সবুজ অ্যানাকোন্ডা (Green Anaconda) পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাপগুলোর মধ্যে একটি এবং দৈর্ঘ্য ও ওজনের দিক থেকে একে অনেক সময় “বিশ্বের সবচেয়ে ভারী সাপ” বলা হয়। এরা মূলত দক্ষিণ আমেরিকার নদী ও জলাভূমিতে বসবাস করে। বৈজ্ঞানিক নাম Eunectes murinus। বোয়া পরিবারের (Boidae) অন্তর্ভুক্ত এই সাপ শক্তি, আকার, শিকার করার কৌশল ও পরিবেশগত ভূমিকার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত।
দেহের গঠন ও আকার
সবুজ অ্যানাকোন্ডা গড়ে ৫ থেকে ৬ মিটার লম্বা হয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে ৯ মিটার পর্যন্তও পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হয়। ওজন প্রায় ২০০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। এদের দেহ মোটা, শক্তিশালী এবং জলকেন্দ্রিক জীবনের জন্য অভিযোজিত। শরীরের গায়ের রঙ সাধারণত জলপাই সবুজ, যার ওপর কালো ডোরা বা দাগ থাকে। চোখ ও নাকের ছিদ্র মাথার ওপরের দিকে থাকে, যাতে পানির নিচে থেকেও উপরের দিকে তাকিয়ে নিশ্বাস নিতে পারে।
আবাসস্থল
সবুজ অ্যানাকোন্ডা প্রধানত অ্যামাজন নদী অববাহিকা, অরিনোকো নদী ও দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য জলাভূমি, হ্রদ, ও বৃষ্টিবনে পাওয়া যায়। এরা পানিপ্রিয় প্রাণী, এবং জীবনের অধিকাংশ সময় কাদামাটি, জলাশয় বা ঘন নদীর তীরে কাটায়।

খাদ্যাভ্যাস
সবুজ অ্যানাকোন্ডা মাংসাশী এবং এদের খাদ্যের তালিকা অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। এরা মাছ, পাখি, ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকে শুরু করে হরিণ, কেপিবারা, কুমির এমনকি জাগুয়ার শিকার করতেও সক্ষম। এরা চেপে ধরে (constriction method) শিকারকে মেরে ফেলে এবং পরে একেবারে গিলে ফেলে। বড় শিকার খেলে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত খাবারের প্রয়োজন হয় না।
প্রজনন
সবুজ অ্যানাকোন্ডা ডিম পাড়ে না, বরং ডিম থেকে সরাসরি জীবন্ত বাচ্চা প্রসব করে (Ovoviviparous)। প্রজনন মৌসুমে একে ঘিরে “ব্রিডিং বল” তৈরি হয়, যেখানে একাধিক পুরুষ একটি স্ত্রী অ্যানাকোন্ডাকে ঘিরে মিলনের চেষ্টা করে। স্ত্রী সাপ সাধারণত ২০–৪০টি বাচ্চা দেয়, তবে কখনো কখনো ১০০টিরও বেশি বাচ্চা জন্মাতে পারে।

আচরণ ও জীবনধারা
অ্যানাকোন্ডা সাধারণত রাতে সক্রিয় হয় (nocturnal) এবং পানিতে সাঁতার কাটতে বেশ দক্ষ। এরা ধীরগতির হলেও পানিতে চুপিসারে চলাফেরা করে। শিকার ধরার সময় এরা দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে থাকে। মানুষের ওপর আক্রমণের ঘটনা খুবই বিরল, তবে স্থানীয় লোককথা ও গল্পে একে ভয়ংকর দানব হিসেবে তুলে ধরা হয়।
মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক
অ্যানাকোন্ডা নিয়ে অনেক কুসংস্কার ও অতিরঞ্জিত গল্প প্রচলিত আছে। স্থানীয়রা মাঝে মাঝে সাপের চামড়া বা শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবহার করে, আবার কেউ কেউ ভয় পেয়ে হত্যা করে। তবে বাস্তবে এই সাপ মানুষের জন্য তেমন হুমকি নয়। বরং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পরিবেশগত গুরুত্ব
সবুজ অ্যানাকোন্ডা জলাভূমি ও নদী অঞ্চলের বাস্তুসংস্থানে শীর্ষ শিকারি হিসেবে ভূমিকা রাখে। এটি বিভিন্ন প্রজাতির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে এবং খাদ্যচক্রে ভারসাম্য বজায় রাখে।
![]()
সংরক্ষণ অবস্থা
বর্তমানে সবুজ অ্যানাকোন্ডা বিপন্ন তালিকায় নেই। তবে বন উজাড়, নদী ও জলাভূমি ধ্বংস এবং মানুষের ভয় থেকে হত্যার কারণে এদের অস্তিত্ব কিছু অঞ্চলে হুমকির মুখে পড়ছে।
সবুজ অ্যানাকোন্ডা শুধু পৃথিবীর বৃহত্তম সাপই নয়, বরং প্রাকৃতিক ভারসাম্যের এক অপরিহার্য অংশ। এর শক্তি, বিশালতা ও রহস্যময় আচরণ একে বিশ্বজুড়ে আলোচনার বিষয় করেছে। মানুষের উচিত ভীতি নয়, বরং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই অনন্য প্রাণীকে বোঝা ও সংরক্ষণ করা।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















