শরীর ও মনের ভারসাম্য পুনরুদ্ধারের যাত্রা
গত গ্রীষ্মের এক বৃষ্টিভেজা শনিবার সকালে আমি নিজেকে আবিষ্কার করেছিলাম ইস্ট ভিলেজের একটি ছাদের ঘরে, সার্ফবোর্ডের মতো এক ব্যালান্স বোর্ডে দাঁড়িয়ে। একদিকে ভারসাম্য রাখতে গিয়ে কাঁপুনি আর দোদুল্যমানতা, অন্যদিকে শরীরের পেশী ও শ্বাসের নিয়ন্ত্রণ—সব মিলিয়ে যেন নতুন এক অভিযানের শুরু। সার্ফসেট নিউইয়র্কের সহ-প্রতিষ্ঠাতা অ্যারন থুভেনিন (Thuvenin) বলেছিলেন, “সার্ফিং শুরুতে সবার কাছেই অস্বাভাবিক লাগে।” ঠিক তেমনই, আমি ভয় পাচ্ছিলাম পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায়। যদিও সমুদ্র বহু মাইল দূরে, তবু পড়ে যাওয়ার ভয়টাই যেন ভেতরে কাজ করছিল।
আমার ইচ্ছে শুধু সার্ফবোর্ডে দাঁড়ানো নয়, বরং নিজের শরীরের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা—যাতে ট্রেনের ভিড়ে হ্যান্ডেলের প্রয়োজন না হয়, যোগাসনের ভারসাম্য ভয় না লাগে, এবং বাম পা-ও ডান পায়ের মতো স্থির অনুভব করে।
ভারসাম্য: নতুন যুগের স্বাস্থ্যধারণা
আজকাল মানুষ দাঁত ব্রাশ করার সময় এক পায়ে ভর দেয়—এই ট্রেন্ডের পেছনে রয়েছে সুস্থতার এক নতুন মানদণ্ড। শক্তি ও নমনীয়তার পাশাপাশি এখন ‘ব্যালান্স’ বা ভারসাম্যকে ধরা হচ্ছে স্বাস্থ্যের সূচক হিসেবে। চিকিৎসা গবেষণা বলছে, যাঁরা এক পায়ে ১০ সেকেন্ড দাঁড়াতে পারেন না, তাঁদের মধ্যে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি, মানসিক অবনতি, এমনকি মৃত্যু ঝুঁকিও বেশি। ২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এই ধরনের মানুষের মৃত্যু ঝুঁকি সাত বছরের মধ্যে ৮৪ শতাংশ বেশি।
এই ফলাফল ছড়িয়ে পড়তেই বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে ‘ফ্লেমিঙ্গো এক্সারসাইজ’—মানুষ এক পায়ে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজার পাশাপাশি, ধাঁধা সমাধান বা নতুন ভাষা শেখার চর্চাও করছে। ইউটিউবে ব্যালান্স বলের ওপর ব্যালে নৃত্যশিল্পী কিংবা চোখ বাঁধা অবস্থায় শরীরের নিয়ন্ত্রণ শেখার ভিডিও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
অনেকে বলেন, এই ভারসাম্যাসক্তি সমাজের অস্থির সময়ের প্রতিফলন—যখন প্রতিদিনের সংবাদই মানুষকে টালমাটাল করে তোলে। তবে আমি মনে করি, গণতন্ত্রের পতনের ভয় ও নিজের পড়ে যাওয়ার ভয় দুই সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।
মহামারি-পরবর্তী শরীরচর্চার পরিবর্তন
