গ্রিন কার্ডের প্রতিশ্রুতি থেকে কঠোর পদক্ষেপ
গত বছর নির্বাচনী প্রচারে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, “কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করলেই ডিগ্রির সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রিন কার্ড দেওয়া উচিত।” কিন্তু প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তিনি উল্টো পথে হাঁটলেন। ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি প্রস্তাব দিলেন, নতুন এইচ-১বি ভিসার আবেদনকারীদের ১ লাখ ডলার দিতে হবে। এইচ-১বি ভিসা মূলত প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো ব্যবহার করে বিদেশি স্নাতক নিয়োগে। প্রতিবছর লটারির মাধ্যমে ৮৫ হাজার ভিসা দেওয়া হয়, যেখানে চাহিদা অনেক বেশি। এতদিন পর্যন্ত এর জন্য আইনগত ও প্রশাসনিক খরচ মিলিয়ে প্রায় আড়াই হাজার ডলার লাগত।
কারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত
বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো এই ভিসার প্রধান ব্যবহারকারী। কেবল অ্যামাজনই ২০২৫ সালে ১৪ হাজারের বেশি অনুমোদন পেয়েছে। ভারতের আইটি কোম্পানি যেমন ইনফোসিস ও টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেসও নিয়মিত শীর্ষ তালিকায় থাকে। ২০২৩ সালে মোট ভিসার প্রায় তিন-চতুর্থাংশই পেয়েছে ভারতীয় নাগরিকরা। চীন পেয়েছে ১২ শতাংশ, অন্য কোনো দেশ ২ শতাংশের বেশি পায়নি। অনেক আমেরিকান ভোটার অভিযোগ করেন, এতে দেশীয় চাকরি হারিয়ে যাচ্ছে ভারতীয়দের হাতে। কিন্তু নতুন ফি-এর প্রভাব আরও জটিল হতে পারে।
অনিশ্চয়তায় কর্মীরা
ঘোষণার পরপরই মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো তাদের এইচ-১বি ভিসাধারী কর্মীদের বিদেশে না যেতে পরামর্শ দিয়েছে, কারণ নিয়মে কোনো ছাড় দেওয়া হবে কিনা তা এখনো স্পষ্ট নয়। ভারত এ ঘোষণার ধাক্কা সবচেয়ে বেশি অনুভব করছে। এর আগেই ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছিলেন। এবার আঘাত করলেন দেশের সবচেয়ে সফল খাতে। গোল্ডম্যান স্যাক্সের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০২৩ সালে ভারতের সেবা খাতের রপ্তানি ৫৩ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৩৩৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এই প্রবৃদ্ধির বড় কারণ ছিল আইটি খাতে প্রচুর প্রকৌশলী, যাদের আমেরিকায় পাঠানো হতো এইচ-১বি ভিসায়। দীর্ঘদিন ধরে এটি ভারতীয়দের জন্য উচ্চ বেতনের চাকরির পথ ছিল, যা এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
ভারতের আইটি খাতের সংকট
ভারতের আইটি খাতে ৫০ লাখের বেশি মানুষ কাজ করে। নতুন ভিসা ফি তাদের জন্য বাড়তি চাপ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) উত্থান। জেনারেটিভ এআই অনেক কাজ কমিয়ে দিচ্ছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান গার্টনারের মতে, ২০২৯ সালের মধ্যে ব্যবসায়িক অ্যাপ্লিকেশনের অর্ধেকের বেশি ব্যবহার এআই দ্বারা স্বয়ংক্রিয় হয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই কিছু কোম্পানি কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছে। জুলাইয়ে টিসিএস ১২ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দেয়, যা তাদের মোট কর্মীর ২ শতাংশ।
অভিযোজনের চেষ্টা
তবে এবার ভারতীয় কোম্পানিগুলো আগের তুলনায় ভালোভাবে প্রস্তুত। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ভিসা যাচাই কঠোর হয়েছিল, আর ভারতীয় কোম্পানির ভিসা প্রত্যাখ্যানের হার চার গুণ বেড়ে গিয়েছিল। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান স্থানীয় কর্মী নিয়োগ শুরু করে এবং বিদেশে কাজ সরিয়ে নেয়। এখন ইনফোসিসের মাত্র ৮ শতাংশ কর্মী আমেরিকায় কাজ করে। ২০১৮ সালের পর থেকে তাদের ৯০ শতাংশের বেশি নিয়োগ স্থানীয়। বিনিয়োগকারীরাও তুলনামূলক শান্ত। খবর ঘোষণার পর ২২ সেপ্টেম্বর “নিফটি আইটি সূচক” মাত্র ৩ শতাংশ কমে।
নতুন সুযোগের কেন্দ্র
ভারতের প্রযুক্তি কর্মীদের জন্য আউটসোর্সিং কোম্পানির বাইরেও সুযোগ রয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এখন দেশে “গ্লোবাল ক্যাপাবিলিটি সেন্টার” (জিসিসি) গড়ে তুলছে, যেখানে ডেটা বিশ্লেষণ থেকে গবেষণা পর্যন্ত নানা কাজ হচ্ছে। আমেরিকার ওষুধ কোম্পানি ইলাই লিলি ও ব্রিটিশ ইঞ্জিন প্রস্তুতকারী রোলস-রয়েস-সহ বহু প্রতিষ্ঠান এসব কেন্দ্র ব্যবহার করছে। ন্যাসকমের হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ সালে যেখানে এমন কেন্দ্র ছিল ৭০০টি, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭০০-র বেশি। এগুলো থেকে ৬৪ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে এবং প্রায় ১৯ লাখ মানুষ কাজ করছে।
বহুজাতিকদের সুবিধা
নতুন ভিসা ফি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে ভারতে আরও কার্যক্রম সরাতে উৎসাহিত করতে পারে। যদিও ট্রাম্পের সমর্থকদের একটি অংশ অফশোরিং কমানোর পক্ষপাতী, বাস্তবে এর ফলে ভারতের মতো দেশ লাভবান হতে পারে। ওয়ার্টন স্কুলের গবেষক ব্রিটা গ্লেনন এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, ২০০৪ সালে অনুরূপ সীমাবদ্ধতার পর যেসব প্রতিষ্ঠান এইচ-১বির ওপর বেশি নির্ভরশীল ছিল তারা বিদেশে প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি কর্মসংস্থান তৈরি করেছিল। প্রথমেই গবেষণা ও উন্নয়ন খাত স্থানান্তরিত হয়। সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী দেশগুলো হলো কানাডা, চীন ও ভারত।