০৭:১৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর ২০২৫
বাংলাদেশের সঙ্গে বিদ্যুৎ রপ্তানি চুক্তির নবায়ন প্রক্রিয়া শুরু ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্য থেকে আধুনিক অর্থনীতিতে—ডিজিটাল মিশরের উত্থান ইউফোরিয়া’ সিজন ৩—জ্যাকব এলর্ডির ইঙ্গিতে ফের উচ্ছ্বাস” প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-৩১২) স্ট্রেঞ্জার থিংস’-এর শেষ অধ্যায়—নেটফ্লিক্সের মহাকাব্যিক সিরিজের অন্তরালের গল্প ‘হোয়েন দে বার্নড দ্য বাটারফ্লাই’—নারী গোপন সমাজের ইতিহাস ও আগুনের শক্তি নিয়ে ওয়েন–ই লির নতুন উপন্যাস মেগান লাউ—দর্শনশাস্ত্রের শিক্ষার্থী থেকে ‘হাউস অব ড্যান্সিং ওয়াটার’-এর আকাশচারী নায়িকা সুদানের জ্বালানি পুনর্গঠনে রাশিয়া—যুদ্ধোত্তর পুনরুদ্ধারে মস্কো প্রধান অংশীদার হতে পারে আফগানিস্তানে মাদকবিরোধী কঠোর অভিযান—আসক্তি, ধর্মীয় উপদেশ ও পুনর্বাসনের নতুন বাস্তবতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঢাকা (পর্ব-৪৩)

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৪৬ তম কিস্তি )

  • Sarakhon Report
  • ১২:০০:৩৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
  • 42
রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।

দিবা রাত্রির কাব্য

মানিক বন্দোপাধ্যায়

 

যে তেজ, যে প্রচণ্ড গতির অবসান হয়ে গেছে তার জন্য হেরম্বের মন হাহাকার করে। একদিন যা দিয়ে সে মানুষের বুকও ভেঙেছে ঘরও ভেঙেছে, আজসে শক্তি থাকলে সে মহামানবের মতো ভাঙা বুক জোড়া দিতে পারত, ভাঙা ঘর গড়ে তুলতে পারত। মনে জোর থাকলে জীবনে সমস্যা কোথায়? মালতী, সুপ্রিয়া ও আনন্দকে নিয়ে বিপুল পৃথিবীর এককোণেঠাঁই বেছে নেওয়া কঠিন নয়, জীবনের দু’টি প্রান্তে সুপ্রিয়া ও আনন্দকেও এমনভাবে রেখে দেওয়া অসম্ভব নয় যাতে নিজস্ব সীমা তাদের কোনদিন চোখে পড়বে না, খণ্ডিত হেরম্বকে দিয়েও জীবনের পূর্ণতা সাধিত হওয়ায় কোনদিন তারা অনুভব করতে পারবে না নিজেকে দু’ভাগে ভাগ হেরম্বের পক্ষে এ কাজ সম্ভব ছিল।

করে দু’জনকেই সে ঠকিয়েছে। একদিন আজ এ শুধু কল্পনা, অক্ষমের দিবাস্বপ্ন সত্যই কল্পনা। আজ সারাদিন, বিশেষভাবে আনন্দের পিঠে বরফ পসে দেবার সময়, এই দিবাস্বপ্নই সে দেখেছে। সুপ্রিয়া থাকে জনপদের একটি দ্বিতল গৃহে, তার ছবির মতো সাজানো ঘরে সারাদিন হেরম্ব গৃহস্থ সংসারী, সন্ধ্যায় দে ফিরে যায় আনন্দের স্বহস্তে রোপিত ফুলগাছ সাজানো বাগানে ঘেরা শান্ত নির্জন কুটিরে। সুপ্রিয়া তাকে রে’ধে খাওয়ায়, আনন্দ তাকে দেখায় চন্দ্রকলা নাচ। তার মধ্যে যে ক্ষুধিত অসন্তুষ্ট দেবতা আছেন হেরম্ব তাকে এমনি সব উদ্‌ভ্রান্ত কল্পনার নৈবো নিবেদন করে। নিবেদন করে সসঙ্কোচে, প্রায় সজল চোখে। তার কি বুঝতে বাকি আছে যে, এই ভ্রান্ত আত্মপূজা তার বার্ধক্যের পরিচয়, এইসব রঙিন কল্পনা তার কৈশোরে ফিরে আসার লক্ষণ নয়, যৌবন- অপরাহ্ণের মৃত্যু-উৎসব।

