১১:৩৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫

ভণ্ডামি চিনে ফেলবেন কীভাবে

অন্যের ভুল চোখে পড়ে, নিজেরটা নয়

আমরা প্রায়ই এমন কাজ করি যা আমাদের নিজস্ব বক্তব্যের সঙ্গে মেলে না—এটাই ভণ্ডামি। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, এটি মানুষের খুব স্বাভাবিক প্রবণতা। অন্যদের মধ্যে এই বৈপরীত্য আমরা দ্রুত ধরতে পারি, কিন্তু নিজের ক্ষেত্রে তা স্বীকার করা বেশ কঠিন।

দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক আইক সিলভার বলেন, “ভণ্ডামি আসলে দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। আমরা অন্যদের ভণ্ডামি ধরতে পছন্দ করি কারণ তা আমাদের যুক্তিতে জিততে সাহায্য করে।” কিন্তু নিজের ক্ষেত্রে আমরা নানা ব্যাখ্যা দিয়ে বিষয়টি আড়াল করার চেষ্টা করি।


ব্যক্তিগত জীবনের ছোট ছোট উদাহরণ

রাজনীতিতে যেমন, তেমনি ব্যক্তিগত জীবনেও ভণ্ডামি সহজেই দেখা যায়। কেউ সুস্বাস্থ্য রক্ষার কথা বলে অন্যকে মিষ্টি না খেতে বলেন, অথচ পরে নিজেই চুপিচুপি কুকি খান। কেউ সন্তানদের রোদে বের হলে সানস্ক্রিন লাগাতে বলেন, অথচ নিজেরা তা ব্যবহার করতে ভুলে যান। আবার কেউ প্রাণীপ্রেমী হয়ে মাংস খান না, কিন্তু “কিউট” বলে চামড়ার জুতো পরেন।

লস অ্যাঞ্জেলেসের ৬৪ বছর বয়সী থেরাপিস্ট জন সিলিমপারিস বলেন, “আমি নিজেই নিজের পরামর্শ অমান্য করেছিলাম। বুঝতে পেরে নিজের ওপরই রাগ করেছি।”

The Danger of Pointing out Faults in Others

কেন অন্যের ভণ্ডামিতে এত ক্ষোভ

হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক জিলিয়ান জর্ডান বলেন, “আমরা অন্যের ভণ্ডামি নিয়ে ক্ষুব্ধ হই, কারণ তা অন্যদের কাছে নিজেকে অতিরিক্ত নৈতিক দেখানোর চেষ্টা হিসেবে মনে হয়।”

কিন্তু বাস্তবে সব অসঙ্গতি ভণ্ডামি নয়। কেউ হয়তো ভোট দেওয়ার পরামর্শ দেন, কিন্তু ভোটের দিন পারিবারিক জরুরি অবস্থায় ভোট দিতে যেতে পারেন না। তাই কোনো আচরণকে ভণ্ডামি বলার আগে অন্যান্য কারণও বিবেচনা করা দরকার।


নিজের ভণ্ডামি শনাক্ত করা কঠিন কেন

আমাদের মস্তিষ্কে ‘কনসিস্টেন্সি প্রেসার’ নামে একটি মানসিক তাগিদ কাজ করে, যা আমাদেরকে একইভাবে আচরণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু জীবনের বাস্তবতা সবসময় একরকম থাকে না। পরিস্থিতি বদলালে সিদ্ধান্তও বদলাতে হয়—এটাই মানবজীবনের বাস্তবতা।

লন্ডন বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক ড্যানিয়েল ইফরন বলেন, “অন্যকে ভণ্ড বললে আমরা আসল যুক্তির জায়গা থেকে সরে যাই। বরং নিজেদের দিকে তাকানোই শ্রেয়।”


কীভাবে নিজের ভণ্ডামি চিনবেন

নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন, “আমার আচরণ কি আমার কথার সঙ্গে মিলছে?” যদি উত্তর না হয়, তা স্বীকার করুন। গবেষণায় দেখা গেছে, নিজের ভণ্ডামি স্বীকার করলে মানুষ সাধারণত ক্ষমাশীল হয় এবং আপনাকে আন্তরিক মনে করে।

