০৩:৩৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫

খৈয়া গোখরা: রাজশাহীতে এত সাপ কেন?

সাপের চিকিৎসার নতুন অধ্যায় রাজশাহীতে

রাজশাহীতে সম্প্রতি চালু হয়েছে দেশের অন্যতম আধুনিক সাপের চিকিৎসা কেন্দ্র। দীর্ঘদিন ধরে এ অঞ্চলে বিষধর সাপের কামড়ে মানুষ মারা যাচ্ছিল, কিন্তু উন্নত চিকিৎসা সুবিধা না থাকায় অনেক জীবন ঝরে গেছে। এবার সেই অভাব পূরণে উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ। এখানে সাপের কামড়ের জন্য অ্যান্টিভেনম, প্রশিক্ষিত চিকিৎসক এবং জরুরি সহায়তা নিশ্চিত করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ উদ্যোগ রাজশাহীর মানুষের জীবনে এক নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে। কৃষক, শ্রমজীবী ও গ্রামের সাধারণ মানুষ যারা প্রতিদিন মাঠে-ঘাটে কাজ করেন, তাঁরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন।

খৈয়া গোখরা: পরিচিতি ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

বাংলাদেশে বহু প্রজাতির বিষধর সাপ রয়েছে, তবে খৈয়া গোখরা (Naja kaouthia) সবচেয়ে আলোচিত। এর বৈশিষ্ট্য হলো বাদামি-খয়েরি আভাযুক্ত শরীর এবং ফণার ওপর চশমার মতো দাগ। বাংলায় একে “খৈয়া গোখরা” বলা হলেও ইংরেজিতে এর পরিচিতি “Monocled Cobra”।

এই প্রজাতি সাধারণ গোখরা থেকে কিছুটা আলাদা। সাধারণ গোখরার গায়ে কালচে বা হালকা ধূসর রঙ দেখা গেলেও খৈয়া গোখরার দেহে বাদামি বা খয়েরি রঙ বেশি প্রকট। এর দৈর্ঘ্য সাধারণত ১.২ থেকে ১.৫ মিটার হলেও অনুকূল পরিবেশে ২ মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে।

রাজশাহীর ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট

রাজশাহী বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের একটি কৃষি নির্ভর অঞ্চল। পদ্মা, মহানন্দা ও ছোট বড় অসংখ্য নদী, খাল-বিল এবং ফসলি জমি এ অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য। ধান, আলু, গম, ভুট্টা—এসব ফসলের কারণে জমিতে ইঁদুরের আধিক্য রয়েছে। আর ইঁদুরই হলো খৈয়া গোখরার প্রধান খাদ্য। ফলে প্রাকৃতিকভাবে এ অঞ্চলে সাপের সংখ্যা বেশি।

রাজশাহীতে শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ২৭টি গোখরা সাপ - BBC News বাংলা

গবেষকরা বলছেন, রাজশাহীর মাটির গঠন এবং জলবায়ু সাপের জন্য উপযোগী। বর্ষার সময় সাপেরা বন্যার পানিতে ভেসে গ্রামে চলে আসে, আবার শুষ্ক মৌসুমে জমির ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে থাকে। এভাবে মানুষের বসতি ও সাপের আবাস একে অপরের কাছাকাছি চলে এসেছে।

খৈয়া গোখরার আচরণ

খৈয়া গোখরা সাধারণত নিশাচর প্রাণী। দিনের বেলা এরা গর্তে, ঝোপে বা খড়ের গাদায় লুকিয়ে থাকে। রাতের বেলা খাদ্যের খোঁজে বের হয়। ইঁদুর, ব্যাঙ, ছোট পাখি ও কখনও অন্য সাপও এদের খাদ্যতালিকায় থাকে।

এই সাপ মানুষের সামনে এলে সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণ করে না। প্রথমে ফণা তোলে, ফোঁসফোঁস শব্দ করে ভয় দেখায়। কিন্তু কেউ যদি ভয় পেয়ে কাছে চলে যায় বা আক্রমণ করার চেষ্টা করে, তখন এরা কামড় দেয়। খৈয়া গোখরার বিষ মূলত স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে, ফলে শ্বাসকষ্ট, পক্ষাঘাত এমনকি মৃত্যু ঘটতে পারে।

খৈয়া গোখরা কত লম্বা?