মালতী আজ হেরম্বকে বেদখল করেছে। দশ মিনিটের বেশী একা থাকতে দেয় না।

বলে, ‘মিনেন্স যদি আর একটা দিন থেকে যেত, আমার জন্মদিনের উৎসবটা হতে পারত। যাক্, কি আর হবে, গেছেই যখন মরুকগে যাক। তারও শান্তি, আমারও শান্তি।’

‘শান্তিই মানুষের সব।’ হেরম্ব সংক্ষেপে বলে।

মালতী হেসে বলল, ‘খুব একটা মস্ত কথা বললে তো! আসল কথাটা জান, হেরম্ব? আমায় আর দেখতে পারত না। ওসব যোগটোগ মিছে কথা, ভণ্ডামি। একজনকে দেখতে না পারলেই মানুষের ওসব ভণ্ডামি আসে। কই, সংসারে বিরাগ না এলে সন্ন্যাসী হতে দেখলাম না তো কাউকে! ভোগ ভাল না লাগলে তখন তোমাদের ধর্মে মতি হয়। তোমরা পুরুষমানুষেরা হলে কি বলে গিয়ে সুখের পায়রা। যখন যাতে মজা লাগে তাই তোমাদের ধর্ম। ঘেন্নার জাত বাপু তোমরা।’

শেষ পর্যন্ত মালতীকে সহ্য করতে না পেরেই হেরম্ব পথে বেরিয়ে গেল।

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি বুঝি তাঁর বাড়ি যাচ্ছ?’

‘হ্যা। তুমি বারণ করলে যাব না?’

‘বারণ করব কেন?’

‘সন্ধ্যার সময় ফিরে আসব, আনন্দ।’

আনন্দ ম্লানমুখে বলল, ‘তাই এস। আমার আজ বড় মন কেমন করছে।’ হেরম্ব ইতস্তত করে বলল, ‘তবে না হয় নাই গেলাম, আনন্দ। চল, আমরা সমুদ্রের ধার থেকে বেড়িয়ে আসি।’

আনন্দ বলল, ‘না, আমি মা’র কাছে থাকব।’

 

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৪৫ তম কিস্তি )

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৪৫ তম কিস্তি )

জনপ্রিয় সংবাদ

বাংলাদেশের সঙ্গে বিদ্যুৎ রপ্তানি চুক্তির নবায়ন প্রক্রিয়া শুরু ভারতের

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৪৬ তম কিস্তি )

১২:০০:৩৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।

দিবা রাত্রির কাব্য

মানিক বন্দোপাধ্যায়

 

যে তেজ, যে প্রচণ্ড গতির অবসান হয়ে গেছে তার জন্য হেরম্বের মন হাহাকার করে। একদিন যা দিয়ে সে মানুষের বুকও ভেঙেছে ঘরও ভেঙেছে, আজসে শক্তি থাকলে সে মহামানবের মতো ভাঙা বুক জোড়া দিতে পারত, ভাঙা ঘর গড়ে তুলতে পারত। মনে জোর থাকলে জীবনে সমস্যা কোথায়? মালতী, সুপ্রিয়া ও আনন্দকে নিয়ে বিপুল পৃথিবীর এককোণেঠাঁই বেছে নেওয়া কঠিন নয়, জীবনের দু’টি প্রান্তে সুপ্রিয়া ও আনন্দকেও এমনভাবে রেখে দেওয়া অসম্ভব নয় যাতে নিজস্ব সীমা তাদের কোনদিন চোখে পড়বে না, খণ্ডিত হেরম্বকে দিয়েও জীবনের পূর্ণতা সাধিত হওয়ায় কোনদিন তারা অনুভব করতে পারবে না নিজেকে দু’ভাগে ভাগ হেরম্বের পক্ষে এ কাজ সম্ভব ছিল।

