এক কৃষকের মাঠে দাঁড়িয়ে
ঝালকাঠির চরাঞ্চলে দাঁড়িয়ে আছেন কৃষক আবদুল হালিম। তার চোখের সামনে বিস্তীর্ণ সবজি খেত জলে ডুবে আছে। মরিচ গাছগুলো অর্ধেক পর্যন্ত পানিতে ডুবে ঝিমিয়ে পড়েছে, টমেটোর চারা হলুদ হয়ে গেছে। হালিমের গলা শুকিয়ে আসে—
“এই মৌসুমে ধার করে বীজ আর সার কিনেছিলাম। সব শেষ। বাজারে যদি শাকসবজি তুলতে না পারি, ঋণ শোধ করবো কিভাবে?”
এ দৃশ্য শুধু হালিমের নয়। দেশের উত্তর ও দক্ষিণের বহু জেলা, বিশেষ করে কুড়িগ্রাম, খুলনা, সাতক্ষীরা ও চুয়াডাঙ্গার চাষিরা একই সমস্যার মুখে। অতিবৃষ্টি আর জলাবদ্ধতা তাদের মাঠ গিলে ফেলছে।
যখন আকাশ খামখেয়ালি
বিগত কয়েক সপ্তাহের অতিরিক্ত বৃষ্টি শুধু ফসল ধ্বংস করেনি, ভেঙে দিয়েছে কৃষকের আশা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব বলছে— প্রায় এক লাখ ত্রিশ হাজার হেক্টর জমি পানিতে ডুবে আছে। কোথাও মরিচের খেত, কোথাও বাঁধাকপির বাগান, কোথাও আবার শাকপাতা।

খুলনায় টানা চার দিনের বৃষ্টিতে ২,৩২৫ হেক্টর প্রারম্ভিক শীতকালীন সবজি নষ্ট হয়েছে। এ ক্ষতির আঘাত সরাসরি ধাক্কা দিচ্ছে বাজারে।
বাজারে হতাশ ক্রেতা
ঢাকার কারওয়ান বাজারের এক ভোরবেলায় দৃশ্য অন্যরকম। ট্রাক থেকে নামছে শসা, লাউ, কচি বাঁধাকপি— কিন্তু সেগুলোর রঙ উজ্জ্বল নয়, পাতা কুঁচকে গেছে। পাশে দাঁড়ানো এক ক্রেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন—
“মান ভালো না, দাম বেশি। কেমন করে কিনবো?”
এভাবেই নিম্নমানের সবজি বাজারে ঢুকছে। পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে, আর্দ্রতায় সবজি দ্রুত নষ্ট হচ্ছে। বিক্রেতারা ঝুঁকি এড়াতে কম স্টক রাখছেন। ফলে দাম আরও বাড়ছে।
রান্নাঘরের টেবিলে আঘাত
সবচেয়ে বেশি চাপে আছেন নিম্নআয়ের মানুষ। তাদের দৈনিক রান্নাঘরের বাজেট এখন হুমকির মুখে। শাক, গাজর, শসা কিংবা করলা— নিত্যপ্রয়োজনীয় এসবের দাম বাড়ায় তারা অল্প কিনছেন, কিংবা একেবারেই কিনতে পারছেন না।
এক গৃহিণী জানালেন—
“শিশুদের জন্য প্রতিদিন সবজি রান্না করতাম। এখন দু’দিনে একবারও করতে পারি না। সবজি আর আমাদের সাধ্যের মধ্যে নেই।”
শুধু পরিবার নয়, হোটেল, রেস্তোরাঁ, স্কুল, হাসপাতাল—সব প্রতিষ্ঠানেই দৈনিক সবজি সরবরাহে টান পড়ছে।
প্রতিবেশী রাজ্যের গল্প
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও ত্রিপুরার একটি নিবিড় কৃষি সম্পর্ক আছে। শীতকালীন মরিচ ও সবজির বড় অংশ আসে এই রাজ্যগুলো থেকে। কিন্তু এ বছর সেখানেও একই দুর্দশা।

পশ্চিমবঙ্গে অতিবৃষ্টিতে করলা, বাঁধাকপি ও ফুলকপির উৎপাদন কমছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “জলাবদ্ধতা ও মাটির পুষ্টি ক্ষয়” কৃষিকে সবচেয়ে বেশি নষ্ট করছে। অসমে পাহাড়ি ঢালে মাটিধস ও পানির চাপ আরও ভয়াবহ।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন— সড়ক ও রেল যোগাযোগে বিঘ্ন ঘটলে আমদানির খরচ ও সময় দুই-ই বাড়বে।
সংকটের বৃত্তে
কৃষকের মাঠে ক্ষতি, বাজারে সরবরাহ কমা, ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস— সব মিলিয়ে একটি জটিল চক্র তৈরি হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য।
ফলে একদিকে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত, অন্যদিকে ভোক্তা চাপে। বাজারে সৃষ্টি হচ্ছে এক প্রকার অদৃশ্য বৃত্ত— “ক্ষতি + স্বল্পতা + লোভ = মূল্যবৃদ্ধি”।
গল্পের শেষ, কিন্তু সংকটের নয়
এই গল্প শেষ হচ্ছে বাজারের এক সন্ধ্যায়। এক কৃষক তার নষ্ট টমেটোর গাড়ি বাজারে এনে দাঁড়িয়ে আছেন। দাম দিতে চাইছে না কেউ। পাশে ক্রেতারা অভিযোগ করছেন— “সবজি ভালো না, দাম বেশি।”

এ দৃশ্যটাই বর্তমান বাংলাদেশের কৃষি ও বাজারের বাস্তবতা।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের এই আঘাত শুধু মাঠে সীমাবদ্ধ নয়— তা পৌঁছে গেছে রান্নাঘর, বাজার আর প্রতিটি ঘরে। সময় থাকতেই ব্যবস্থা নিতে হবে, নতুবা এ সংকট সারা জাতির কাঁধে চেপে বসবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















