গ্রে সাহেবের পরে ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে স্যর জর্জ কাম্বেল সাহেব বাংলার লেপ্টনান্ট গবর্ণর হন। তিনি উচ্চ শিক্ষার বিরোধী ছিলেন, কিন্তু নিম্ন-শিক্ষার অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন। তাহারই সময়ে বাংলায় নিম্ন-শিক্ষার যুগান্তর উপস্থিত হয়। তিনি বাংলায় নিম্ন-শিক্ষার একটি নূতন সংশোধিত নিয়ম প্রচলিত করেন এবং গ্রামে গ্রামে নিম্ন-শিক্ষা বিস্তারের জন্য প্রত্যেক জেলায় যথেষ্ট টাকা মঞ্জুর করেন। পাঠশালার সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সব ইনস্পেক্টরের নূতন পদেরও সৃষ্টি হইল। “ভূদেব পাঠশালার” মাসিক ৫ টাকা সাহায্য দিবার নিয়ম ছিল। কিন্তু “স্যর জর্জ কাম্বেল পাঠশালার” ১।।০ টাকা হইতে ৫ টাকা পর্যন্ত সাহায্য দিবার নিয়ম নির্ধারিত হয়। ১৮৭১-৭২ খ্রিস্টাব্দে স্কুল ২৫৭ এবং তাহাতে ছাত্র ৬৬৪৬; এবং ১৮৭২-৭৩ খ্রিস্টাব্দে স্কুল ২৬৪ এবং তাহাতে ছাত্র ৮৭০৪ জন অধ্যয়ন করিত। ২৬৪ স্কুল মধ্যে ২২৫ পাঠশালা। ৬ বৎসরে ৬২টি হইতে রাজসাহীতে ২২৫ পাঠশালা হয়। ঐ সময়ে গুরুমহাশয়দের উপযোগিতারও বিচার রহিল না। এই নূতন নিয়মে রাজসাহীতে পাঠশালার সংখ্যা বৃদ্ধি হইল কিন্তু প্রত্যেক পাঠশালার ছাত্র সংখ্যা পূর্বাপেক্ষা কমিয়া গেল এবং গুরুমহাশয়দের উপযোগিতারও হ্রাস হইল। এইরূপ অবস্থা কম বেশি সকল জেলারই হইল। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে স্যর রিচার্ড টেম্পল সাহেব বাংলার লেপ্টনান্ট গবর্ণর হন। তাহার সময়েই এই অনুপযুক্ত গুরুমহাশয়দের শিক্ষার জন্য প্রত্যেক জেলায় ট্রেনিং স্কুল স্থাপিত হয় এবং পাঠশালার জন্য উচ্চপ্রাইমারী পরীক্ষা দিবার নিয়ম প্রচলিত হয়। নিম্ন প্রাইমারী পরীক্ষা ইহার পূর্বেই প্রচলিত হয়। ৫ টাকার পাঠশালা হইতে উচ্চপ্রাইমারী এবং ৩ টাকার পাঠশাল হইতে নিম্ন প্রাইমারী পরীক্ষা দিবার নিয়ম প্রচলিত হইল। ৫ টাকার পাঠশালাকে “ডি পাঠশালা” অথবা ‘ইন্টর মিডিএট” স্কুল বলিয়া পরিচিত হয়। এক্ষণে প্রাথমিক শিক্ষা দুই ভাগে বিভক্ত যথা-(১) উচ্চপ্রাথমিক, (২) নিম্নপ্রাথমিক। রাজসাহীর মধ্যে নাটোর বিভাগে “ডি পাঠশালা” অথবা “ইনমিডিএট” স্কুলেরই অবস্থা উন্নত হয়। এ জেলায় “৩ টাকার পাঠশালা” অর্থাৎ নিম্নপ্রাথমিক স্কুলের শিক্ষা উচ্চ প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার ন্যায় উন্নত ছিল না। এইরূপে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দ হইতে ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার ভার জেলার ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের প্রতি অর্পিত ছিল। তিন বৎসরে এ জেলায় স্কুলের সংখ্যা ও ছাত্র সংখ্যা যেরূপ ছিল তাহা নিম্নে দেখান গেল-

বোর্ডের আদেশমত জেলার মধ্য ও প্রাথমিক শিক্ষাকার্য নির্বাহিত হইতে লাগিল। জেলার “পুরস্কার প্রথা” রহিত করা এবং “বৃত্তি প্রথা” প্রচলিত করা গবর্ণমেন্টের নিয়মের বহির্ভূত বলিয়া, পুনরায় এক বৎসর পরেই “পুরস্কার প্রথা” প্রচলিত হইল এবং উচ্চ প্রাথমিক পাঠশালার “বৃত্তি প্রথাই” রহিল। “পুরস্কার প্রথা” প্রচলিত হওয়ায় আবার স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধি হইল। ১৮৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে রাজসাহী জেলার স্কুল ৬১২ এবং ছাত্র সংখ্যা ১৯৭২৪। মোট ৬১২ স্কুলের মধ্যে ৫৬৫টি পাঠশালা। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দ হইতে এই ৬৫ বৎসরে স্কুলের সংখ্যা যেরূপ বৃদ্ধি হইয়াছে, তাহা পূর্ব লিখিত বিবরণ পাঠেই জানা যাইবে।
রাজসাহী জেলা অপেক্ষা বর্ধমান, হুগলি প্রভৃতি জেলায় প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা অনেক বেশি এবং দেশীয় শিক্ষা অনেক ভালরূপে হয়; কিন্তু বর্ধমান, হুগলি প্রভৃতি জেলা অপেক্ষা রাজসাহীর অনেক নিম্ন প্রাথমিক পাঠশালায় ইউরোপীয় প্রণালীর শিক্ষা উৎকৃষ্ট হয়। এ বিভিন্নতার কারণ এই যে রাজসাহীতে যে সকল গুরুমহাশয় দেখা যায়, তাহাদের অধিকাংশ ইউরোপীয় প্রণালীর স্কুলের ছাত্র এবং দেশীয় মতের শিক্ষায় নিতান্ত অনভিজ্ঞ। পুরাতন গুরুমহাশয় ইউরোপীয় প্রণালীতে শিক্ষিত হইলে বা ইউরোপীয় প্রণালীর স্কুলের ছাত্রেরা দেশীয় প্রণালী মতে রীতিমত শিক্ষিত হইলে বঙ্গদেশের উপযুক্ত গুরুমহাশয় হইতে পারে। দেশীয় প্রণালীতে উত্তমরূপ শিক্ষা দিতে না পারিলে প্রকৃত কৃষকদের পাঠশালায় সন্তান পাঠাইতে অগ্রসর হইতে দেখা যায় না। কৃষকদের প্রয়োজনমত পাঠশালায় শিক্ষাপ্রদান করিলে প্রাথমিক স্কুলের যথেষ্ট উন্নতি হইবে তাহার আর সন্দেহ নাই।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















