ঘটনার শুরু: জন্মদিনের শুভেচ্ছা থেকে বিতর্ক
বাংলাদেশের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সাজিব ভূঁইয়া ঘোষণা করেছেন, সাকিব আল হাসান আর কখনো বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলতে পারবেন না। এই ঘোষণা এসেছে ফেসবুকে দুই দিনের উত্তপ্ত কথোপকথনের পর। ঘটনাটি শুরু হয়েছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সাকিবের জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর মাধ্যমে।
গত বছর দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসন শেষে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন। তার শাসনের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী প্রবণতা ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।
টেলিভিশনে আসিফের বক্তব্য
এই সপ্তাহে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে আসিফ বলেন, তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে (বিসিবি) স্পষ্ট নির্দেশ দেবেন। তার ভাষায়:
“সে আর বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিতে পারবে না, জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দিতে পারবে না। সাকিব আল হাসান আর কখনো বাংলাদেশ দলে খেলতে পারবে না।”
ফেসবুক পোস্টে পাল্টাপাল্টি
রবিবার রাত ৯টার দিকে সাকিব একটি ছবি পোস্ট করেন শেখ হাসিনার সঙ্গে, ক্যাপশনে লেখেন: “শুভ জন্মদিন, আপা।”
এক ঘণ্টা পর আসিফ নিজের ফেসবুকে লেখেন:
“অনেকে আমাকে গালাগালি দিয়েছিল এক ব্যক্তিকে পুনর্বাসন না করায়। কিন্তু আমি ঠিক ছিলাম। আলোচনার সমাপ্তি।”
এই মন্তব্য ছিল সেই সময়ের প্রসঙ্গ, যখন সাকিব ঘোষণা দিয়েছিলেন ঢাকায় একটি টেস্ট ম্যাচ খেলেই অবসরে যাবেন। কিন্তু প্রতিবাদের কারণে তিনি মাঠে নামতে পারেননি।
রাত ১১টা ২০ মিনিটে সাকিব নাম উল্লেখ না করেই ফেসবুকে লেখেন:
“অবশেষে কেউ স্বীকার করল, তার কারণেই আমি আর বাংলাদেশের জার্সি পাইনি, দেশের হয়ে খেলতে পারিনি! সম্ভবত একদিন আমি আমার মাতৃভূমিতে ফিরব। আমি বাংলাদেশকে ভালোবাসি।”
আসিফের কঠোর অবস্থান
সোমবার দুপুরে আসিফ আবার লিখেন:
“যার হাতে শিক্ষার্থী ও মানুষের রক্তের দাগ, তাকে বাংলাদেশের পতাকা বহন করতে দেওয়া যাবে না।”
তিনি অভিযোগ করেন, সাকিব আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। এছাড়া তার বিরুদ্ধে “শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, অর্থপাচার ও আর্থিক জালিয়াতি”র অভিযোগও রয়েছে। আসিফ বলেন:
“শুধু ভালো ক্রিকেটার বলে কাউকে পুনর্বাসন করা যাবে না। আইনের চোখে সবাই সমান।”
সাকিবের বক্তব্য
জন্মদিনের শুভেচ্ছা রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত নয় বলে দাবি করেছেন সাকিব। তার ভাষায়:
“তিনি সবসময় ক্রিকেট অনুসরণ করেছেন, রাজনীতির আগেই। সেই সম্পর্ক থেকেই শুভেচ্ছা জানিয়েছি। এর বাইরে কোনো উদ্দেশ্য বা ইঙ্গিত ছিল না।”
আগেও সাকিব বলেছিলেন, ২০২৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে তাকে বাধ্য করা হয়েছিল এবং তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে ছিলেন না।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর থেকে সাকিব দেশে ফেরেননি। তিনি নৌকা প্রতীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং বর্তমানে অন্যদের মতোই হত্যা ও আর্থিক জালিয়াতির মামলার মুখোমুখি।
অক্টোবরে তার বিদায়ী টেস্ট আয়োজনের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। সরকারি অনুমতি না মেলায় তিনি মাঝপথেই ফিরে আসেন। ক্রিকেট মহলে তখন ধারণা করা হচ্ছিল, ক্রীড়া উপদেষ্টা তার ফেরার বিরোধিতা করেছিলেন। আসিফের সাম্প্রতিক মন্তব্য সেই সন্দেহকে দৃঢ় করেছে।
জাতীয় মর্যাদার প্রশ্ন
সোমবার রাতে আসিফ আনুষ্ঠানিকভাবে জানান, বিসিবিকে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হবে—সাকিবকে আর দলে নেওয়া যাবে না। তার ভাষায়, এটি শুধু শৃঙ্খলার বিষয় নয়, জাতীয় মর্যাদার সঙ্গেও জড়িত।
“বাংলাদেশের জার্সির পরিচয় সে আর ধারণ করতে পারবে না,” বলেন আসিফ।
জনমতের প্রতিক্রিয়া
সাকিবের সমর্থকরা সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন, ক্রিকেটকে রাজনীতি থেকে আলাদা রাখা উচিত এবং পারফরম্যান্স ও ফিটনেসের ভিত্তিতেই খেলোয়াড় বাছাই করা উচিত। অন্যদিকে সমালোচকরা বলেন, কোনো ক্রীড়াবিদ আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না।
এই বিতর্ক আবারও দেখাল, বাংলাদেশে ক্রীড়া ও রাজনীতি কতটা জটিলভাবে জড়িয়ে গেছে, এবং এসব বিতর্ক এখন সরাসরি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয়ে পরে আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে পৌঁছে।
এক যুগের অধ্যায়ের সমাপ্তি
৩৮ বছর বয়সী সাকিব সরাসরি নির্বাচনী নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আর কিছু বলেননি। তবে তার ফেসবুক পোস্টে লেখা “সম্ভবত একদিন আমি আমার মাতৃভূমিতে ফিরব” বাক্যটি বিদায় ও প্রতিশ্রুতির মিশ্রণ হিসেবে পড়া হয়েছে।
যদি আসিফের নির্দেশ কার্যকর হয়, তবে তা বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এক যুগকে চিহ্নিত করে দেওয়া একটি অধ্যায়ের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হবে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই সিদ্ধান্ত এসেছে কোনো সংবাদ সম্মেলন বা আনুষ্ঠানিক বৈঠকে নয়, বরং ফেসবুক পোস্ট ও রাতের বেলার ফোনালাপে—একেবারে আধুনিক প্রজন্মের এক জনসম্মুখ বিতর্কের মতো।