করে দু’জনকেই সে ঠকিয়েছে। একদিন আজ এ শুধু কল্পনা, অক্ষমের দিবাস্বপ্ন সত্যই কল্পনা। আজ সারাদিন, বিশেষভাবে আনন্দের পিঠে বরফ পসে দেবার সময়, এই দিবাস্বপ্নই সে দেখেছে। সুপ্রিয়া থাকে জনপদের একটি দ্বিতল গৃহে, তার ছবির মতো সাজানো ঘরে সারাদিন হেরম্ব গৃহস্থ সংসারী, সন্ধ্যায় দে ফিরে যায় আনন্দের স্বহস্তে রোপিত ফুলগাছ সাজানো বাগানে ঘেরা শান্ত নির্জন কুটিরে। সুপ্রিয়া তাকে রে’ধে খাওয়ায়, আনন্দ তাকে দেখায় চন্দ্রকলা নাচ। তার মধ্যে যে ক্ষুধিত অসন্তুষ্ট দেবতা আছেন হেরম্ব তাকে এমনি সব উদ্‌ভ্রান্ত কল্পনার নৈবো নিবেদন করে। নিবেদন করে সসঙ্কোচে, প্রায় সজল চোখে। তার কি বুঝতে বাকি আছে যে, এই ভ্রান্ত আত্মপূজা তার বার্ধক্যের পরিচয়, এইসব রঙিন কল্পনা তার কৈশোরে ফিরে আসার লক্ষণ নয়, যৌবন- অপরাহ্ণের মৃত্যু-উৎসব।

মালতী আজ হেরম্বকে বেদখল করেছে। দশ মিনিটের বেশী একা থাকতে দেয় না।

বলে, ‘মিনেন্স যদি আর একটা দিন থেকে যেত, আমার জন্মদিনের উৎসবটা হতে পারত। যাক্, কি আর হবে, গেছেই যখন মরুকগে যাক। তারও শান্তি, আমারও শান্তি।’

‘শান্তিই মানুষের সব।’ হেরম্ব সংক্ষেপে বলে।

মালতী হেসে বলল, ‘খুব একটা মস্ত কথা বললে তো! আসল কথাটা জান, হেরম্ব? আমায় আর দেখতে পারত না। ওসব যোগটোগ মিছে কথা, ভণ্ডামি। একজনকে দেখতে না পারলেই মানুষের ওসব ভণ্ডামি আসে। কই, সংসারে বিরাগ না এলে সন্ন্যাসী হতে দেখলাম না তো কাউকে! ভোগ ভাল না লাগলে তখন তোমাদের ধর্মে মতি হয়। তোমরা পুরুষমানুষেরা হলে কি বলে গিয়ে সুখের পায়রা। যখন যাতে মজা লাগে তাই তোমাদের ধর্ম। ঘেন্নার জাত বাপু তোমরা।’

শেষ পর্যন্ত মালতীকে সহ্য করতে না পেরেই হেরম্ব পথে বেরিয়ে গেল।

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি বুঝি তাঁর বাড়ি যাচ্ছ?’

‘হ্যা। তুমি বারণ করলে যাব না?’

‘বারণ করব কেন?’

‘সন্ধ্যার সময় ফিরে আসব, আনন্দ।’

আনন্দ ম্লানমুখে বলল, ‘তাই এস। আমার আজ বড় মন কেমন করছে।’ হেরম্ব ইতস্তত করে বলল, ‘তবে না হয় নাই গেলাম, আনন্দ। চল, আমরা সমুদ্রের ধার থেকে বেড়িয়ে আসি।’

আনন্দ বলল, ‘না, আমি মা’র কাছে থাকব।’

 

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৪৫ তম কিস্তি )

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৪৫ তম কিস্তি )