মানবসভ্যতার ইতিহাস শুধু যুদ্ধ-বিগ্রহ বা রাজ্য বিস্তারের গল্প নয়, শিল্পকলাও এর অবিচ্ছেদ্য অংশ। ধর্মীয় ভাস্কর্য ও প্রতিমা একদিকে ভক্তির প্রতীক, অন্যদিকে তা যুগে যুগে মানুষের কল্পনা, সংস্কৃতি ও জীবনবোধের বহিঃপ্রকাশ। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে চলমান Ancient India: Living Traditions প্রদর্শনী সেই অতীতের সঙ্গে বর্তমানকে যুক্ত করেছে। এখানে প্রাচীন যক্ষ মূর্তি থেকে শুরু করে গণেশ ও গজা লক্ষ্মীর প্রতিমা পর্যন্ত নানা নিদর্শন তুলে ধরা হয়েছে, যা শুধু ধর্মীয় বিশ্বাস নয়, বরং শিল্পকলার ধারাবাহিকতা ও সংস্কৃতির স্থায়িত্বকেও সামনে আনে।
প্রাচীন ভাস্কর্য থেকে আধুনিক দেবতা
হিন্দু, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের পবিত্র শিল্পকলা শুধু ভক্তির মাধ্যম নয়, বরং দেবদেবীর উৎপত্তি ও বিকাশের গল্পও বলে। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে বর্তমানে চলমান প্রদর্শনী Ancient India: Living Traditions এই পরিবর্তন ও স্থায়িত্বকে একসঙ্গে উপস্থাপন করছে। এখানে প্রায় ১৮০টি প্রদর্শনী সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে ২ হাজার বছরের পুরনো একটি যক্ষ মূর্তি, যা হিন্দু, জৈন ও বৌদ্ধ দেব-দেবীর প্রাচীনতম রূপগুলোর মধ্যে অন্যতম বলে ধরা হয়।
যক্ষ ও যক্ষিণীরা প্রকৃতির আত্মা হিসেবে নদী, পাহাড়, বনভূমি কিংবা ভূগর্ভস্থ সম্পদের প্রতীক ছিলেন। প্রাচীনকালে এদের মাটির প্রতিমা গৃহস্থালির জন্য তৈরি হতো। দারিদ্র্য, রোগব্যাধি কিংবা বন্ধ্যাত্ব দূর করার আশায় এদের পূজা করা হতো। অলঙ্কৃত ও ভুঁড়িওলা এসব প্রতিমা সে সময়ের সমৃদ্ধি ও জীবিকার প্রতীক ছিল।

গণেশের আবির্ভাব
ঐতিহাসিক সুশমা জানসারির মতে, খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে শিল্পীরা যক্ষ-যক্ষিণী ও নাগদেবতার প্রতিমা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বুদ্ধ ও হিন্দু দেবতাদের মূর্তি গড়তে শুরু করেন। পঞ্চম শতক থেকে গণেশের ধারণা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
প্রথমদিকে যক্ষদের পশুমুখের পরিবর্তে শিবপুত্র গণেশের জন্য এশীয় হাতির মাথা ব্যবহার করা হয়। সিন্ধু সভ্যতা থেকেই হাতি মানুষের কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছিল। হরপ্পায় লাল-সাদা দাগওয়ালা হাতির মূর্তি আবিষ্কার এ প্রমাণ বহন করে।
তিন ধর্মের মিলন
জানসারি মনে করিয়ে দেন, শিল্পকলার উৎসে গেলে দেখা যায় হিন্দু, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। যেমন, লক্ষ্মী হিন্দুদের প্রধান দেবী হলেও কিছু জৈন ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ও তাঁকে পূজা করত।
চীনের পশ্চিমাঞ্চলের ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের গুহাগুলোতেও গণেশের চিত্র পাওয়া গেছে। সেখানে তাঁকে ভাঙা দাঁত, হাতে মিষ্টি, কখনো শিবের বাঘের চামড়াসহ, আবার অনেক সময় বুদ্ধের পাশে দেখা যায়।

গজা লক্ষ্মীর প্রাচীনতম ছবি
প্রদর্শনীতে চিত্রিত গজা লক্ষ্মীর একটি প্রতীক বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ জাদুঘর থেকে ধার নেওয়া এই মূর্তিটি ২,২০০ বছরের পুরনো একটি বৌদ্ধ গুহা থেকে আবিষ্কৃত। এটি বৌদ্ধ প্রেক্ষাপটে গজা লক্ষ্মীর প্রাচীনতম চিত্রায়ন। শিল্পীরা এখানে শুধু দেবীর বৈশিষ্ট্য নয়, বরং প্রাচুর্যের প্রতীকী রূপও ফুটিয়ে তুলেছেন।
সময়ের সঙ্গে রূপান্তর
আজকের দিনে দেব-দেবীদের চিত্রায়ন কিছুটা ভিন্ন হলেও তাদের মূল বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তিত। উদাহরণস্বরূপ, ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামের সংগ্রহে থাকা পার্শ্বনাথের একটি প্রাচীন মূর্তিতে তাঁকে ধ্যানরত দেখা যায়, তবে চারপাশে সেবক ও দেবলোকের প্রতিমা যুক্ত করা হয়েছে।
আধুনিক কালের কারিগরেরা কখনো ছোট গণেশ প্রতিমার হাতে গিটার বা মোবাইল ফোন ধরিয়ে দেন। তবু তাঁর ভুঁড়ি, শুঁড় ও মিষ্টি সবসময় একইভাবে চেনা যায়।
দেবতার চিরস্থায়ী বৈশিষ্ট্য
জানসারি বলেন, “আপনি সবসময় বুঝতে পারবেন, এটা বুদ্ধ কারণ তাঁর মাথার বিশেষ উঁচু অংশ আছে। এই দেব-দেবীরা আমাদের জীবনে যে অর্থ বহন করেন, তা কখনো বদলায় না।”

এইভাবে শিল্পকলার ধারাবাহিকতা শুধু ধর্মীয় নয়, বরং সংস্কৃতিরও স্থায়িত্বের সাক্ষী হয়ে থাকে।
প্রাচীন যক্ষ থেকে আধুনিক গণেশ কিংবা গজা লক্ষ্মী—এই সব প্রতিমা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানুষের আধ্যাত্মিকতা ও শিল্পচর্চা আসলে এক অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা। সময় পাল্টেছে, সভ্যতা বদলেছে, তবু দেব-দেবীর প্রতীকী রূপ আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে। আজকের দিনে গণেশের হাতে গিটার কিংবা মোবাইল দেখা গেলেও তাঁর ভুঁড়ি ও শুঁড় আমাদের কাছে একইভাবে পরিচিত থাকে। শিল্পকলার এই যাত্রা তাই কেবল অতীতের স্মারক নয়, বরং বর্তমান ও ভবিষ্যতের সঙ্গে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের চিরন্তন প্রমাণ।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















