রেকর্ড উৎপাদনেও সংকট
দেশে এবার ভুট্টা ও সয়াবিন খৈলের রেকর্ড উৎপাদন হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় ও শিল্প সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ভুট্টার সরবরাহ ইতিহাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। একই সঙ্গে ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো ৪০ লাখ টনের বেশি সয়াবিন ও সরিষার খৈল মজুদ করে রেখেছে। ফলে কাঁচামালের দাম গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে।
কৃষি বাজারে ভুট্টার দাম মে-জুন মৌসুমে কেজি প্রতি ২০-২৬ টাকা থেকে বর্তমানে ৩৫-৩৬ টাকায় উঠলেও তা গত বছরের তুলনায় এখনও কম। সয়াবিন খৈলের দামও কেজি প্রতি ৪৭-৪৮ টাকায় নেমেছে, যেখানে ২০২৪ সালে তা ছিল ৬৫-৭০ টাকা এবং ২০২২ সালে ৭৫-৮০ টাকা।
খাদ্যশিল্পের মূল্য রহস্য
অন্যদিকে ফিড মিল মালিকরা খুচরা খাদ্যের দাম কমাননি। বর্তমানে মুরগির খাদ্য কেজি প্রতি ৬০-৭৫ টাকা, মাছের খাদ্য ৫৮-৬৫ টাকা এবং গবাদি পশুর খাদ্য ৬৫-৮০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার অভিযোগ করেছেন, মিল মালিকরা কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে রাখছে। তাঁর দাবি, কাঁচামালের দাম ২০ থেকে ৭০ শতাংশ কমলেও খাদ্যের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে এবং এতে প্রতি কেজিতে অতিরিক্ত ১০ টাকা লাভ করছে কোম্পানিগুলো।
কৃষকের দুর্দশা
কেরানীগঞ্জের পোলট্রি খামারি হাফিজুর রহমান জানান, একেকটি মুরগি বড় করতে অন্তত দুই কেজি খাদ্য লাগে। বাজারে মুরগির পাইকারি দাম কেজি প্রতি ১৬০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও খাদ্য খরচ বেড়ে যাওয়ায় খামার চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। গত তিন বছরে হাজারো খামার বন্ধ হয়ে গেছে।
ময়মনসিংহের তরুণ খামারি মনিরুল ইসলাম বলেন, “২০২১ সালে আমি ৩ হাজার মুরগি দিয়ে খামার শুরু করেছিলাম। কিন্তু খাদ্যের দাম অত্যন্ত বেড়ে গেছে, তাই এখন মাত্র ৭০০ মুরগি রেখেছি। ব্যাংকের কিস্তি শোধ করতে হিমশিম খাচ্ছি।”
ভোক্তার অভিজ্ঞতা
রাজধানীর মিরপুরে বসবাসকারী গৃহিণী রুবিনা আক্তার বলেন, “আগে সপ্তাহে দুদিন অন্তত মুরগি কিনতাম। এখন এক কেজি ২০০ টাকায় পৌঁছে যাওয়ায় মাসে একবারও কিনতে পারি না। ডিমও ডজন প্রতি ১৫০ টাকা, ফলে বাচ্চাদের জন্য প্রোটিন দেওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে।”
মালিবাগের বাসিন্দা রিকশাচালক ফরিদ মিয়া জানালেন, “আগে পরিবারকে নিয়ে সপ্তাহে একদিন মাছ বা মুরগি রান্না হতো। এখন শুধু আলু আর ডালেই দিন কাটছে। রুই-কাতলা তো দূরের কথা, ডিমও বিলাসিতা মনে হয়।”
সরকারের নীতিগত অবস্থান
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শরীফুল হক জানান, দেশে ৪৫ কোটির বেশি হাঁস-মুরগি, গবাদি পশু ও মাছ উৎপাদন নির্ভরশীল খাদ্যের ওপর। বছরে প্রায় ৬০ লাখ টন খাদ্যের প্রয়োজন হয়। তিনি বলেন, “আমরা বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। খামারিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনাধীন।”
কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “দেশীয় উৎপাদন যখন ৮৫ শতাংশ কাঁচামালের চাহিদা মেটাচ্ছে, তখন খাদ্যশিল্পে এই অস্বাভাবিক দাম যৌক্তিক নয়। সরকার চাইছে উৎপাদনশীলতা টিকিয়ে রাখতে, তবে বাজারে স্বচ্ছ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত না হলে খামারিরা টিকতে পারবে না।”
বাজারের প্রভাব
বাংলাদেশে ৪৫ কোটির বেশি হাঁস-মুরগি, গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ ও মাছ উৎপাদন নির্ভরশীল খাদ্যের ওপর। বছরে প্রায় ৬০ লাখ টন খাদ্য লাগে, যার মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশ ভুট্টা ও সয়াবিন খৈল এখন দেশে উৎপাদিত হয়। তবুও খাদ্যশিল্পের বাজার প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার সমান, যেখানে ৩০০টিরও বেশি কারখানা চাহিদা পূরণ করছে।
শিল্পমালিকদের যুক্তি
ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. আহসানুজ্জামান বলেন, কাঁচামালের বড় অংশ এখনও আমদানি করতে হয়। এর ওপর নতুন ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর, ডলারের উচ্চ বিনিময় হার এবং ব্যাংক ঋণের সুদের চাপ খাদ্যের দাম কমাতে বাধা দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক গোলাম হাফিজ কেনেডি মনে করেন, দেশীয় উৎপাদন যখন চাহিদার বড় অংশ পূরণ করছে, তখন খাদ্যের দাম কমানো উচিত। তাঁর মতে, ফিড মিলগুলোকে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজার পরিস্থিতি অনুযায়ী দাম সমন্বয় করতে হবে। পাশাপাশি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উচিত বাজার নিয়ন্ত্রণে আরও সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া, যাতে কৃষক ও ভোক্তা উভয়েই লাভবান হয়।