাজার। ২০২৪ সালের শেষে এই সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ ২০ হাজার। কর্মসংস্থানের এই সংকটও অপরাধ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।
সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা
- চট্টগ্রাম, ১৭ সেপ্টেম্বর: পটিয়ায় মুরগি ব্যবসায়ী নুরুল আবছারকে অস্ত্রের মুখে তুলে নেয় সন্ত্রাসীরা। মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করে ১৭ লাখ টাকা। পুলিশ দুই ঘণ্টার মধ্যে তাকে উদ্ধার করে।
- কুমিল্লা, সেপ্টেম্বর: ৩৬ দিন নিখোঁজ থাকার পর রিকশাচালক মেহেদী হাসানের মাথার খুলি উদ্ধার করে সিআইডি। তাকে অটোরিকশা ছিনতাইয়ের জন্য হত্যা করা হয়েছে বলে জানায় পুলিশ।
- চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ১৫ সেপ্টেম্বর: পাওনা টাকা আদায়কে কেন্দ্র করে মো. সানি আহম্মেদ অপহৃত হন। মুক্তিপণ হিসেবে আট লাখ টাকা দাবি করা হয়। পরে তাকে উদ্ধার করে পুলিশ এবং পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

শেষকথা
দেশে অপহরণের এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা আইন-শৃঙ্খলার জন্য বড় হুমকি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক ব্যবহার ও অর্থনৈতিক চাপ একসঙ্গে কাজ করছে। মানুষ প্রতিদিন যখন নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে জীবনযাপন করছে, তখন কেবল পরিসংখ্যান নয়—প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ ও দৃশ্যমান ফলাফল।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















