প্রবল বর্ষণে বিপর্যস্ত কলকাতা
দুর্গাপূজার প্রস্তুতির মধ্যেই টানা প্রবল বর্ষণে জলমগ্ন হয়ে পড়েছে কলকাতা। মঙ্গলবার মাত্র ছয় ঘণ্টায় প্রায় ২৫১ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়, যা গত চার দশকে সবচেয়ে বেশি। এই প্রবল বর্ষণে শহর ও উপকণ্ঠে অন্তত ১১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। শহরের প্রধান সড়কগুলো নদীর মতো রূপ নিয়েছে, মেট্রো ও লোকাল ট্রেন পরিষেবা বন্ধ হয়ে গেছে, আর বহু বিখ্যাত প্যান্ডেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমনকি আলিপুর চিড়িয়াখানায় দুটি কুমিরও ঘের থেকে বেরিয়ে আসে, যদিও এক ঘণ্টার মধ্যে তাদের ফের আটক করা হয়।
উৎসবের মাঝেই ভয়াবহ ক্ষতি
দুর্গাপূজা কলকাতার সাংস্কৃতিক ক্যালেন্ডারের সবচেয়ে বড় আয়োজন। কয়েক মাস আগে থেকেই প্রতিমা তৈরি, প্যান্ডেল নির্মাণ এবং সজ্জার কাজ শুরু হয়। তবে প্রবল বর্ষণ সব আয়োজন ভেস্তে দিয়েছে। বালিগঞ্জ, সল্টলেক, পাটুলি, সন্তোষপুরসহ উত্তর ও মধ্য কলকাতার বহু এলাকা এখনো জলমগ্ন। কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে, শত শত গাড়ি ডুবে গেছে। কলেজ স্ট্রিটের বিশাল বইয়ের বাজারে হাজারো বই ও নথি ভিজে গেছে।
ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা ও বর্তমান সংকট
আঠারো শতকে জমিদারবাড়ির বাইরে বেরিয়ে সমাজের বৃহত্তর অংশে দুর্গাপূজা ছড়িয়ে পড়ে। স্বাধীনতা আন্দোলনেও এটি মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়। আজও প্রায় তিন হাজার পূজা কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়, যা প্রায় ৩২,৩৭৭ কোটি টাকার অর্থনীতি তৈরি করে। উৎসব শুরু হতে তিন দিন বাকি থাকতেই আয়োজকেরা ক্ষতি সামাল দিতে রাতদিন কাজ করছেন।
সিঙ্গি পার্ক সার্বজনীন দুর্গাপূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার জানান, প্লাইউড দিয়ে তৈরি শৈল্পিক অংশগুলো ভেসে গেছে। জয়শ্রী ডামডাম ক্লাবের সভাপতি সঞ্জয় দাস বলেন, তাদের প্যান্ডেলের সামনের অংশ ভেঙে পড়েছে। মানিকতলার ৮৫ বছরের পুরোনো চাঁলতাবাগান পূজায় প্রতিমাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শিল্পী মিন্টু পাল বলেন, তিনি অন্তত ১৫টি ফোন পান প্রতিমা মেরামতের জন্য। কারিগররা দিনরাত মেরামতের কাজে ব্যস্ত।
সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ
নিউ গড়িয়া কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির প্রায় ৫০০ পরিবার হাঁটুজলে ডুবে আছে। ভূগর্ভস্থ জলাধার, পাম্প, গ্যারেজ সব পানির নিচে। অনেক প্রবীণ মানুষ গৃহকর্মীর সাহায্য না পেয়ে সমস্যায় পড়েছেন। কসবা ও দক্ষিণ কলকাতার আরও বহু এলাকায় পানীয় জলের সংকট দেখা দিয়েছে।
ইএম বাইপাসের পাশের আবাসনগুলোতে মঙ্গলবার থেকে বিদ্যুৎ নেই। বাসিন্দারা পানীয় জল কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। উৎসবের আলো লাগানো হলেও তা এখনো ব্যবহার হয়নি। অনেক পরিবার ভ্রমণের পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন। গাড়ি ক্ষতির অভিযোগও শতাধিক মেরামতকারীর কাছে পৌঁছেছে।
চিড়িয়াখানায় দুটি কুমির বেরিয়ে পড়ায় আতঙ্ক ছড়ায়। কর্মকর্তারা জানান, বাইরে বেরোনোর আশঙ্কা ছিল না, কারণ নিকাশিনালায় জাল বসানো আছে।
নিকাশি ব্যবস্থার ভেঙে পড়া
ব্রিটিশ আমলে তৈরি কলকাতার ১৫০ বছরের পুরোনো ভূগর্ভস্থ নিকাশি ব্যবস্থা সংস্কারের দাবি সত্ত্বেও মঙ্গলবার তা ভেঙে পড়ে। বৃষ্টির জল ছাড়াও খাল থেকে পানি উঠে এসে শহর প্লাবিত করে।
রাজনীতি ও ক্ষোভ
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০টিরও বেশি প্যান্ডেল উদ্বোধন করে বলেন, “প্রকৃতি আমাদের হাতে নেই। বহু বছর ধরে কলকাতা বন্দর, ফারাক্কা ব্যারাজ, মাইথন জলাধারে খনন হয়নি। ফলে অন্য রাজ্যে বৃষ্টি হলেই জল বাংলায় নামে।”
অন্যদিকে বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী সরকারের ব্যর্থতা ও উদাসীনতার সমালোচনা করে বলেন, “বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এবং ডুবে মানুষের মৃত্যুই প্রমাণ করে শাসকরা দায় এড়াতে চাইছে।”
মৃত্যুর মিছিল
প্রবল বর্ষণে প্রাণ হারানোদের বেশিরভাগই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছেন। তাদের মধ্যে আছেন এক নিরাপত্তারক্ষী, যিনি ইনভার্টার চালানোর সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন; এক প্রবীণ ব্যক্তি, যিনি পানিভরা রাস্তায় খোলা তারে হাত দেন; এক সাইকেল আরোহী; আরেকজন, যার লাশ প্রধান সড়ক থেকে উদ্ধার হয়।
বুধবার বিকেলে সূর্য ওঠার পর কিছু এলাকায় স্বাভাবিক জীবনের ছাপ দেখা গেলেও উৎসবের আবহে এবার যেন দুঃখ ও ক্ষতির ছায়া। কলকাতার প্রিয় দুর্গাপূজার ঠিক আগমুহূর্তে প্রবল বর্ষণ শহরের প্রাণশক্তিকে নিস্তেজ করে দিয়েছে।