এসেছে বিশ্ব পর্যটন দিবস। নিশ্চয় মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড এবং বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন আয়োজন করবে র্যালি, আলোচনা, ফুড ফেস্টিভ্যাল বা হয়তো একটি স্মরণিকাও প্রকাশিত হবে। কিন্তু নিশ্চিত করেই বলা যায়, তাতে কোনো উদ্ভাবনী চিন্তার খোরাক পাওয়া যাবে না। বা বিদেশিদের আকৃষ্ট করবার মতো কোনো বিশেষ আয়োজনও থাকবে না। হবে গতানুগতিক দিবস পালনের আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
যখন এমন দিবসকে সামনে রেখে এবার বিশ্ব পর্যটন সংস্থা প্রতিপাদ্য ঠিক করেছে Tourism and Sustainable Transformation, বাংলায় করলে হয়তো এমনই দাঁড়ায়— পর্যটন ও টেকসই রূপান্তর। আমাদের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় অবশ্য এটিকে রূপান্তর করেছে “টেকসই উন্নয়নে পর্যটন” হিসেবে। কতটুকু যথার্থ হয়েছে সেই বিতর্কে না গিয়ে শুধু এটুকুই বলতে চাই, আগে পর্যটনটাই ঠিকভাবে দাঁড়াক, তারপর না হয় উন্নয়ন করে তা টেকসই করা হবে।

কয়েক বছর আগে একটা টকশোর বিষয় দেখেছিলাম একটি টেলিভিশন চ্যানেলে— “সম্ভাবনার পর্যটনে অনটন ঘুচবে কবে?” ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতার সূত্রে জেনেছিলাম, সরকারি কর্তৃপক্ষের কয়েকজন অভিমানী প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন বিষয়টি সম্পর্কে। এমনকি তখনকার পর্যটন মন্ত্রী টকশোতে এসেছিলেন, কিন্তু বিষয়টা হজম করতে পারেননি। পর্যটন নিয়ে জাতীয় নীতিমালা আছে, পর্যটনকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, সরকার প্রধানের নেতৃত্বে একটা নাকি জাতীয় ট্যুরিজম কাউন্সিলও আছে। আবার অনেক কিছুর পর বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড হয়েছে। এসবই ইতিবাচক, শুধু হতাশার বিষয় এই যে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের মনোজগতে পর্যটন এখনো অগ্রাধিকার পায়নি।
সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা— যারাই দায়িত্বে আসেন, তারা উচ্ছ্বসিত হন দেশে ট্যুরিজমের “ব্যাপক প্রসার” দেখে! এই যে তিন দিনের সরকারি ছুটি হলেই আর কক্সবাজারে থাকার জায়গা পাওয়া যায় না, দলে দলে মানুষ সাজেকের কংলাকের পাহাড়ে ছুটছে, কুয়াকাটায় কত অভিজাত আবাসিক হোটেল হয়ে গেলো, ফেসবুকে ভাইরাল হলো যে পঞ্চগড় থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে। না, এতে খুশি নন পর্যটনখাতের সাথে জড়িতরা। এমনকি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি ডিপার্টমেন্ট আছে, সেখানকার একাডেমিশিয়ানরাও বলেন— দেশের অর্থনীতিতে পর্যটন তখনই বড় ভূমিকা রাখবে যখন বিদেশি ট্যুরিস্টরা বেশি সংখ্যায় বাংলাদেশে আসবেন।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সিইও এবং বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে অবসর নেয়ার পর আখতারুজ জামান খান কবীর কয়েক দিন আগে একটি আলোচনায় বলছিলেন— “পর্যটন হচ্ছে ক্রিয়েটিভ এবং ডলার ইকোনমি।” বিদেশি পর্যটক বা ইনবাউন্ড ট্যুরিস্ট ছাড়া সেই ডলার-ভিত্তিক অর্থনীতির বিকাশ ঘটবে না।
