উপন্যাসের সূচনা: মৃত্যুই প্রবেশদ্বার
অ্যামি ব্যারোডেলের প্রথম উপন্যাস ট্রিপ-এর শুরুতেই এক নারী সান্দ্রা হোটেলের বাথরুমে চুল আঁচড়ানোর ব্রাশে পিছলে পড়ে মারা যায়, সেখান থেকেই শুরু হয় তার অদ্ভুত ভ্রমণ। মৃত্যুর পরের এই যাত্রায় সান্দ্রা প্রবেশ করে ‘বার্ডো’-তে—যা বৌদ্ধ দর্শনে মৃত্যুর পর পুনর্জন্মের মাঝামাঝি অবস্থাকে বোঝায়।
বার্ডোর জগতে অভিজ্ঞতা
সান্দ্রা সেখানে নানা অদ্ভুত দৃশ্য দেখে: রঙিন আলো, স্ফুলিঙ্গ, এমন সব আত্মা—যেমন কাকের ডানা-ওয়ালা এক চীনা ভ্রমণ এজেন্ট বা ধোঁয়ার তৈরি হাত-পা-ওয়ালা এক ওয়েটার। শরীরের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে তার চেতনা ছড়িয়ে পড়ে অতীত, বর্তমান আর দূর ভবিষ্যতে। সে তার কিশোর পুত্র ট্রিপের জন্য উদ্বিগ্ন হয়, যে অটিজমে আক্রান্ত এবং দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরে এক অচেনা ব্যক্তির সঙ্গে একটি নৌকায় আটকা পড়ে আছে।
জীবন আর মৃত্যুর সীমারেখা
উপন্যাসের কাহিনি শুনতে অবাস্তব মনে হলেও, ব্যারোডেল মৃত্যুর অভিজ্ঞতাকে জীবনের মতোই স্বাভাবিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। দীর্ঘদিনের বৌদ্ধ অনুশীলনের কারণে তার লেখায় পুনর্জন্ম আর মৃত্যুর মধ্যবর্তী স্তরের বর্ণনা গভীরভাবে স্থান পেয়েছে। তার ভাষায়, “এটা খুব বেশি অদ্ভুত কিছু নয়, বরং বাস্তবতার সামান্য ভিন্ন স্বাদ।”
সমালোচনা ও পাঠক প্রতিক্রিয়া
ট্রিপ প্রকাশের পর থেকে সমালোচনায় নানা বিপরীত প্রতিক্রিয়া এসেছে। নিউইয়র্ক টাইমস একে “অতিক্রমী এবং আশ্চর্যজনকভাবে অদ্ভুত” বলেছে, অন্যদিকে কার্কাস রিভিউস লিখেছে এটি “নিজের মহাজাগতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষায় পৌঁছাতে পারেনি।” অনেক পাঠক মেনে নিয়েছেন, আধ্যাত্মিক কাঠামোর ভেতরেও উপন্যাসটি কখনো হাস্যকর, কখনো বিদ্রুপে ভরা। মৃতরাও এখানে বিরক্তিকর হতে পারে, আবার দেহহীন হয়েও যৌনতা সম্ভব—এসবই উপন্যাসের অংশ।
বাস্তব জীবনের সঙ্গে মিশ্রণ
বাস্তব জগতের দৃশ্যগুলো—স্কুল প্রশাসকের সঙ্গে উত্তেজনাপূর্ণ স্কাইপ মিটিং, কুকুরের দেখভালের খোঁজখবর বা থেরাপির সেশন—মৃত্যুর পর আত্মার ভ্রমণের মতোই অদ্ভুত লাগে। লেখক অটেসা মোশফেগ মন্তব্য করেছেন, “উপন্যাসটি মৃত্যুর প্রশ্ন তোলে, আর চরিত্রটি জীবনে যা খুঁজে পায়নি, তা কি মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পেতে পারে—এই দ্বৈততা পাঠককে ভাবায়।”
লেখিকার শেকড় ও বৌদ্ধ অনুশীলন