Hypocrites: How to Survive in a World that's Full of Them

উত্তর অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফ স্টোন বলেন, “নিজের ভণ্ডামি বুঝতে পারা মানুষকে পরিবর্তনের অনুপ্রেরণা দেয়। কারণ কথায় আর কাজে অসঙ্গতি থাকলে ভেতরে অস্বস্তি জন্মায়, যা মানুষকে আরও সৎ হতে বাধ্য করে।”


শেখার সুযোগ হিসেবে দেখুন

গুগলের সাবেক নির্বাহী কিম স্কট একবার নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। তিনি এক বৈঠকের সময় পরিবর্তন করেছিলেন নিজের সন্তানদের সঙ্গে নাশতা করার জন্য। কিন্তু আয়ারল্যান্ডের এক সহকর্মী জানান, তাঁর সন্তানেরাও সন্ধ্যায় ডিনার করে—সেই সময়েও বৈঠকও পড়ে যাচ্ছে।

স্কট লজ্জা পেলেও পরে সময়সূচি সংশোধন করেন এবং ভবিষ্যতে সহকর্মীদের প্রতিক্রিয়া শোনার আহ্বান জানান। এক ডিনারে নিজের কিশোর সন্তানদের ফোন বন্ধ রাখার উপদেশ দিলেও তাঁর নিজের ফোন বেজে ওঠে, এবং তিনি তা রিসিভ করেন। তখন সন্তানরা বলে ওঠে, “তুমি তো ভণ্ডামি করছ!”

স্কট পরে ফোনটি সরিয়ে রেখে তাদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, “ভণ্ডামি নিয়ে লজ্জিত না হয়ে বরং এটিকে শেখার সুযোগ হিসেবে দেখা উচিত।”

ভণ্ডামি মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, কিন্তু সচেতনতা ও আত্মসমালোচনার মাধ্যমে আমরা এর প্রভাব কমাতে পারি। নিজের অসঙ্গতি স্বীকার করাই পরিবর্তনের প্রথম ধাপ—আর সেই সৎ প্রচেষ্টাই আমাদের নৈতিকভাবে দৃঢ় করে তোলে।


#ভণ্ডামি ##মনোবিজ্ঞান #মানবআচরণ #সারাক্ষণ_রিপোর্ট

জনপ্রিয় সংবাদ

ভণ্ডামি চিনে ফেলবেন কীভাবে

০৬:০০:৪৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৮ অক্টোবর ২০২৫

অন্যের ভুল চোখে পড়ে, নিজেরটা নয়

আমরা প্রায়ই এমন কাজ করি যা আমাদের নিজস্ব বক্তব্যের সঙ্গে মেলে না—এটাই ভণ্ডামি। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, এটি মানুষের খুব স্বাভাবিক প্রবণতা। অন্যদের মধ্যে এই বৈপরীত্য আমরা দ্রুত ধরতে পারি, কিন্তু নিজের ক্ষেত্রে তা স্বীকার করা বেশ কঠিন।

দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক আইক সিলভার বলেন, “ভণ্ডামি আসলে দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। আমরা অন্যদের ভণ্ডামি ধরতে পছন্দ করি কারণ তা আমাদের যুক্তিতে জিততে সাহায্য করে।” কিন্তু নিজের ক্ষেত্রে আমরা নানা ব্যাখ্যা দিয়ে বিষয়টি আড়াল করার চেষ্টা করি।


ব্যক্তিগত জীবনের ছোট ছোট উদাহরণ

রাজনীতিতে যেমন, তেমনি ব্যক্তিগত জীবনেও ভণ্ডামি সহজেই দেখা যায়। কেউ সুস্বাস্থ্য রক্ষার কথা বলে অন্যকে মিষ্টি না খেতে বলেন, অথচ পরে নিজেই চুপিচুপি কুকি খান। কেউ সন্তানদের রোদে বের হলে সানস্ক্রিন লাগাতে বলেন, অথচ নিজেরা তা ব্যবহার করতে ভুলে যান। আবার কেউ প্রাণীপ্রেমী হয়ে মাংস খান না, কিন্তু “কিউট” বলে চামড়ার জুতো পরেন।

লস অ্যাঞ্জেলেসের ৬৪ বছর বয়সী থেরাপিস্ট জন সিলিমপারিস বলেন, “আমি নিজেই নিজের পরামর্শ অমান্য করেছিলাম। বুঝতে পেরে নিজের ওপরই রাগ করেছি।”

