কলকাতার মানুষ যখন আসন্ন দুর্গাপূজার উৎসবকে ঘিরে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে ব্যস্ত থাকার কথা, তখনই রেকর্ড ভাঙা এক প্রবল বৃষ্টিপাতে অচল হয়ে গেল পুরো নগরী। প্রাণহানি ঘটেছে অন্তত ১১ জনের, ডুবে গেছে হাজারো রাস্তা, জলমগ্ন হয়েছে তিন হাজারেরও বেশি পূজামণ্ডপ। দুর্গোৎসবের ঠিক আগে এই দুর্যোগ শুধু জনজীবন বিপর্যস্ত করেনি, বরং শারদীয়ার প্রস্তুতিকে করেছে মারাত্মকভাবে অনিশ্চিত।
টানা প্রবল বর্ষণে ডুবে গেল শহর
প্রায় চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাক-পূজা বৃষ্টিতে মঙ্গলবার সকালে বিপর্যস্ত হলো কলকাতা ও আশপাশের এলাকা। মাত্র ছয় ঘণ্টার প্রবল বর্ষণেই অচল হয়ে পড়ে দেড় কোটিরও বেশি মানুষের এই নগরী। বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১১ জন। দুর্গাপূজার আগে নগরীর প্রস্তুতিও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে।
শহরের চিত্র: রাস্তায় নদী, গাড়ি ডুবে, ঘরে পানি
রাতভর প্রবল বর্ষণে (প্রতি ঘণ্টায় ৯৮ মিলিমিটার) রাস্তাঘাট নদীতে পরিণত হয়। দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়ায় বৃষ্টির পরিমাণ ছিল ৩৩২ মিলিমিটার, আর উত্তর কলকাতার থানথানিয়ায় ১৯৫ মিলিমিটার।
ফলে শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলো তলিয়ে যায়। মেট্রো ও লোকাল ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। বিমানবন্দর ও রেল স্টেশনও আংশিক অচল হয়। অনেক ফ্ল্যাট ও বাড়িতে পানি ঢুকে পড়ে। গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে পড়ায় অসংখ্য যানবাহন রাস্তায় ফেলে রাখতে হয়েছে।
বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নিহতদের বেশিরভাগ
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, নিহত ১১ জনের মধ্যে ৯ জনই খোলা বা অব্যবস্থাপিত বিদ্যুতের তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছেন। আটজন মারা গেছেন কলকাতায়, বাকি তিনজন উত্তর ২৪ পরগনার শাসন, দক্ষিণ ২৪ পরগনার আমতলা ও নারেন্দ্রপুর এলাকায়।
জরুরি ব্যবস্থা ও সরকারি পদক্ষেপ
মুখ্যমন্ত্রী নবান্নে একটি কন্ট্রোল রুম খোলার নির্দেশ দেন এবং কলকাতা পৌরসভাকে হুগলি নদীতে দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিতে বলেন। তবে মঙ্গলবার দুপুর থেকে নদীতে জোয়ার থাকায় কাজ বিলম্বিত হয়।
সরকারি সব স্কুল-কলেজে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনলাইন ক্লাস চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও পূজার ছুটি দুই দিন আগে শুরু করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
রাজনীতিতে চাপানউতোর
বিজেপি অভিযোগ করেছে, আবহাওয়া দপ্তরের সতর্কতা সত্ত্বেও তৃণমূল সরকার ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, “সরকার ঘুমাচ্ছিল, আর শহর ডুবে গেছে।”
অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থা সিইএসসি এবং কেন্দ্রীয় মেট্রো কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেছেন। তাঁর দাবি, সিইএসসিকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারপ্রতি পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
সিইএসসির ব্যাখ্যা
সিইএসসি জানিয়েছে, আটজনের মৃত্যুর মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে আবাসিক ভবনের অভ্যন্তরীণ তারের সমস্যার কারণে। তিনজন মারা গেছেন রাস্তায় বৈদ্যুতিক খুঁটি স্পর্শ করার পর, যা সিইএসসির রক্ষণাবেক্ষণের আওতায় পড়ে না। সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে জলমগ্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল বলে সংস্থা জানিয়েছে।
আবহাওয়া দপ্তরের সতর্কতা
আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের ওপর থাকা ঘূর্ণাবর্ত আগামী ২৪ ঘণ্টায় কিছুটা দুর্বল হতে পারে। তবে ২৫ সেপ্টেম্বরের দিকে আবার বঙ্গোপসাগরে নতুন নিম্নচাপ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে আরও এক দফা বৃষ্টিপাত হতে পারে।
হুগলি নদীর সীমাবদ্ধতা
মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেছেন, ফারাক্কা ব্যারাজে যথাযথ খনন না হওয়ায় হুগলি নদীর পানিধারণ ক্ষমতা ক্রমেই কমে গেছে। তাঁর মতে, বিহার, উত্তর প্রদেশ ও ঝাড়খণ্ড থেকে আসা অতিরিক্ত পানি পশ্চিমবঙ্গকে চরমভাবে বিপর্যস্ত করছে।
দুর্গাপূজার প্রস্তুতিতে বড় ধাক্কা
প্রায় তিন হাজার পূজামণ্ডপ জলমগ্ন হয়েছে। “ফোরাম ফর দুর্গোৎসব”-এর সাধারণ সম্পাদক শশ্বত বসু জানান, শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি ভেস্তে গেছে। অনেক শিল্পকর্ম ও প্রতিমা পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কলকাতার এই রেকর্ড বৃষ্টি শুধু প্রাণহানি ঘটায়নি, নগরজীবনের প্রতিটি স্তরকে অচল করে দিয়েছে। দুর্গাপূজার ঠিক আগে এই দুর্যোগ শহরবাসীর আনন্দকে ম্লান করে দিয়েছে। নাগরিক অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা ও সরকারি উদ্যোগের ব্যর্থতা আবারও সামনে নিয়ে এসেছে একটি প্রশ্ন—প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশ্বের অন্যতম জনবহুল এই নগরী কতটা প্রস্তুত?