লস অ্যাঞ্জেলেসে দেখা হলো কানাডিয়ান প্রশিক্ষক অলিভিয়া স্প্রাউলজারের সঙ্গে, যিনি বলেন, “বিশ্ব উল্টে গেলে মানুষ নতুনভাবে স্বস্তি খোঁজে, আর সেটাই এখনকার চ্যালেঞ্জ।” তিনি আমার শরীরের একপাশের দুর্বলতা দূর করতে দেন ছোট ছোট ক্রস-বডি ব্যায়াম—বাইসাইকেল ক্রাঞ্চ, স্প্লিট লঞ্জ, ডেড বাগ ইত্যাদি। তাঁর মতে, ভারসাম্যের মূল উৎস শরীরের কেন্দ্র বা ‘কোর’। কোর শক্তিশালী হলে হাত-পা নিজে থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়।
অসমতা সংশোধনের কঠিনতা
দীর্ঘদিনের খারাপ ভঙ্গি, একপাশের অভ্যাস বা অবহেলার কারণে ভারসাম্য হারানো সহজ, কিন্তু ফিরিয়ে আনা কঠিন। নিউইয়র্কের আইডি হট যোগাতে যোগাসনের সময় বুঝি—যদি আগের রাতে ঘুম না হয় বা মানসিক চাপ থাকে, বাম পা নিয়ন্ত্রণ হারায়। যোগ প্রশিক্ষক ত্রিসিয়া ডোনেগান পরামর্শ দেন, “প্রথমে দুই পায়ে দাঁড়ানো শেখো, তারপর এক পা।”
ওয়াটারস্কিতে দুই পা পাল্টে ব্যবহারের অভ্যাস থেকেই এসেছে তাঁর নিখুঁত ভারসাম্যবোধ।
ব্যালান্স প্রশিক্ষণের বাস্তব অভিজ্ঞতা
ব্রুকলিনের ভিটাল ক্লাইম্বিং জিমে কার্লি স্নিডো আমাকে শেখালেন ‘স্ল্যাকলাইন’-এ হাঁটা—দুটি গাছের মাঝে বাঁধা সরু ফিতার ওপর দাঁড়িয়ে ভারসাম্য রাখা। এটি সম্পূর্ণ শরীর ও স্নায়ুতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণের পরীক্ষা।
৭২০ ফিটনেস সেন্টারে কোচ এমিলিও জৌবার্ট-মন্টানেরো বলেন, “ভারসাম্য মূলত শক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। আমি আলাদা করে ব্যালান্স ট্রেনিংয়ে বিশ্বাস করি না; পুরো শরীরের শক্তিই ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে।” তাঁর পরামর্শে আমি স্প্রিন্ট, জাম্প রোপ, ডেডলিফট, বুলগেরিয়ান স্কোয়াট, পুশ-আপ অনুশীলন শুরু করি।
শরীরের মানচিত্রে সূক্ষ্ম পরিবর্তন
ইউনিয়ন স্কয়ারের লিসা জোনস পিলাটিস স্টুডিওতে গিয়ে জানতে পারলাম, বাম হিপের দুর্বলতা ডান কাঁধের টান তৈরি করছে। তাঁর নির্ভুল পর্যবেক্ষণে বুঝলাম, ভারসাম্য শুধু পা নয়—পুরো শরীরের সমন্বয়ের ফল। তিনি ব্যাখ্যা করেন, “যখন কোর বা পাওয়ারহাউস শক্তিশালী হয়, মেরুদণ্ড সোজা হয়, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কম পরিশ্রম করে, আর শরীরের নড়াচড়া হয়ে ওঠে স্বাভাবিক ও সুষম।”
তাঁর ক্লাসে এক সেশন শেষে মনে হয়েছিল, আমি যেন একটু লম্বা হয়েছি।
ভারসাম্য একটি জীবনদর্শন
তবু কি আমি এখন বেশি ভারসাম্যপূর্ণ? হয়তো না। কিন্তু এখন জানি—এটি একদিনের কাজ নয়। এক পায়ে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ, চোখ বন্ধ রেখে ব্যায়াম, কিংবা আরও কিছু বুলগেরিয়ান স্কোয়াট ও ডেডলিফট—এসবই সেই ধীর যাত্রার অংশ।
শরীরের ভারসাম্য শেখার পাশাপাশি হয়তো জীবনও একটু সোজা হয়ে যায়।