খৈয়া গোখরার দৈর্ঘ্য সাধারণত ১.২ থেকে ১.৫ মিটার পর্যন্ত হয়। তবে উপযুক্ত খাদ্য ও নিরাপদ আবাসস্থলে এরা আরও বড় হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার কিছু অঞ্চলে পূর্ণবয়স্ক খৈয়া গোখরা ২ মিটার বা তারও বেশি লম্বা হয়েছে। বয়স, লিঙ্গ এবং পরিবেশগত উপাদান অনুযায়ী এদের দৈর্ঘ্যে পার্থক্য হয়। সাধারণত স্ত্রী সাপ তুলনামূলকভাবে বড় হয়। এদের দেহের মোটা ও শক্তিশালী গঠন শিকার ধরতে এবং আত্মরক্ষায় সহায়ক।

খৈয়া গোখরা - Wikiwand

রাজশাহীতে সাপের আধিক্য: কারণ বিশ্লেষণ

রাজশাহীতে খৈয়া গোখরার আধিক্যের পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, ধান ও আলুর জমিতে প্রচুর ইঁদুর জন্মায়, যা সাপের প্রধান খাদ্য। দ্বিতীয়ত, নদী, খাল, বিল ও ঝোপঝাড় খৈয়া গোখরার জন্য নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করেছে। তৃতীয়ত, কৃষিজমি ও আবাসিক এলাকা একে অপরের কাছাকাছি চলে আসায় মানুষ-সাপ সংঘাত বেড়েছে। চতুর্থত, গ্রামে খড়ের গাদা, খোলা মাঠ ও অগোছালো গৃহস্থালি পরিবেশ সাপকে আকর্ষণ করে।

বন্যা ও সাপের বৃদ্ধি

রাজশাহীতে সাপের সংখ্যা বৃদ্ধির আরেকটি বড় কারণ হলো বন্যা। বর্ষাকালে পদ্মা ও অন্যান্য নদী ফুলেফেঁপে ওঠে এবং আশপাশের গ্রামাঞ্চল পানিতে ডুবে যায়। এই সময় সাপেরা তাদের স্বাভাবিক গর্ত বা আশ্রয় হারিয়ে ফেলে এবং ভেসে ওঠে মানুষের বসতিতে। পানির নিচ থেকে খাবারের সন্ধানে বের হয়ে এরা মাঠ, ঘরবাড়ি, এমনকি স্কুল ও বাজারেও ঢুকে পড়ে। ফলে বন্যার মৌসুমে মানুষের সঙ্গে সাপের সংঘাত বাড়ে।

স্থানীয় মানুষ জানান, গত বছর বন্যার সময় রাজশাহীর বেশ কয়েকটি গ্রামে দিনে-দুপুরে ঘরে সাপ ঢুকে পড়েছিল। অনেককে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বন্যা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আরও ঘন ঘন হলে ভবিষ্যতে সাপের সংখ্যা ও মানুষের ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে।

মানুষের জীবনে সাপের ভয়

রাজশাহীর অনেক গ্রামে কৃষকেরা রাতে মাঠে কাজ করতে গেলে টর্চলাইট ব্যবহার করেন। শিশুদের একা বাইরে যেতে দেওয়া হয় না। ধানকাটা মৌসুমে বা ফসল তোলার সময় সাপের কামড়ে মৃত্যু বা গুরুতর অসুস্থতার ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়।

শহরের ভেতরেও পুরনো ভবন, ঝোপঝাড় কিংবা ড্রেনের পাশে খৈয়া গোখরা লুকিয়ে থাকতে দেখা যায়। অনেক সময় স্কুলের মাঠ, হাসপাতালের আঙিনা কিংবা বাজারের পাশেই সাপ ধরা পড়েছে।

কমলগঞ্জে ১৫টি ডিমসহ খৈয়া গোখরা সাপ উদ্ধার | পাতাকুঁডির দেশ

মৃত্যুর করুণ হিসাব

গত বছর রাজশাহীতে সাপের কামড়ে অন্তত ৩০ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে অধিকাংশই গ্রামীণ কৃষক ও দিনমজুর, যারা জমিতে কাজ করার সময় সাপের কামড়ের শিকার হন। চিকিৎসা সুবিধার অভাব, কুসংস্কার এবং দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছাতে না পারার কারণে এই মৃত্যু হয়েছে। নতুন সাপ চিকিৎসা কেন্দ্র চালু হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সচেতনতা না বাড়ালে মৃত্যুর সংখ্যা কমানো কঠিন হবে।