The Danger of Pointing out Faults in Others

কেন অন্যের ভণ্ডামিতে এত ক্ষোভ

হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক জিলিয়ান জর্ডান বলেন, “আমরা অন্যের ভণ্ডামি নিয়ে ক্ষুব্ধ হই, কারণ তা অন্যদের কাছে নিজেকে অতিরিক্ত নৈতিক দেখানোর চেষ্টা হিসেবে মনে হয়।”

কিন্তু বাস্তবে সব অসঙ্গতি ভণ্ডামি নয়। কেউ হয়তো ভোট দেওয়ার পরামর্শ দেন, কিন্তু ভোটের দিন পারিবারিক জরুরি অবস্থায় ভোট দিতে যেতে পারেন না। তাই কোনো আচরণকে ভণ্ডামি বলার আগে অন্যান্য কারণও বিবেচনা করা দরকার।


নিজের ভণ্ডামি শনাক্ত করা কঠিন কেন

আমাদের মস্তিষ্কে ‘কনসিস্টেন্সি প্রেসার’ নামে একটি মানসিক তাগিদ কাজ করে, যা আমাদেরকে একইভাবে আচরণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু জীবনের বাস্তবতা সবসময় একরকম থাকে না। পরিস্থিতি বদলালে সিদ্ধান্তও বদলাতে হয়—এটাই মানবজীবনের বাস্তবতা।

লন্ডন বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক ড্যানিয়েল ইফরন বলেন, “অন্যকে ভণ্ড বললে আমরা আসল যুক্তির জায়গা থেকে সরে যাই। বরং নিজেদের দিকে তাকানোই শ্রেয়।”


কীভাবে নিজের ভণ্ডামি চিনবেন

নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন, “আমার আচরণ কি আমার কথার সঙ্গে মিলছে?” যদি উত্তর না হয়, তা স্বীকার করুন। গবেষণায় দেখা গেছে, নিজের ভণ্ডামি স্বীকার করলে মানুষ সাধারণত ক্ষমাশীল হয় এবং আপনাকে আন্তরিক মনে করে।

Hypocrites: How to Survive in a World that's Full of Them

উত্তর অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফ স্টোন বলেন, “নিজের ভণ্ডামি বুঝতে পারা মানুষকে পরিবর্তনের অনুপ্রেরণা দেয়। কারণ কথায় আর কাজে অসঙ্গতি থাকলে ভেতরে অস্বস্তি জন্মায়, যা মানুষকে আরও সৎ হতে বাধ্য করে।”


শেখার সুযোগ হিসেবে দেখুন

গুগলের সাবেক নির্বাহী কিম স্কট একবার নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। তিনি এক বৈঠকের সময় পরিবর্তন করেছিলেন নিজের সন্তানদের সঙ্গে নাশতা করার জন্য। কিন্তু আয়ারল্যান্ডের এক সহকর্মী জানান, তাঁর সন্তানেরাও সন্ধ্যায় ডিনার করে—সেই সময়েও বৈঠকও পড়ে যাচ্ছে।

স্কট লজ্জা পেলেও পরে সময়সূচি সংশোধন করেন এবং ভবিষ্যতে সহকর্মীদের প্রতিক্রিয়া শোনার আহ্বান জানান। এক ডিনারে নিজের কিশোর সন্তানদের ফোন বন্ধ রাখার উপদেশ দিলেও তাঁর নিজের ফোন বেজে ওঠে, এবং তিনি তা রিসিভ করেন। তখন সন্তানরা বলে ওঠে, “তুমি তো ভণ্ডামি করছ!”

স্কট পরে ফোনটি সরিয়ে রেখে তাদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, “ভণ্ডামি নিয়ে লজ্জিত না হয়ে বরং এটিকে শেখার সুযোগ হিসেবে দেখা উচিত।”

ভণ্ডামি মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, কিন্তু সচেতনতা ও আত্মসমালোচনার মাধ্যমে আমরা এর প্রভাব কমাতে পারি। নিজের অসঙ্গতি স্বীকার করাই পরিবর্তনের প্রথম ধাপ—আর সেই সৎ প্রচেষ্টাই আমাদের নৈতিকভাবে দৃঢ় করে তোলে।


#ভণ্ডামি ##মনোবিজ্ঞান #মানবআচরণ #সারাক্ষণ_রিপোর্ট