পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খাজা আসিফ বলেছেন, সম্প্রতি স্বাক্ষরিত পাক–সৌদি প্রতিরক্ষা চুক্তি দুই দেশের এমন এক সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকতা এনেছে, যা আগে কিছুটা লেনদেনভিত্তিক ছিল।
জেটেও–র সাংবাদিক মেহদি হাসানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি পেওয়ালের আড়ালে থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি পাঁচ মিনিটের একটি প্রিভিউ ও কয়েকটি ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করেছে।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর রিয়াদে প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ও সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান একটি “কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি” স্বাক্ষর করেন। এতে বলা হয়, যে কোনো এক দেশের ওপর আক্রমণকে উভয় দেশের ওপর আগ্রাসন হিসেবে গণ্য করা হবে।
এই সমঝোতার সময়কাল—যা ইসরায়েলের কাতার আক্রমণের পর আরব শীর্ষ সম্মেলনে সমষ্টিগত নিরাপত্তার দিকে ঝোঁকের সংকেতের ঠিক পরপরই—ইঙ্গিত দেয় যে এটি চলমান বিশ্বপরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে এবং উভয় দেশের প্রতিরক্ষা উদ্বেগের প্রতিফলন ঘটিয়েছে। এর আগে, এ বছরের মে মাসে ভারত–পাকিস্তানের এক প্রাণঘাতী সংঘাত এবং জুনে ইরান–ইসরায়েলের ১২ দিনের যুদ্ধের পর কয়েক মাসের মধ্যেই এই চুক্তি হয়।
এর আগে আসিফ ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, নতুন কাঠামোর আওতায় পাকিস্তানের পারমাণবিক সক্ষমতা রিয়াদকে “উপলব্ধ” করানো হতে পারে। তবে পরবর্তী এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, পারমাণবিক অস্ত্র চুক্তির অংশ নয়; এটি “রাডারে নেই”।
শুক্রবার রাতের প্রিভিউতে হাসান প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন করেন।
“কাতারে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে এটা কতটা এসেছে?”—প্রশ্ন হাসানের।
আসিফ উত্তর দেন, “কাতারে যা ঘটেছে তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এটা নয়, কারণ চুক্তিটি অনেক দিন ধরে আলোচনা হচ্ছিল। তাই এটা প্রতিক্রিয়া নয়; হয়তো ঘটনাটা প্রক্রিয়াকে কিছুটা ত্বরান্বিত করেছে, কিন্তু এটুকুই। চুক্তিটি আগেই প্রক্রিয়াধীন ছিল।”
হাসান এরপর উল্লেখ করেন, মুসলিম বিশ্বে একমাত্র পারমাণবিক শক্তি পাকিস্তান; সৌদি আরব দ্বিতীয় হতে আগ্রহ দেখিয়েছে। তিনি আরও মনে করিয়ে দেন, আসিফ আগে বলেছেন এই চুক্তিতে পারমাণবিক অস্ত্র “রাডারে নেই”।
“তাহলে এই চুক্তি অনুযায়ী সৌদি আরব কি পাকিস্তানের ‘পারমাণবিক ছাতার’ সুরক্ষায় আছে, না নেই?”—জানতে চান তিনি।
আসিফ বলেন, “সৌদি আরবের সঙ্গে আমাদের বহু পুরোনো প্রতিরক্ষা সম্পর্ক রয়েছে, পাঁচ–ছয় দশকজুড়ে। আমরা সেখানে সামরিক উপস্থিতি রেখেছি—শীর্ষসময়ে সম্ভবত চার–পাঁচ হাজার সদস্য—এবং এখনো আছে। আমার মনে হয়, আমরা সেই সম্পর্কটিকেই আনুষ্ঠানিক রূপ দিয়েছি, যা আগে কিছুটা লেনদেনভিত্তিক ছিল।”
“নিউক ছাড়া, না কি নিউকসহ আনুষ্ঠানিকতা?”—হাসানের প্রশ্ন।
মন্ত্রী বিস্তারিত বলতে অনীহা প্রকাশ করেন। “আমি বিস্তারিত আর বলব না। এটা একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি, আর প্রতিরক্ষা চুক্তি সাধারণত জনসমক্ষে খোলাখুলি আলোচনা করা হয় না,”—বলেন তিনি।
হাসান পরে উল্লেখ করেন, সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘ওয়ার’ বইয়ে লিখেছেন, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এক মার্কিন সেনেটরকে বলেছিলেন, তিনি পাকিস্তান থেকে “বোমা কিনেই ফেলতে পারেন”।
আসিফের জবাব, “আমার কাছে এটা মাত্রাতিরিক্ত চাঞ্চল্যসৃষ্টি করার চেষ্টা… না, আমি ওই উদ্ধৃতিটি বিশ্বাস করি না।”
“তাহলে আপনারা সৌদি আরবকে পারমাণবিক অস্ত্র বিক্রি করার ব্যবসায় নেই?”—হাসানের প্রশ্ন।
আসিফ বলেন, “না। আমরা খুব দায়িত্বশীল।”
পাক–চীন সম্পর্ক
ইনস্টাগ্রামে প্রকাশিত পৃথক এক ভিডিওতে হাসান জানতে চান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের বর্তমান ঘনিষ্ঠতা কি চীনের মতো ‘জীবনরেখা’–সদৃশ সম্পর্ককে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে?