লোককথা ও বিশ্বাস

বাংলার গ্রামাঞ্চলে সাপ নিয়ে নানা কুসংস্কার প্রচলিত। অনেকে মনে করেন, গোখরা সাপ প্রতিশোধ নেয়। কেউ সাপ মেরে ফেললে সঙ্গী সাপ বলে ছবি দেখে তাকে চিনে নেয়। যদিও বৈজ্ঞানিকভাবে এসবের প্রমাণ নেই, তবুও এ ধরনের বিশ্বাস মানুষের মনে সাপকে আরও ভয়ের প্রতীক বানিয়েছে।

খৈয়া গোখরার প্রজনন

খৈয়া গোখরা ডিম পাড়া প্রজাতির সাপ। সাধারণত বর্ষা মৌসুমে স্ত্রী সাপ প্রজননে সক্রিয় হয়। একটি স্ত্রী খৈয়া গোখরা একসাথে ১২ থেকে ৩০টি পর্যন্ত ডিম দিতে পারে। ডিমগুলো নিরাপদ গর্তে বা ঝোপের মধ্যে রাখা হয়, এবং স্ত্রী সাপ প্রায়ই ডিম পাহারা দেয়। ৬০ থেকে ৭০ দিনের মধ্যে বাচ্চা সাপ ডিম থেকে বের হয়। জন্মের পরপরই বাচ্চারা বিষধর হয় এবং নিজেদের খাদ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম।

প্রজনন প্রক্রিয়ায় পরিবেশের বড় ভূমিকা রয়েছে। উষ্ণতা, আর্দ্রতা এবং নিরাপদ আশ্রয়ের প্রাপ্যতা ডিমের টিকে থাকা ও বাচ্চাদের জন্ম নিশ্চিত করে। তাই গ্রামীণ অঞ্চলের খড়ের গাদা, জমির ফাঁকফোকর বা পরিত্যক্ত ইঁদুরের গর্ত প্রজননের জন্য উপযুক্ত স্থান।

রাবিতে বিষধর খৈয়া গোখরা সাপ উদ্ধার

চিকিৎসা ও বাস্তবতা

বাংলাদেশে প্রতিবছর কয়েক হাজার মানুষ সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়। তবে গ্রামীণ অঞ্চলে সঠিক চিকিৎসার অভাবে অনেকের মৃত্যু ঘটে। রাজশাহীর নতুন চিকিৎসা কেন্দ্র এই সমস্যা লাঘবে আশার আলো। এখানে দ্রুত অ্যান্টিভেনম দেওয়া সম্ভব হবে।

চিকিৎসকরা বলছেন, সাপের কামড় খাওয়ার পর দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া জরুরি। ঝাড়ফুঁক বা কুসংস্কারে ভরসা করলে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয় না।

প্রতিরোধ ব্যবস্থা

রাজশাহীতে সাপের আতঙ্ক কমাতে বিভিন্ন প্রতিরোধ ব্যবস্থা জরুরি। জমির চারপাশ পরিষ্কার রাখা, খড়ের গাদা বা ঝোপঝাড় কমিয়ে আনা, রাতে হাঁটার সময় টর্চলাইট ব্যবহার, ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ এবং সাপ ধরার বিশেষজ্ঞ দলকে খবর দেওয়া এর মধ্যে অন্যতম।

পরিবেশগত গুরুত্ব

যদিও সাপ মানুষের কাছে আতঙ্কের নাম, কিন্তু প্রকৃতিতে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ইঁদুর নিয়ন্ত্রণে সাপ বিশেষ ভূমিকা রাখে। সাপ না থাকলে কৃষি উৎপাদনে বড় ধরনের ক্ষতি হতো। তাই খৈয়া গোখরা শুধু ভয়ের প্রতীক নয়, পরিবেশের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাণীও বটে।

রাজশাহীতে খৈয়া গোখরার আধিক্য প্রকৃতির নিয়মের অংশ হলেও মানুষের জীবনে ভয় সৃষ্টি করেছে। নতুন চিকিৎসা কেন্দ্র এ ভয় কমাতে সাহায্য করবে। তবে মানুষকে সচেতন হতে হবে, কুসংস্কার দূর করতে হবে এবং প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান করতে হবে। সাপ মানুষকে ভয় দেখালেও অযথা আক্রমণ করে না—বরং মানুষই প্রায়শই সাপকে উত্তেজিত করে। তাই সঠিক আচরণ, সচেতনতা এবং বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা একসাথে এগোলে খৈয়া গোখরা আর আতঙ্ক নয়, বরং প্রকৃতির অংশ হিসেবেই থাকবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

খৈয়া গোখরা: রাজশাহীতে এত সাপ কেন?

