প্রতিভার অপচয়ের কাহিনি
বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সাফল্যের মূল রহস্য হলো উদ্ভাবন। আর উদ্ভাবনের ভিত্তি হলো সৃষ্টিশীলতা, মেধা আর প্রতিভাবানদের দৃঢ়তা। সরকারগুলো অর্থনীতিকে চাঙা করতে নানা প্রকল্পে টাকা ঢাললেও—চিপ কারখানা বা খনিজ আহরণে—প্রকৃত প্রতিভাকে অবহেলা করা হচ্ছে। ফলে মানব সম্ভাবনার ভয়াবহ অপচয় ঘটছে।
প্রতিভার বাজারে উষ্ণ প্রতিযোগিতা
আজকের দিনে প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ব্যক্তিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-এর দৌড়ে আমেরিকার প্রযুক্তি জায়ান্টরা কয়েকজন সেরা ডেটা সায়েন্টিস্ট নিয়ে দল গড়ছে। ওয়াল স্ট্রিটে হেজ ফান্ডগুলো লাখো ডলারে শীর্ষ ট্রেডার দখলে নিচ্ছে। গবেষণায়ও দেখা যায়, শীর্ষ ১% বিজ্ঞানী মোট উদ্ধৃতির এক-পঞ্চমাংশ তৈরি করেন। চীনে বিদেশ-ফেরত বিজ্ঞানীদের জাতীয় নায়ক বানানো হচ্ছে।
এই প্রতিভাবানদের আয় আকাশছোঁয়া। অনেক তরুণ প্রোগ্রামার সাত থেকে নয় অঙ্কের বেতন পাচ্ছেন। স্পটিফাইয়ে বছরে ১ কোটি ডলারের বেশি আয়কারী শিল্পীর সংখ্যা ২০১৭ সালের পর তিন গুণ বেড়েছে। আইনজীবীদের মধ্যেও বড় আয় এখন শীর্ষ স্তরের কয়েকজনের হাতে চলে যাচ্ছে। ডিজিটাল বিতরণ ও বিশাল কম্পিউটিং ক্ষমতা প্রতিভাবানদের মুনাফা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এআই দৌড়ে জেতার সম্ভাব্য পুরস্কার এত বড় যে কোটি কোটি ডলার বেতনও নগণ্য মনে হয়।

এআই-এর প্রভাব: সুপারস্টারের যুগ
শুধু গবেষণাই নয়, ব্যবসায়ও এআই ব্যক্তিগত প্রতিভার আধিপত্য বাড়িয়ে তুলছে। অনেক স্তরের কর্মীর কাজ এআই এজেন্টরা করে ফেলবে, ফলে ছোট দল নিয়েও কোম্পানি গড়ে তুলতে পারবে মেধাবীরা। এটি সুপারস্টারদের জন্য আশীর্বাদ হলেও সাধারণ মানুষের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বিশ্ব দ্রুত বুড়িয়ে যাচ্ছে। কর্মীর সংখ্যা না বাড়লেও উদ্ভাবনের গতি বজায় রাখতে হবে অর্থনীতিকে সচল রাখতে।
কিন্তু সমস্যা হলো, বিশ্বের বিপুল মেধাশক্তি থাকলেও অল্প সংখ্যক মানুষই তাদের সম্ভাবনা পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারছে। ধনী পরিবার ও পশ্চিমা দেশের ছাত্ররাই গবেষণায় এগিয়ে। দরিদ্র দেশের প্রতিভাবান শিক্ষার্থীরা একই সাফল্য পেলেও গবেষণায় পিছিয়ে থাকে, এবং শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট অর্জনের সম্ভাবনা তাদের অর্ধেক কম। যদি আমেরিকার শ্রেণি, লিঙ্গ ও বর্ণভিত্তিক বৈষম্য দূর করা যেত, তবে উদ্ভাবকের সংখ্যা চারগুণ হতো।
প্রতিভা নষ্টে রাজনীতির ব্যর্থতা
এই অপচয় ঠেকানোর বদলে অনেক সরকার আরও সমস্যার সৃষ্টি করছে। সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো অভিবাসন নীতি। উজ্জ্বল মেধাবীরা যদি বিদেশে পড়াশোনা বা কাজের সুযোগ না পায়, তবে আজকের শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানির অনেক সিইও হয়তো নেতৃত্বে থাকতেন না। অনুমান করা হয়, উজ্জ্বল শিক্ষার্থীদের জন্য আর্থিক বাধা কমানো গেলে ভবিষ্যৎ বৈজ্ঞানিক উৎপাদনশীলতা ৫০% পর্যন্ত বাড়তে পারে। কিন্তু অনেক দেশেই বিশেষ ভিসা কর্মসূচি অর্ধমনোভাবাপন্ন এবং জটিল, কারণ অভিবাসন রাজনীতিতে অজনপ্রিয়।
দেশীয় প্রতিভা চেনার ক্ষেত্রেও অবহেলা আছে। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে সোনা জয়ীরা পরবর্তীতে বড় পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনায় এমআইটির ছাত্রদের চেয়ে ৫০ গুণ এগিয়ে। ওপেনএআইয়ের অর্ধেক প্রতিষ্ঠাতা এই প্রতিযোগিতা থেকে উঠে এসেছেন। কিন্তু বেশিরভাগ দেশে প্রতিভা খুঁজে বের করার সুসংগঠিত উদ্যোগ নেই। ধনী পরিবার ছাড়া অন্যরা নির্ভর করে ভাগ্য ও ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার ওপর।

আমেরিকার ভুল নীতি এবং সুযোগ
অভিবাসনে গড়া আমেরিকা প্রতিভা দখলে এগিয়ে থাকার কথা। কিন্তু বৈচিত্র্য ও সমতার নামে মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি বন্ধ হয়ে যায়। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন সম্প্রতি এইচ-১বি ভিসার ফি বাড়িয়েছে, যার মাধ্যমে গবেষক ও প্রযুক্তিবিদরা আমেরিকায় প্রবেশ করতেন। হার্ভার্ডসহ শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে দমনমূলক নীতি গবেষণা তহবিল ও বিদেশি ছাত্রভর্তি ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।
এটি অন্য দেশগুলোর জন্য সুযোগ তৈরি করছে। চীন তরুণ বিদেশি বিজ্ঞানীদের জন্য ভিসা চালু করছে। ব্রিটেন দক্ষ কর্মীদের জন্য ভিসা ফি বাতিল করতে পারে। ফ্রান্স বিদেশি গবেষকদের আকর্ষণ করতে চাইছে। তবে এসব পদক্ষেপ এখনও অর্ধমনোভাবাপন্ন।
প্রতিভার ঘুমন্ত ভাণ্ডার
বিশ্বের প্রতিভা ভাণ্ডার বিশাল, কিন্তু অল্প ব্যবহৃত। যদি দেশগুলো সময়মতো এই সম্ভাবনা কাজে না লাগায়, তবে মানবসম্পদের ভয়াবহ অপচয় চলতেই থাকবে। আর সেক্ষেত্রে উদ্ভাবনের গতি ধীর হয়ে পড়বে। প্রশ্ন হলো, কবে বিশ্ব এ বাস্তবতা বুঝবে?
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