সরকারের একজন সাবেক অতিরিক্ত সচিব এবং যিনি পর্যটন সম্পর্কিত দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন, তিনি যখন বলেন ট্যুরিজম সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় নেই এবং সেজন্য নীতিমালায় যতই পর্যটনকে শিল্প বলা হোক না কেন, এই খাতের বিকাশ তথা পর্যটন থেকে ডলার আয় করা সম্ভব হবে না। একই আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শোয়েবুর রহমানও বলেছেন— পলিসি লেভেল থেকে প্রায়োরিটি না পেলে দিন শেষে দেশে ট্যুরিজম দাঁড়াবে না।

বেসরকারি খাতের পুরোনো ট্যুর অপারেটর কোম্পানি বেঙ্গল ট্যুরসের এমডি মাসুদ হোসেন তো বলেই দিলেন— তারা ডলার আয় করলেও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তালিকায় যেমন তাদের নাম নেই, আবার বছর শেষে সরকারের তরফ থেকে এক কাপ চা-ও মেলে না তাদের জন্য, যারা বিদেশ থেকে ট্যুরিস্ট এনে দেশের জন্য ডলার আয়ের ব্যবস্থা করছেন। আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি জানিয়েছেন— নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও মিয়ানমারে গত কুড়ি বছরে ১৫ থেকে ২০ গুণ ট্যুরিস্ট বাড়লেও বাংলাদেশে তার উল্টো। আয় কমে যাওয়ায় উল্টো তার কোম্পানিতে কর্মরত জনবল ১০০ থেকে ১১ জনে নেমে আসার উদাহরণও দিলেন হতাশার সঙ্গেই।
প্যাসিফিক-এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন (পাটা) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের জেনারেল সেক্রেটারি ও ট্রাভেলবাংলা ডটকমের সহ-প্রতিষ্ঠাতা তৌফিক রহমান তো সচিবালয়ের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের উদাহরণ দিয়ে জানিয়েছেন— সরকারের পর্যটন সংশ্লিষ্ট বড় কর্মকর্তারা দেশে ট্যুরিজম বলতেই ডোমেস্টিক ট্যুরিজমকে বোঝেন। এমনকি বাংলাদেশ দেখতে যে পোল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড বা লাটভিয়া-লিথুনিয়ার মতো দেশ থেকেও শুধু অবসর কাটানোর পর্যটকরাও (Leisure Tourist) আসেন, সেটাও সরকারের নীতি-নির্ধারকদের অনেকেই মানতে চান না, বা বললেও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে দ্বিধা করেন না।
তবে একটু আশাবাদী হতে হয় এজন্য যে বাংলাদেশ যেমন জাতিসংঘ পর্যটন বা ইউএন ট্যুরিজমের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হিসেবে ১৯৮০ সাল থেকেই বিশ্ব পর্যটন দিবস পালন করে আসছে, ঠিক তেমনই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন। আর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেবার পর পর্যটন দিবসের মান উন্নয়ন ঘটিয়েছে— সেটাও উল্লেখ করতে হয়। আগে দিবসটি সরকারি তালিকায় “গ” শ্রেণিভুক্ত থাকলেও এবার তা পালিত হবে “খ” শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে।
তবে গত ১৩ মাসে পর্যটন মন্ত্রণালয় যে তিনজন উপদেষ্টা পেয়েছে, সেটাতে কি এই খাতকে সরকারের অগ্রাধিকার খাত বলা যায়? এমনকি কিছুদিন এই মন্ত্রণালয়টির দায়িত্বে ছিলেন স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টাও। সত্যি করে বললে, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মূল ফোকাস বিমান, পর্যটন নয়।
এই দেশে পর্যটন খাতের উন্নয়নে সরকার নীতিমালা করেছে, ট্যুরিজম বোর্ড করেছে— এমনকি বিগত সরকারের সময় প্রায় ২০ কোটি টাকা খরচ করে একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরির উদ্যোগ নেয়া হলেও তা কবে আলোর মুখ দেখবে, তা বোধ করি মন্ত্রণালয়ের বড় কর্তারাও বলতে পারবেন না। তবে সম্প্রতি ট্যুর অপারেটরদের রেজিস্ট্রেশনের একটি ভালো উদ্যোগ নিয়েছে ট্যুরিজম বোর্ড। তাতে ট্যুরিস্টদের অধিকার রক্ষায় সুফল মিলবে বলে আশা করা যায়।
কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক পর্যটন মেলায় সরকারের সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দেশের পর্যটন খাতে সরকারের অগ্রাধিকারের উল্টো বলেই মনে হয়। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে চরম রাজনৈতিক সংকটের পরেও যখন বেশ কয়েকটি ট্যুর অপারেটরকে নিয়ে নেপাল ট্যুরিজম বোর্ড ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান ট্যুরিজম ফেয়ারে স্টল নিয়ে অংশগ্রহণ করেছে, কিন্তু আমাদের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এসে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে আন্তর্জাতিক কোনো পর্যটন মেলায় আপাতত বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করবে না।
বিশেষ করে বর্তমান উপদেষ্টা মহোদয় দায়িত্ব নেয়ার পর বিদেশি ট্যুরিস্টদের জন্য সরকারের নীতিগত গুরুত্ব অনেকটাই কমে গেছে। সর্বশেষ বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবেই মন্তব্য করেছেন যে ব্যক্তিগতভাবে তিনি মনে করেন— আগে দেশীয় পর্যটনকে উৎসাহিত করাই তার লক্ষ্য। ফলে ট্যুরিজমের তিনটি প্রধান ক্যাটাগরি— ইনবাউন্ড, আউটবাউন্ড ও ডোমেস্টিক— এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ পর্যটনই মন্ত্রণালয়ে গুরুত্ব পাবে।

কিন্তু ট্যুরিজমের স্টেকহোল্ডাররা ভিন্ন কথা বলেন। এ নিয়ে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড তথা পর্যটন মন্ত্রণালয়কে আরো গভীরভাবে ভাবতে হবে। পর্যটন খাতের জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কথা আগেই উল্লেখ করেছি। বিগত সরকারের সময় করা সেই মাস্টারপ্ল্যানটি কি যাচাই-বাছাই বা সংশোধন করে গ্রহণযোগ্য করে তোলা হবে, নাকি তা আর আলোর মুখ দেখবে না— সেই প্রশ্নের জবাব কে দেবে?
দেশীয় পর্যটকদের গুরুত্ব দিলেও যেখানে সেন্টমার্টিন ও সুন্দরবন নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তে খুশি নন পর্যটনখাতের বেসরকারি উদ্যোক্তারা, যদিও দেশে পর্যটনের বিকাশে বেসরকারি খাতের অবদানই বেশি। ফলে শুধু পর্যটন দিবস এলেই নড়ে চড়ে বসা নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি সঠিক পরিকল্পনা ছাড়া যে “ক্রিয়েটিভ ডলার ইকোনমি”-র বিকাশ তথা পর্যটন জাতীয় অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত অবদান রাখতে পারবে না— তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এখন তো আরো বড় প্রশ্ন— এসব কি অন্তর্বর্তী সরকার করবে, নাকি তা ঝুলে থাকবে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য? আপাতত দিনে হলেও সেন্টমার্টিন যে উন্মুক্ত হচ্ছে নভেম্বর থেকে— তা নিয়েই খুশি থাকি। মনে রাখতে হবে, সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পর্যটনের যে মৌসুম এবছর তা কেটে যাবে হয়তো নির্বাচনের ডামাডোলে। আমরা না হয় ভোটের পরই ভাববো আগামী বিশ্ব পর্যটন দিবসের সময়— কী বলেন ভ্রমণপ্রিয় মানুষ আর বেসরকারি খাতের ট্যুর অপারেটররা?
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