১০:৪০:১৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১ অক্টোবর ২০২৫

সাপের চিকিৎসার নতুন অধ্যায় রাজশাহীতে

রাজশাহীতে সম্প্রতি চালু হয়েছে দেশের অন্যতম আধুনিক সাপের চিকিৎসা কেন্দ্র। দীর্ঘদিন ধরে এ অঞ্চলে বিষধর সাপের কামড়ে মানুষ মারা যাচ্ছিল, কিন্তু উন্নত চিকিৎসা সুবিধা না থাকায় অনেক জীবন ঝরে গেছে। এবার সেই অভাব পূরণে উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ। এখানে সাপের কামড়ের জন্য অ্যান্টিভেনম, প্রশিক্ষিত চিকিৎসক এবং জরুরি সহায়তা নিশ্চিত করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ উদ্যোগ রাজশাহীর মানুষের জীবনে এক নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে। কৃষক, শ্রমজীবী ও গ্রামের সাধারণ মানুষ যারা প্রতিদিন মাঠে-ঘাটে কাজ করেন, তাঁরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন।

খৈয়া গোখরা: পরিচিতি ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

বাংলাদেশে বহু প্রজাতির বিষধর সাপ রয়েছে, তবে খৈয়া গোখরা (Naja kaouthia) সবচেয়ে আলোচিত। এর বৈশিষ্ট্য হলো বাদামি-খয়েরি আভাযুক্ত শরীর এবং ফণার ওপর চশমার মতো দাগ। বাংলায় একে “খৈয়া গোখরা” বলা হলেও ইংরেজিতে এর পরিচিতি “Monocled Cobra”।

এই প্রজাতি সাধারণ গোখরা থেকে কিছুটা আলাদা। সাধারণ গোখরার গায়ে কালচে বা হালকা ধূসর রঙ দেখা গেলেও খৈয়া গোখরার দেহে বাদামি বা খয়েরি রঙ বেশি প্রকট। এর দৈর্ঘ্য সাধারণত ১.২ থেকে ১.৫ মিটার হলেও অনুকূল পরিবেশে ২ মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে।

রাজশাহীর ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট

রাজশাহী বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের একটি কৃষি নির্ভর অঞ্চল। পদ্মা, মহানন্দা ও ছোট বড় অসংখ্য নদী, খাল-বিল এবং ফসলি জমি এ অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য। ধান, আলু, গম, ভুট্টা—এসব ফসলের কারণে জমিতে ইঁদুরের আধিক্য রয়েছে। আর ইঁদুরই হলো খৈয়া গোখরার প্রধান খাদ্য। ফলে প্রাকৃতিকভাবে এ অঞ্চলে সাপের সংখ্যা বেশি।

রাজশাহীতে শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ২৭টি গোখরা সাপ - BBC News বাংলা

গবেষকরা বলছেন, রাজশাহীর মাটির গঠন এবং জলবায়ু সাপের জন্য উপযোগী। বর্ষার সময় সাপেরা বন্যার পানিতে ভেসে গ্রামে চলে আসে, আবার শুষ্ক মৌসুমে জমির ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে থাকে। এভাবে মানুষের বসতি ও সাপের আবাস একে অপরের কাছাকাছি চলে এসেছে।

খৈয়া গোখরার আচরণ

খৈয়া গোখরা সাধারণত নিশাচর প্রাণী। দিনের বেলা এরা গর্তে, ঝোপে বা খড়ের গাদায় লুকিয়ে থাকে। রাতের বেলা খাদ্যের খোঁজে বের হয়। ইঁদুর, ব্যাঙ, ছোট পাখি ও কখনও অন্য সাপও এদের খাদ্যতালিকায় থাকে।

এই সাপ মানুষের সামনে এলে সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণ করে না। প্রথমে ফণা তোলে, ফোঁসফোঁস শব্দ করে ভয় দেখায়। কিন্তু কেউ যদি ভয় পেয়ে কাছে চলে যায় বা আক্রমণ করার চেষ্টা করে, তখন এরা কামড় দেয়। খৈয়া গোখরার বিষ মূলত স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে, ফলে শ্বাসকষ্ট, পক্ষাঘাত এমনকি মৃত্যু ঘটতে পারে।

খৈয়া গোখরা কত লম্বা?