“অবশ্যই, আমেরিকা ও চীনের মধ্যে এখন বিরোধ,”—বললেন তিনি।
আসিফ জবাব দেন, “না, আমরা এ নিয়ে চিন্তিত নই। কারণ চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটি পঞ্চাশের দশকের শেষভাগ থেকে সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ।”
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠতা বাড়ানো’ প্রসঙ্গে আরও প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে চীন উদ্বিগ্ন নয়।”
হাসান বলেন, “আপনাদের কৌশলগত ভবিষ্যৎ চীনের সঙ্গে, না যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে? দুটোই একসঙ্গে সম্ভব নয়।”
মন্ত্রী জবাবে বলেন, পাকিস্তানের জন্য চীন “খুব নির্ভরযোগ্য মিত্র”।
তিনি যোগ করেন, “আমাদের অস্ত্রের বড় একটি অংশই চীন থেকে আসে। আর আমাদের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ছে—আগের চেয়ে অনেক বেশি বলিষ্ঠ। যুক্তরাষ্ট্রের মতো অন্যান্য উৎসের অনিশ্চয়তার কারণেই এটি হয়েছে।”
হাসান প্রশ্ন তোলেন, “অর্থাৎ আপনি মূলত বলছেন, আপনাদের কৌশলগত ভবিষ্যৎ যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীনের সঙ্গেই?”
আসিফের উত্তর, “হ্যাঁ… তারা নির্ভরযোগ্য, আর তারা আমাদের প্রতিবেশী। আমাদের সীমান্ত ও ভৌগোলিক সংযোগ রয়েছে।”
ইমরান খানের গ্রেপ্তার
ইনস্টাগ্রামে প্রকাশিত আরেকটি ক্লিপে হাসান কারাবন্দি পিটিআই প্রতিষ্ঠাতা ইমরান খানকে নিয়ে প্রশ্ন তোলেন—কেন তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে?
“এটাই পাকিস্তানের সমস্যা: আপনারা ক্ষমতায় এলেই একে অপরকে জেলে পাঠান… আপনার সঙ্গে যদি এটা অন্যায় হয়ে থাকে, ইমরানের সঙ্গেও কি তা অন্যায় নয়?”—জানতে চান তিনি।
মন্ত্রী বলেন, এটি কোনো পাল্টা প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নয়।
তবে হাসান উল্লেখ করেন, ইমরানের গ্রেপ্তার নিয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একটি প্রতিবেদন দিয়েছে এবং জাতিসংঘের একটি দল বলেছে—ইমরানের কারাবাসের কোনো আইনগত ভিত্তি নেই; একে ইচ্ছামূলক আটক বলা যায়।
আসিফের জবাব, “আমার মনে হয়, এটাই তাদের মতামত, যার সঙ্গে আমি একমত নই।”
হাসান বলেন, “তাদের মত হলো, আপনারা আইনের লঙ্ঘন করছেন।”
আসিফের জবাব, “না, আমরা আইন ভাঙছি না।”
তিনি আরও বলেন, “পাকিস্তানে আমরা সাড়ে তিন বছরের এক ভয়াবহ—কুশাসন, মন্দ শাসন, যাই বলুন না কেন—অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছি।” তার দাবি, ইমরানের আমলে “বহু পরিবারের সকলে ” গ্রেপ্তার হয়েছিল।