৪৯ বছর বয়সী ব্যারোডেল টেক্সাসের হিউস্টনে বেড়ে ওঠেন। তার মা ছিলেন একক অভিভাবক ও ট্রমা নার্স, পাশাপাশি বৌদ্ধ গুরু চোগ্যম ত্রুঙপার অনুসারী। ছোটবেলায় তিনি বৌদ্ধ প্রতিশ্রুতি নিতে চাইলেও বয়সের কারণে বারণ পান, পরে কান্নায় ভেঙে পড়লে অনুমতি দেওয়া হয়। কৈশোরে বৌদ্ধ চর্চা তাকে ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে আলাদা করে তুলেছিল।

নিউইয়র্কে পড়াশোনার পর তিনি দ্য অনিয়ন ও পরে ভাইস-এ কাজ করেন। এক পর্যায়ে ভারতে গিয়ে দীর্ঘ রিট্রিটে অংশ নেন এবং নক্সাল আন্দোলন নিয়ে লেখার চেষ্টা করেন। জীবনের এই অস্থির সময়ের মধ্যেই তিনি মৃত্যু নিয়ে ভয়ের বাইরে বাঁচতে শিখেছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবন ও লেখালেখি
পরে তিনি লেখক ক্ল্যানসি মার্টিনকে সাক্ষাৎকার নেন; সেখান থেকেই সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তারা বিয়ে করেন। বর্তমানে তারা কানসাস সিটিতে দুই সন্তান ও ছয়টি বেড়াল নিয়ে বসবাস করেন। ত্রিশের কোঠায় পৌঁছেই তিনি পূর্ণ মনোযোগ দেন কথাসাহিত্যে। ২০১৬ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ইউ আর হ্যাভিং এ গুড টাইম প্রকাশিত হয়।
উপন্যাস ট্রিপ-এর জন্ম
নেপালে গিয়ে তার গুরু জংসার জামিয়াং খিয়েনসে রিনপোচে তাকে বার্ডো নিয়ে প্রেমকাহিনি লেখার পরামর্শ দেন। প্রথমে তিনি দ্বিধায় ছিলেন, তবে পরে মৃত্যুর অভিজ্ঞতাকে মাতৃত্বের ভালোবাসার সঙ্গে যুক্ত করে লেখাটি ব্যক্তিগত করে তোলেন। এ সময়েই তার সন্তানের অটিজম ধরা পড়ে, যা উপন্যাসে সান্দ্রা ও ট্রিপের সম্পর্ককে গভীরতর করেছে।
কৌতুক ও আধ্যাত্মিকতার মিশ্রণ
উপন্যাসে সান্দ্রা নেপালে মৃত্যুবিষয়ক এক সম্মেলনে অংশ নিতে গিয়ে মারা যায়। সেখানে ধর্মীয় গুরু, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও নানা অদ্ভুত মাধ্যমেরা নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে ব্যস্ত, আর মৃত সান্দ্রা ব্যর্থ চেষ্টা চালায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগের। এই কাহিনিতে লেখিকা বৌদ্ধ সূত্র থেকেও অংশ নিয়েছেন—কখনো সংলাপে, কখনো টীকা-টিপ্পনী হিসেবে।
সাহিত্য ও দর্শনের সংযোগ
বৌদ্ধ দার্শনিক রবার্ট থারম্যানের অনুবাদ করা দ্য টিবেটান বুক অব দ্য ডেড থেকে উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে। থারম্যান বলেছেন, এসব ধারণা সাহিত্যে প্রবেশ করলে পাঠক উপলব্ধি করে বাস্তবতা তেমনটা নয়, যেমনটা আমরা মনে করি।
পাঠকের বিভ্রান্তি ইচ্ছাকৃত
ব্যারোডেল নিজেই বলেন, তিনি চেয়েছেন পাঠককে অস্থির রাখতে—যেন জাগরণ আর নিদ্রা, জীবন আর মৃত্যুর সীমারেখা মুছে যায়। তিনি জানেন, সবাই বুঝবে না, তবে সেটাই স্বাভাবিক। তার ভাষায়, “মানুষ হয় বুঝবে—নয়তো বুঝবে না।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 





