খৈয়া গোখরার দৈর্ঘ্য সাধারণত ১.২ থেকে ১.৫ মিটার পর্যন্ত হয়। তবে উপযুক্ত খাদ্য ও নিরাপদ আবাসস্থলে এরা আরও বড় হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার কিছু অঞ্চলে পূর্ণবয়স্ক খৈয়া গোখরা ২ মিটার বা তারও বেশি লম্বা হয়েছে। বয়স, লিঙ্গ এবং পরিবেশগত উপাদান অনুযায়ী এদের দৈর্ঘ্যে পার্থক্য হয়। সাধারণত স্ত্রী সাপ তুলনামূলকভাবে বড় হয়। এদের দেহের মোটা ও শক্তিশালী গঠন শিকার ধরতে এবং আত্মরক্ষায় সহায়ক।

খৈয়া গোখরা - Wikiwand

রাজশাহীতে সাপের আধিক্য: কারণ বিশ্লেষণ

রাজশাহীতে খৈয়া গোখরার আধিক্যের পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, ধান ও আলুর জমিতে প্রচুর ইঁদুর জন্মায়, যা সাপের প্রধান খাদ্য। দ্বিতীয়ত, নদী, খাল, বিল ও ঝোপঝাড় খৈয়া গোখরার জন্য নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করেছে। তৃতীয়ত, কৃষিজমি ও আবাসিক এলাকা একে অপরের কাছাকাছি চলে আসায় মানুষ-সাপ সংঘাত বেড়েছে। চতুর্থত, গ্রামে খড়ের গাদা, খোলা মাঠ ও অগোছালো গৃহস্থালি পরিবেশ সাপকে আকর্ষণ করে।

বন্যা ও সাপের বৃদ্ধি

রাজশাহীতে সাপের সংখ্যা বৃদ্ধির আরেকটি বড় কারণ হলো বন্যা। বর্ষাকালে পদ্মা ও অন্যান্য নদী ফুলেফেঁপে ওঠে এবং আশপাশের গ্রামাঞ্চল পানিতে ডুবে যায়। এই সময় সাপেরা তাদের স্বাভাবিক গর্ত বা আশ্রয় হারিয়ে ফেলে এবং ভেসে ওঠে মানুষের বসতিতে। পানির নিচ থেকে খাবারের সন্ধানে বের হয়ে এরা মাঠ, ঘরবাড়ি, এমনকি স্কুল ও বাজারেও ঢুকে পড়ে। ফলে বন্যার মৌসুমে মানুষের সঙ্গে সাপের সংঘাত বাড়ে।

স্থানীয় মানুষ জানান, গত বছর বন্যার সময় রাজশাহীর বেশ কয়েকটি গ্রামে দিনে-দুপুরে ঘরে সাপ ঢুকে পড়েছিল। অনেককে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বন্যা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আরও ঘন ঘন হলে ভবিষ্যতে সাপের সংখ্যা ও মানুষের ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে।

মানুষের জীবনে সাপের ভয়

রাজশাহীর অনেক গ্রামে কৃষকেরা রাতে মাঠে কাজ করতে গেলে টর্চলাইট ব্যবহার করেন। শিশুদের একা বাইরে যেতে দেওয়া হয় না। ধানকাটা মৌসুমে বা ফসল তোলার সময় সাপের কামড়ে মৃত্যু বা গুরুতর অসুস্থতার ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়।

শহরের ভেতরেও পুরনো ভবন, ঝোপঝাড় কিংবা ড্রেনের পাশে খৈয়া গোখরা লুকিয়ে থাকতে দেখা যায়। অনেক সময় স্কুলের মাঠ, হাসপাতালের আঙিনা কিংবা বাজারের পাশেই সাপ ধরা পড়েছে।

কমলগঞ্জে ১৫টি ডিমসহ খৈয়া গোখরা সাপ উদ্ধার | পাতাকুঁডির দেশ

মৃত্যুর করুণ হিসাব

গত বছর রাজশাহীতে সাপের কামড়ে অন্তত ৩০ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে অধিকাংশই গ্রামীণ কৃষক ও দিনমজুর, যারা জমিতে কাজ করার সময় সাপের কামড়ের শিকার হন। চিকিৎসা সুবিধার অভাব, কুসংস্কার এবং দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছাতে না পারার কারণে এই মৃত্যু হয়েছে। নতুন সাপ চিকিৎসা কেন্দ্র চালু হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সচেতনতা না বাড়ালে মৃত্যুর সংখ্যা কমানো কঠিন হবে।

লোককথা ও বিশ্বাস

বাংলার গ্রামাঞ্চলে সাপ নিয়ে নানা কুসংস্কার প্রচলিত। অনেকে মনে করেন, গোখরা সাপ প্রতিশোধ নেয়। কেউ সাপ মেরে ফেললে সঙ্গী সাপ বলে ছবি দেখে তাকে চিনে নেয়। যদিও বৈজ্ঞানিকভাবে এসবের প্রমাণ নেই, তবুও এ ধরনের বিশ্বাস মানুষের মনে সাপকে আরও ভয়ের প্রতীক বানিয়েছে।

খৈয়া গোখরার প্রজনন

খৈয়া গোখরা ডিম পাড়া প্রজাতির সাপ। সাধারণত বর্ষা মৌসুমে স্ত্রী সাপ প্রজননে সক্রিয় হয়। একটি স্ত্রী খৈয়া গোখরা একসাথে ১২ থেকে ৩০টি পর্যন্ত ডিম দিতে পারে। ডিমগুলো নিরাপদ গর্তে বা ঝোপের মধ্যে রাখা হয়, এবং স্ত্রী সাপ প্রায়ই ডিম পাহারা দেয়। ৬০ থেকে ৭০ দিনের মধ্যে বাচ্চা সাপ ডিম থেকে বের হয়। জন্মের পরপরই বাচ্চারা বিষধর হয় এবং নিজেদের খাদ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম।

প্রজনন প্রক্রিয়ায় পরিবেশের বড় ভূমিকা রয়েছে। উষ্ণতা, আর্দ্রতা এবং নিরাপদ আশ্রয়ের প্রাপ্যতা ডিমের টিকে থাকা ও বাচ্চাদের জন্ম নিশ্চিত করে। তাই গ্রামীণ অঞ্চলের খড়ের গাদা, জমির ফাঁকফোকর বা পরিত্যক্ত ইঁদুরের গর্ত প্রজননের জন্য উপযুক্ত স্থান।

রাবিতে বিষধর খৈয়া গোখরা সাপ উদ্ধার

চিকিৎসা ও বাস্তবতা

বাংলাদেশে প্রতিবছর কয়েক হাজার মানুষ সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়। তবে গ্রামীণ অঞ্চলে সঠিক চিকিৎসার অভাবে অনেকের মৃত্যু ঘটে। রাজশাহীর নতুন চিকিৎসা কেন্দ্র এই সমস্যা লাঘবে আশার আলো। এখানে দ্রুত অ্যান্টিভেনম দেওয়া সম্ভব হবে।

চিকিৎসকরা বলছেন, সাপের কামড় খাওয়ার পর দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া জরুরি। ঝাড়ফুঁক বা কুসংস্কারে ভরসা করলে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয় না।

প্রতিরোধ ব্যবস্থা

রাজশাহীতে সাপের আতঙ্ক কমাতে বিভিন্ন প্রতিরোধ ব্যবস্থা জরুরি। জমির চারপাশ পরিষ্কার রাখা, খড়ের গাদা বা ঝোপঝাড় কমিয়ে আনা, রাতে হাঁটার সময় টর্চলাইট ব্যবহার, ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ এবং সাপ ধরার বিশেষজ্ঞ দলকে খবর দেওয়া এর মধ্যে অন্যতম।

পরিবেশগত গুরুত্ব

যদিও সাপ মানুষের কাছে আতঙ্কের নাম, কিন্তু প্রকৃতিতে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ইঁদুর নিয়ন্ত্রণে সাপ বিশেষ ভূমিকা রাখে। সাপ না থাকলে কৃষি উৎপাদনে বড় ধরনের ক্ষতি হতো। তাই খৈয়া গোখরা শুধু ভয়ের প্রতীক নয়, পরিবেশের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাণীও বটে।

রাজশাহীতে খৈয়া গোখরার আধিক্য প্রকৃতির নিয়মের অংশ হলেও মানুষের জীবনে ভয় সৃষ্টি করেছে। নতুন চিকিৎসা কেন্দ্র এ ভয় কমাতে সাহায্য করবে। তবে মানুষকে সচেতন হতে হবে, কুসংস্কার দূর করতে হবে এবং প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান করতে হবে। সাপ মানুষকে ভয় দেখালেও অযথা আক্রমণ করে না—বরং মানুষই প্রায়শই সাপকে উত্তেজিত করে। তাই সঠিক আচরণ, সচেতনতা এবং বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা একসাথে এগোলে খৈয়া গোখরা আর আতঙ্ক নয়, বরং প্রকৃতির অংশ হিসেবেই থাকবে।